ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে আতঙ্কিত বাংলার ফকিররা

Fakir Culture: প্রকৃতপক্ষে এই ফকিররাই কিন্তু হতে পারেন বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

ফকির হলো অভাবী। সে যেমন ভিক্ষুক, তেমনই সহজ-সরল মনের একজন তত্ত্বজ্ঞানী ও শুভ চিন্তার ধারক। মূল আরবি এই 'ফকির' শব্দর সঙ্গে ফরাসি দরবেশ শব্দের যোগ আছে। সে কলন্দর, ঘুরে বেড়ায়। সেই অর্থে তার কোনও ঘরবাড়ি নেই। আস্তানা বা আখড়া থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতেও পারে। জন্মসূত্রে কেউ ফকির হয় না। ফকিরি অর্জন করতে হয়। ফকির সৎগুণসম্পন্ন আধ্যাত্মে বিশ্বাসী, কিন্তু সে অনুমানের ধার ধারে না। তার বিচার বর্তমানকে কেন্দ্র করে।

আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, কল্পনানির্ভর শাস্ত্রধর্মের ব্যাখ্যাকে ফকিরি সাধকরা বলেন অনুমান। আর নিজেরা পরীক্ষিত ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষে 'বর্তমান'-কে মান্য করেন। এঁরা ভাববাদী ধর্মের প্রবল বিরোধী। শরিয়তের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে এঁদের ফকিরি যাপন। সুফি ভাবসাধনার অঙ্গ হলো এই ফকির জীবন। এঁরা ভেক নেন। মালাঝোলা, পাগড়ি ও জোব্বাতে সাজেন। সাধারণত সাদা কিংবা কালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে থাকেন।

অর্থাৎ, বলতে চাইছি যে, এঁরা হলেন মূলত বাস্তববাদী। গান এঁদের সাধনক্রম, তত্ত্বের রসভাষ্যও বলা যায়। দেহতাত্ত্বিক কড়চাসমূহ ফকিরের চর্যাচর্যে প্রাণ পায়। তবে সব ফকিরই যে গান গায়, তা নয়। শ্রুতি পরম্পরাগত তত্ত্ব, সুর, সাধনা, সাধ্য ও জীবনচর্যা এখানে সামগ্রিক এক ঐক্য তৈরি করে। ঘনবসতি বা জনসমাজে এরা থাকেন না। কিন্তু জনসমাজ নিয়েই এদের কার্যকর্মপদ্ধতি। এখানেই তাঁদের নিত্য আসা-যাওয়া। এখানেই তাঁদের আহরণ, এখানেই তাঁদের নিত্য-সংশ্লেষ। যা তাঁদের সাধনাকে বিস্তার দেয়, ব্যক্তি ও সমাজের সঙ্গে একটা সুক্ষ যোগাযোগসমৃদ্ধ মেলবন্ধন তৈরি করে। এদের ইদানীংকালে খুব একটা দেখা যায় না। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন অনেক কিছুই পাল্টে যায়।

আরও পড়ুন: সিনেমার নিন্দে করে জুটেছে প্রযোজকের মারও, বাঙালি মনে রাখেনি মৃগাঙ্কশেখর রায়কে

তার মানে ফকির নেই, তা বলছি না। বলছি, এখন তাঁরা অত্যন্ত সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। সংখ‍্যাগরিষ্ঠর জায়গা নিয়েছে স্বঘোষিত ফকিররা। যাদের সেই অর্থে কোনও পরম্পরা নেই। সাধনার তিলমাত্র নেই। এখন সব স্বঘোষিত 'ফকির'। সরকারি চাকরি করা ফকির। মাচায় মাচায় সেজেগুজে ফকির হওয়ার ফিকির। পেল্লায় গাড়িবাড়ির ফকির। টিভি-র ফকির, মঞ্চে বেতাল-বেসুরো ফকির। ফলে, ফকির শব্দর যে আবহমান গ্রাহ্যতা, ফকিরের যে জীবনধারণের শুদ্ধতা, তা ক্রমশই অপসৃয়মাণ। তাঁর তত্ত্ব প্রচারের যে প্রত্যয়, তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে যে প্রতিবাদ, মৌখিক পরম্পরায় সাধনসিদ্ধ যে জ্ঞান, যে গান- তা আর দেখতে পাওয়া যায় না, শুনতে পাওয়া যায় না।

ফলে ফকির ও তাঁর গান এখন শহরের বেহদ্দ তথাকথিত আমোদগেঁড়ে বংকালচারে আবিষ্ট। যা এখন কেবলই লোকসংগীতে পর্যবসিত। মানুষ হাততালি দিচ্ছে, উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে। তাতেই সংবর্ধনা মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, স্মারক-ফলকে জয়জয়কার হচ্ছে। কিন্তু যে গান উঠে আসে জীবনযাপনের প্রয়োগের মাধ্যমে, যে গান অনুশীলনের দ্বারা অর্জন করতে হয়, তা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এই যে দীর্ঘ পরম্পরাগত ঐতিহ্য, তাঁকে যেমন সংরক্ষণে আমরা মন দিইনি, তেমনই তাঁর প্রতি সামান্যতমও মনোযোগ রাখতে পারিনি। এ আমার শহুরে দেখার দুর্ভাগ্যে লালিত। একবারও ভেবে দেখছি না যে, ফকিরকে আমি কীভাবে দেখব, কোথায় খুঁজব! সে কি শহরের আলোকিত মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়ই দ্রষ্টব্য হয়ে থাকবে?

এর ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়ই। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে আমি জানি যাঁরা ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে ফকিরদের সংরক্ষণ, প্রসার ও প্রচারে এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে সাধারণ্যে তুলে ধরার। 'বাংলানাটক' নামের এই সংস্থা চেষ্টা করছে কীভাবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নানা কর্মশালা করে, এক ধরনের লোকায়ত শিক্ষার বিস্তৃতি দিতে। কিন্তু তা কি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট? এর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ফকিরদের সুরক্ষাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। শুধুমাত্র মাসিক ভাতা বিলোনোই যথেষ্ট নয়।

আসলে ফকিরকে চিনতে হলে, বুঝতে হলে মেলাগুলোয় যেতে হবে। সম্ভব হলে যেতে হবে তাঁর আস্তানায়, তাঁর আখড়ায়। শহর গ্রাস করছে গ্রামকে। সেটা ঠিক। তা ঐতিহাসিক নিয়মেই করবে। কিন্তু এখনো যেখানে ফকিররা সংঘবদ্ধভাবে নানা গ্রামে ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, তাঁদের সংরক্ষণের দায়িত্বও নিতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আজকের ধর্মবিভেদের রাজনীতির ফলাওকাণ্ডে ফকিররা কিন্তু আতঙ্কিত। একসময় মৌলবাদীদের আক্রমণে বহু ফকিরকে প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলায়, মায় এই উপমহাদেশে। জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের আস্তানা, আখড়া। জানি না, ক'জন খোঁজ রাখে গ্রামবাংলার মেলাগুলোতে আগত শত শত ফকিরের, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মৌলবাদীদের অত্যাচারে সীমান্ত পেরিয়ে পায়ে হেঁটে চলে আসছেন!

প্রকৃতপক্ষে এই ফকিররাই কিন্তু হতে পারেন বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যে শিক্ষা আমরা লালন শাহ্ থেকে পেয়েছি। যে শিক্ষা ফকিরের মূল মন্ত্রে নিহিত আছে। যে শিক্ষায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাকে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় ও গবেষণার পাতায় সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না। তার প্রায়োগিক অবস্থানে চিহ্নিত করতে হবে।

কিন্তু করবে কে?

More Articles