সিনেমার নিন্দে করে জুটেছে প্রযোজকের মারও, বাঙালি মনে রাখেনি মৃগাঙ্কশেখর রায়কে
Pagoler Songe Jabi: শুনেছি তাঁর সমালোচনা পড়ে নাকি আধিকাংশ দর্শক ঠিক করত, কোন ছবি দেখবে।
বিখ্যাত লোক, বাজার গরম করা আমোদগেঁড়ে, চালিয়াতচন্দর বা ফেরেব্বাজ, মানে আপনি মোড়ল কেষ্টবিষ্টুদের কম দেখিনি। চাই বা না-চাই, পেশাগত কারণেই এদের সঙ্গে মোলাকাতে খানিক বাধ্য হয়েছি-ই বলা যায়। কোনও কাজ নেই, সমাজ-সংসার, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিন্দুমাত্র অবদান নেই; কিন্তু বিরাট হামবড়া ভাব।
সঙ্গে রয়েছে মিডিয়ার ঢক্কানিনাদ। আর আছে ইদানীংকালের রাজনৈতিক দহরম-মহরম। ফলে এরাই এখন সংস্কৃতির পান্ডা, এরাই গল্প। তবে কোনও গাল পাড়তে এই লেখার আয়োজন নয়। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে যে মানুষগুলোকে দেখেছি তাতে যে ভয়ংকর রাগ তৈরি হয়েছে, তারই খানিকটা বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। যদিও রাগ দেখাতে নেই, পুষে রাখতে হয়- সেকথা কে বলেছে, মনে নেই। কিন্তু আমার সংস্কৃতিতে রাগের কোনও জায়গা নেই, তেলের আছে। সে-বিষয় নিশ্চয়ই আমার পাঠকবৃন্দ সবাই নিঃসন্দেহ।
ভিন্ন প্রবাহে, মাথা উঁচু করে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার মানুষ ছিলেন মৃগাঙ্কশেখর রায়। আজ তাঁর সম্পর্কে দু'-চার কথা লিখব। মৃগাঙ্কদার জীবিতাবস্থার শেষ দু'-দশক আমি ছিলাম তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর। এমনকী, কিছুকাল বজবজের গঙ্গার ধারে একটি পুরনো সাহেব আমলের বাংলোবাড়িতে একসঙ্গে কাটিয়েছি। সেই সময়ে আমরা দু'জনেই কাজ করতাম একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। স্বল্পভাষী মৃগাঙ্কদা সপ্তাহে দিনতিনেক আসতেন আপিসে। আমাকে রোজই যেতে হতো। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি অফিসে সারাক্ষণ লিখতেন কিংবা কোনও বই পড়তেন। অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলতেন না। মালিকপক্ষ তাকে সমীহ করত, মান্যতা দিত। কাজের শেষে সান্ধ্যবেলায় আমরা দু'জন পৌঁছে যেতাম কলকাতা প্রেস ক্লাবে। মৃগাঙ্কশেখর ছিলেন হুইস্কি-ভক্ত। আমি সে পথে কখনও যাইনি।
এবার প্রশ্ন হলো, কে এই মৃগাঙ্কশেখর রায়?
আরও পড়ুন: ‘যন্ত্রের কী দরকার, অন্তরে সব বাজতাসে!’ প্রকৃত ‘গুরু’ ছিলেন সুবল দাস বাউল
ওর ছোটবেলা সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানতে পারিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে রেকর্ড নম্বর পেয়ে এমএ পাশ করেন। কলেজ-শেষে সে-সময় মাত্র ছ'মাস কাজ করেন এজি বেঙ্গলে। তারপর ছেড়ে দেন। সারা জীবন আর কোনও চাকরি করেননি। এরপর তিনি টানা চব্বিশ বছর ধরে কখনও আনন্দবাজার, কখনও অমৃতবাজার, কখনও যুগান্তর কিংবা স্টেটসম্যানে প্রতি শুক্রবার সিনেমার সমালোচনা লিখেছেন। হ্যাঁ, প্রতি সপ্তাহে। শুনেছি সেই সমালোচনা পড়ে নাকি আধিকাংশ দর্শক ঠিক করত, কোন ছবি দেখবে। একবার স্বনামধন্য এক পরিচালকের ছবিকে 'খারাপ' বলেন। ছবির প্রিমিয়ার পার্টিতে তাঁকে আমন্ত্রণ করা হয়। তিনি যান সেই অনুষ্ঠানে। রাতে ফেরার পথে প্রযোজকের নির্দেশে তাঁর পিআর সংস্থার লোক ওঁকে এমন মারধর করে যে, সারাজীবনের মতো তাঁর দন্তরুচি কৌমুদী নিঃশেষ হয়ে যায়। মৃগাঙ্কদা সম্ভবত একমাত্র ফিল্ম সমালোচক, যাকে টিটকিরি দিয়ে (পড়ুন গালি দিয়ে) সিনেমার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো প্রতি সপ্তাহে, বড় বড় সংবাদপত্রে। সুখেন দাসের ছবির এমন বিজ্ঞাপন আমি নিজের চোখেই দেখেছি।
