'পুরুষের থেকে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করে মেয়েরা', সত্যজিৎ বলেছিলেন সেদিন
মানিকদা গম্ভীর। উনি পাইপ মুখে সামনের বিশাল খোলা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ মগ্ন। কোনও কথা নেই। আমার বুক ধড়ফড় করছে। কী বিপন্ন অপেক্ষা!
এমন একটা সময় ছিল আমার জীবনে, যখন সপ্তাহের প্রতিদিনই হয়তো দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, একটি ঘরে তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। তিনি সত্যজিৎ রায়। এমন বিরল সৌভাগ্যের সাংবাদিকের সংখ্যা ক্রমেই কমে গেছে। আমি এখনও টিম টিম করছি। আর সেই সব সোনালি স্মৃতির স্রোতে ভাসছি।
পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, সত্যজিতের কাছে আমার প্রাপ্তি অন্তহীন। যখন তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে, তখন এতটা বুঝিনি। যত আমার বয়স বাড়ছে, যত বয়স বাড়ছে তাঁর মৃত্যুর, তত অনুভব করছি পরমকে হারানোর বেদনা।
বিশপ লেফ্রয় রোডে তাঁর বিপুল অ্যাপার্টমেন্ট। বিশাল দরজা। বেল দিয়েছি এইমাত্র। প্রতিবার বুক দুরদুর। প্রতিবার একই অনিশ্চয়তা। প্রতিবার একই ভয়। আর প্রতিবার দরজা খুলে দাঁড়ান তিনি, তাঁর ছয় ফুট চার! আর সেই একই ব্যারিটোন, এসো! কিংবা, এই বৃষ্টির মধ্যে!
আরও পড়ুন: রবীন্দ্র-ভক্তরা তাড়াতে চেয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে, বলেছিলেন রামকিঙ্কর
কখনও কখনও দরজায় লাগানো 'DON'T DISTURB'। তাঁরই শিল্পিত হস্তলিপি। এটা হতো পুজোর আগে। কিংবা শুটিংয়ের আগে। হয় তিনি ফেলুদা লিখছেন, নয় তিনি চিত্রনাট্য লিখছেন খেরোর খাতায়। আমাকে কিন্তু বলে দিয়েছেন, ডোন্ট ডিসটার্ব দেখলে পিছনের দরজায় বেল দেবে। পিছনের দরজা মানে বারান্দার দিকের দরজা। সেটা আর এক বিশাল ব্যাপার। বারান্দায় ঢুকেই ডানধারে বাবুর ঘর। বাবু, অর্থাৎ সত্যজিৎ-পুত্র, বিখ্যাত সন্দীপ রায়। তখন কিন্তু বাবু বেশ ছোট। তারপর আমার সামনেই বড় ও প্রখ্যাত হলেন। সন্দীপ রায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কে এখনও সেই সময়ের সৌহার্দ্য ও সহবতের রং লেগে আছে। সেই সময়ের বাঙালি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ব্র্যান্ড নয়, বাঙালিয়ানা ছিল বাঙালির পরিচয়। বাঙালি বলতে তখন আমার মতো তরুণও বুঝত মানিকদাকে। মানিকদাই শেষ আন্তর্জাতিক বাঙালি, যাঁর একমাত্র ব্র্যান্ড ছিল শিক্ষা, মনন ও প্রকাশ। এমন বাঙালি আমার ধারে-কাছে, প্রাত্যহিক নাগালে আর নেই। দীপ নিভে গেছে মম!
সন্দীপের ঘর দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ঘরে যাওয়া মানে সন্দীপের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা। এমন আড্ডায় মন বেশ খোলসা হয়। সেই আড্ডা উধাও। মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়, কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম। কোন পাপে এমন হল!
একদিন সত্যজিৎ রায়ের ঘরে গিয়ে দেখি উনি পিয়ানো বাজাচ্ছেন। আমি চুপিচুপি উনি যেখানে বসে কাজ করেন কিংবা ভাবেন কিংবা কথা বলেন, সেখানেই একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। এটা আমার কোহিনুর মুহূর্ত। হারাতে পারি না। যে চেয়ারে বসলাম, সেটি মানিকদার চেয়ারের কোনাকুনি পাশে। মানিকদা পিয়ানো বাজাচ্ছেন পিছন ফিরে। আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না। শীতকাল। মানিকদার গায়ে শাল। উনি হঠাৎ থামলেন। কিছুক্ষণ শিস দিলেন। এমন দীর্ঘ স্পর্শময় সুরেলা শিস কারও মুখে কখনও শুনিনি। আমি মুগ্ধ। এরপর সেই সুর বাজালেন পিয়ানোতে।
বুঝলাম, তিনি সিনেমার কোনও দৃশ্যের প্রেক্ষিতে সুর ভাবছেন। এমন এক প্রাপ্তি ঘটবে আমার জীবনে কে জানত! বেঁচে থাকা সার্থক হলো। সেই অপরাহ্ন কোনওদিন কি ভুলব?
