নেশা আর খিস্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলেন যে বাউল
ভাবের আড়ম্বর নেই। এ নেহাতই সাধারণ অর্থে সহজ-সাধারণ। গৌরকে জানতে হলেও ওই সহজিয়া পথ ধরতে হবে। ওর কথা শুনলেই বোঝা যায়, এই বিশ্বসংসারের তাবৎ কৌশল আর লেনাদেনার সে ঊর্ধ্বে, তথাপি দৈনন্দিন সমাজের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর...
এ লেখা এই কারণে নয় যে, গৌর খ্যাপা আমার চল্লিশ বছরের মনদরিয়ার বন্ধু ছিল, এই কারণেও নয় যে, আমি ওর ওপর লাগাতার কাজ করেছি, লিখেছি, ছবি করেছি একটার পর একটা। আসলে একটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে লিখতে বসেছি। এই নেট-বিভ্রান্ত, ই-গার্বেজের যুগে একজন প্রকৃতি-আদৃত, আর্ত অস্তিত্বের কথা মানুষ কীভাবে জানবে? গৌর খ্যাপা কোনওকালেই জনপ্রিয় বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। শহর কলকাতার মঞ্চে তার কোনও ডাক ছিল না। সে ছিল প্রকৃতপক্ষেই মূলধারার সম্পূর্ণতই বিরোধী। তার ছিল এক দরদি ভক্তবৃন্দ। যারা প্রান্তিক, তা সে গ্রামেই থাকুক অথবা শহরে, নিরক্ষর থেকে ইন্টেলিজেন্সিয়া- তারা মার্জিনালাইজড। এদের আকৃষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় দিকটা ছিল গৌরের উপস্থাপন। নিজের ভাবনা ও দর্শনচিন্তার সঙ্গে গৌর মিশিয়ে দিয়েছিল তার নিজস্ব রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। সেকথায় পরে আসছি।
একটা ভ্রান্ত ধারণার অবসন্ন ছায়া যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। যেমন ধরা যাক, ইউটিউব-সমাদৃত গৌর খ্যাপা! এর মধ্যে এক-আধ খণ্ড ওর ব্যক্তিক বিষয় এসে থাকলেও একটা তল না পাওয়া গৌর কিন্তু অনুপস্থিত থেকে গেল। সেইসব নেশাতুর গৌর আর খিস্তির গৌর, বেসুরো গৌর আর অসহিষ্ণু গৌর দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যে, তবে কি ওর মৃত্যুর একটা যুগ পেরোতে না পেরোতে একটা আমূল ভুল দিকচিহ্নে হারিয়ে যাবে সে? গৌর কত বড় বাউল ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে গোল বাধানোর দরকার নেই। নিজের খিস্তি দিতে বা শুনতে ভালো লাগলে গুছিয়ে দিন ও শুনুন। কিন্তু গৌরের মতো একজন প্রকৃত খ্যাপাকে অকারণে খেপিয়ে, নেশা করিয়ে এ কী ধরনের মনোরঞ্জন চলছিল? আজও তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ওই যে লিখেছি যে, গৌর জনপ্রিয় ছিল না। তথাপি ওর প্রতি আকর্ষণের বশে ওর ভক্ত, বন্ধু, অনুগতর সংখ্যা নেহাত কমও ছিল না। তা ক্রমশ আরও আরও বেড়েছে। গৌর মিথ হয়েছে নেশাখোর আর বাওয়ালকথার শিরোমণি হিসেবে এই নেটদুনিয়ায়। সেই টানেই পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী, বেআক্কেলে মদারু, বাবুর বাড়ির ছেলেমেয়ে থেকে গাঁজাখোর, দীন, জিজ্ঞাসু, ক্ষুৎকাতর, দালাল, গানপিপাসু- উদ্বেলিত সমবেত সবাই। ফলে নেটকারবারে গৌর কোল পেয়েছে। সেই গৌর পপুলার। তাতে কোনও সমস্যাই নেই। কিন্তু এ কোন গৌর?