সম্ভবত বাগীশ্বর ঝা-র পর এমন সমালোচক বিরল। কেননা এখন যারা লেখে, তারা অধিকাংশই সিনেমার প্রযুক্তিগত দিকটা জানেই না। এই তো কিছুদিন আগে এক ঋত্বিকপন্থী ইন্টেলেকচুয়াল ফিল্ম সমালোচক সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়তে লিখে ফেললেন যে, ঋত্বিক জিরো লেন্স ব্যবহার করেছিলেন। যা আদপেই হয় না। থাক, সেসব অন্য কথা। ফিরে যাই মৃগাঙ্কশেখরে।
মৃণাল সেনের প্রথমদিককার সহকারী মৃগাঙ্কদা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ডকুমেন্টারি ও কর্পোরেট ছবি বানিয়েছিলেন। 'সোনার পায়রা' নামে একটি কাহিনিচিত্রও তৈরি করেছিলেন। তাই বলছিলাম, সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয়আশয় সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। আর ছিল তাঁর সোনার কলম। বাংলা ও ইংরেজি ভাষাটা লিখতেন দূর্দান্ত। কবি সমর সেনের ফ্রন্টিয়ার কাগজে নিয়মিত লিখতেন মৃগাঙ্কশেখর।
মৃগাঙ্কদার মৃত্যুর পর 'সুবর্ণরেখা'-র কর্ণধার ইন্দ্রনাথ মজুমদার আমাকে ডেকে পাঠান। তারপর একথা-সেকথায় বলেছিলেন, "মৃগাঙ্কর তো আর কেউ নেই পরিবারের। ফলে কোনও দাবিদার নেই। তুমি কি ওর লেখাপত্রগুলো সব জোগাড় করতে পারো? তাহলে একটা বই করতাম। ওর সিনেমা নিয়ে লেখাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই জরুরি। এছাড়াও একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি হবে।" সে-কাজ করা হয়নি আমার বেমক্কা স্বভাবের কারণে। কিন্তু বহু লেখা লিখেছেন। আনন্দবাজার-সহ অনেকগুলো ইংরেজি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় লিখেছেন। নন্দন থেকে প্রকাশিত কাগজ বা সংকলনেও লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য ফিল্ম ক্লাবের ম্যাগাজিনে। তবে বিনিপয়সায় কখনও কলম ধরেননি।
মৃগাঙ্কদা ছিলেন গিনেস ব্যক্তিত্ব। এনএফডিসি-র (ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) প্রথম থেকে কমিটি সদস্য। নন্দন স্থাপিত হওয়ার প্রথম দিন থেকে পরিচালন কমিটির সদস্য। নন্দন উদ্বোধনের দিন ঋত্বিকের ছবির সঙ্গে তাঁর তথ্যচিত্রও দেখানো হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফিল্ম অ্যাডভাইসরি বোর্ডের আমৃত্যু সদস্য ছিলেন। বহুবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারক হয়েছেন। বিএফজেএ-এর (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) বেশ কিছুদিন সভাপতি ছিলেন। মনেপ্রাণে ছিলেন বামপন্থী। কিন্তু কোনও দলবাজি বা মোসাহেবিতে তাঁকে দেখিনি। এই লাজুক মানুষটি বড় রাস্তা পেরোতে ভয় পেতেন। পার্ক স্ট্রিটের চৌমাথা পেরোতে আধঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে কোনও সহৃদয় ব্যক্তি পার করে দেন। ট্যাক্সি ছাড়া যাতায়াত করতেন না। লম্বা লম্বা সিগারেট খেতেন। নির্দিষ্ট কোনও বাড়ি ছিল না মৃগাঙ্কশেখরের।বন্ধুবান্ধবের দেওয়া নানা জায়গায় থেকেছেন। হোটেল বা গেস্টহাউজ ভাড়া করেও থাকতে দেখেছি। মৃগাঙ্কশেখরের কোনও দুঃখবোধ ছিল না। সবসময়ই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।