আমার একটা পত্রিকা ছিল। নাম 'নৈর্ঋতি'। আমার পত্রিকার জন্য পিকাসোর মুখের একটা স্কেচ চাই মানিকদা। মানিকদা তাকালেন আমার দিকে। আশ্চর্য সেই চাহনি। মানিকদা কিন্তু মানিকদাতে নেই। তিনি অন্য কোথাও। অন্য কোনওখানে। আমি বসে তাঁর পাশের চেয়ারে। কিছুক্ষণ কলম কামড়ালেন মানিকদা। তারপর মরা পাইপের তামাক বিশেষ কায়দায় উসকে দিয়ে আবার জ্বালালেন। তখন পাইপ খেতেন। কী সুন্দর যে দেখাত! মারি সেটন যে বলেছেন, সত্যজিৎ রায়কে দেখলে তাঁর আলেকজান্ডারকে মনে পড়ে, একেবারে খাঁটি কথা।
মানিকদা এত লম্বা, তিনি বসেন চেয়ারে, পা চলে যায় সামনের তক্তাপোষ পর্যন্ত। তিনি হাঁটু গুটিয়ে এমন আকারে আনলেন, তৈরি হলো মজবুত ইজেল। সেখানে বসালেন কাঠের পিঁড়ি। এইভাবে ছবি আঁকতে দেখেছি তাঁকে। তাহলে কি এবার পিকাসো? বলতে না বলতেই হাতে চাঁদ? ঠিক তাই। সাদা কাগজের ওপর কলমের কয়েকটি আঁচড়ে ফুটিয়ে তুললেন পিকাসো। আমি সেই প্রথম জানলাম, পিকাসো মানে তাঁর চোখ। মানিকদা ছবিটা আমাকে দিয়ে বললেন, চলবে? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর হয়? আজও হয় না। আর আমার বয়স তখন সাতাশের বেশি নয়। স্কটিশচার্চ কলেজে মাস্টারি করি। সিনেমা আর পড়ার ঘোরে থাকি। মানিকদা এক অর্থে আমার মাস্টারমশাই। কত বইয়ের যে খবর দেন আমাকে! উৎসাহ দেন পড়তে, লিখতে। তখন সবে 'দেশ' পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছি 'দেশ'-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষের তাগিদে ও প্রেরণায়।
একদিন মানিকদার ঘরে কেউ নেই। তিনি একেবারে একা। একা মানে সত্যিকারের একা। আর সত্যিকারের একা মানে ভোরের আকাশে শুকতারার মতো একা। এমন সুন্দর নিঃসঙ্গতা খুব কম দেখা যায়। আমি হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, মানিকদা, আপনার পছন্দের নারী ঠিক কেমন? কোন কোন গুণ তার থাকতেই হবে? প্রশ্নটা করার পরেই যে কী ভয় করেছিল, কী বলব!
মানিকদা গম্ভীর। উনি পাইপ মুখে সামনের বিশাল খোলা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ মগ্ন। কোনও কথা নেই। আমার বুক ধড়ফড় করছে। কী বিপন্ন অপেক্ষা!
আকস্মিক সুঠাম, সাবলীল, প্রত্যয়ী ব্যারিটোন উত্তর মানিকদার কণ্ঠে: মেয়েদের মধ্যে আমার যে গুণটি সবথেকে ভালো লাগে, সেটি হলো তাদের সহনশীলতা, বাস্তববোধ এবং ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতা। এই গুণ পুরুষের মধ্যে আমি ততটা দেখিনি, যতটা দেখেছি নারীর মধ্যে। পুরুষের থেকে অনেক বেশি কষ্টও সহ্য করতে পারে মেয়েরা। বিশেষভাবে মানসিক কষ্ট। আরও একটি গুণ মেয়েদের মধ্যে আমার খুব ভালো লাগে। সেটা হলো, মেয়েদের মনের রহস্য। ওরা মনের কথা চেপে রাখতে পারে। এই গুণটা আমাকে ফ্যাসিনেট করে।
অনেক বড় একটা লেখা লিখেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের পছন্দের নারী নিয়ে। এবং তাঁর হাতেও দিয়েছিলাম। আরো একটি কাণ্ড করেছিলাম।
মানিকদার হাতে দিলাম আমার লেখা একটি বই। 'বিষয় সত্যজিৎ'। উনি বইটার দিকে কিছুক্ষণ শিশুর আনন্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হইহই করে বললেন, এটা আবার কবে করে ফেললে!
মানিকদার এই সহজ-সরলতা আর কোনও বাঙালির মধ্যে আমি পাইনি।