আরও পড়ুন: পৃথিবীর প্রাচীনতম ফ্লাইওভার এই শহরে, ভবঘুরের ঠিকানা ফ্লোরেন্স
পঁচিশ বছরের ছেলে গৌর সম্পর্কে বলছে। পুরোটাই মনের মাধুরী মিশিয়ে। সে কবে দেখল গৌরকে? তার জীবনের শুরুতেই তো গৌর চলে গেছে। একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তো বললাম গৌরকে কখনও প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ওর আসন থেকে উঠতে দেখেছ?কোনও জায়গায় সে একবার বসে পড়লে তা যদি তার পছন্দ হয়, তবে সে আসন ছেড়ে গৌর আট-দশদিন নাই-ই উঠতে পারে। না, একবারের জন্যও নয়, ওই যে লিখলাম, প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কারণেও নয়। আমরা যারা ওর সান্নিধ্য পেয়েছি, তারা ক'জন গৌরকে ঘুমোতে দেখেছি? এটা তার শরীর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও জীবনচর্চা থেকে উঠে এসেছে। এত কম খাওয়াদাওয়াতে কীভাবে একজন বেঁচে থাকে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। গৌর অপরিসীম নেশা করত, তা যেমন ঠিক, তেমনই গৌরের দৈনন্দিন ছিল অতি পরিশ্রমের। গান ও কথা ছিল মূখ্য। যে কথার মানে-মাত্রা এক ভিন্ন জগতের ঈঙ্গিত নির্দেশ করে। এই কথাগুলো তো জানতে হবে। শুধু 'জয় গৌর' বললে হবে না। কবি দীপক মজুমদার বলেছিলেন, "গৌর হলো সিভিল সোসাইটির ডিসওরিয়েন্টেশনের বিরুদ্ধে গেরিলা ওয়ারফেয়ার।"
তার গানবাজনার দক্ষতা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। গৌর ছিল একজন টোটাল মিউজিসিয়ান। সংগীত যার কাছে আন্তর্জাতিক ভাষা। কলকাতার বালিগঞ্জী বাংলা সংস্কৃতির বৈঠকখানায় তার জায়গা হয়নি ঠিকই, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু দেশে ও বিদেশে সংগীতজ্ঞদের কাছে তার একটা সবিশেষ জায়গা তৈরি হয়ে ছিল। যদিও বাংলার আমুদে মেনস্ট্রিম মিডিয়ার হাটে-বাজারে গৌর উল্লিখিত নয়। সেখানে বর্তমান নেটগোলকের ধাঁধায় যদি দেখা যায় যে, একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে মশকরা চলছে, প্ররোচিত করা হচ্ছে, তখন প্রশ্ন ওঠে, চিন্তিত হয়ে পড়ি!
সাধারণত মানুষ চিনতে হলে, বুঝতে হলে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন যেমন করতে হয়, তার চেয়েও অধিকতর মনোযোগ দিয়ে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের আবহে ঢুকে পড়তে হয়। একথা আমি বলছি না। বড় বড় সাধু-গুরুরা বলেছেন। এই মানুষ বলতে কোনওভাবেই এর মধ্যে মনের মানুষ বা অচিন মানুষ গোছের ভাবের আড়ম্বর নেই। এ নেহাতই সাধারণ অর্থে সহজ-সাধারণ। গৌরকে জানতে হলেও ওই সহজিয়া পথ ধরতে হবে। ওর কথা শুনলেই বোঝা যায়, এই বিশ্বসংসারের তাবৎ কৌশল আর লেনাদেনার সে ঊর্ধ্বে, তথাপি দৈনন্দিন সমাজের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আছে। এমনকী, জ্যোতিবাবু থেকে মমতা, জমি-হাঙর থেকে নগরায়ণ, চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে মুনাফা- সব নিয়েই সে বলবে। মানা, না-মানা তার শ্রোতাদের ওপর নির্ভর করবে। তা নিয়ে গৌরের কিছু আসে-যায় না। গৌর ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী একজন স্মৃতিধর বাউল। যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা থেকে ঋত্বিক আর সত্যজিতের ছবি নিয়ে নিজের মতো করে বলে যেতে পারত। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার শেষে জীবনানন্দের উল্লেখ করত না পড়েই। সে ছিল অসাধারণ শ্রুতিধর। যেমন শত শত গান তার মনে থাকতো তেমনই কেউ কিছু বললেই তা শোনা ও মনে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।
কিন্তু এই নেটসাগরে ভেসে কেই-ই বা তার খবর রাখছে?