আর কতদিন সরকারের তৈরি করা ভেলকি আর ভয়ের ফাঁদে পা দেব আমরা?
যদি যুদ্ধবিগ্রহ জৈবিক প্রয়োজনীয়তা না হয়ে নেহাৎ মানুষের তৈরি পন্থা হয়ে থাকে, তবে এর পিছনের কারণকে চিনে নেওয়ার এটাই আদর্শ সময়।
ভয় তখনই সবচেয়ে বেশি ভীতিপ্রদ, ত্রাসসঞ্চারী, যখন তা বিস্তীর্ণ, বিকীর্ণ, অস্পষ্ট, অসংলগ্ন, শিকড়বিহীন, যখন কোথাও তার নোঙর করার নেই, তা উন্মুক্ত, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা ঠিকানাবিহীন। যে সংকটে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত, তার আভাস ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র, কিন্তু সেই সংকট দৃশ্যমান হয় না কোথাও, তখন ভয়ের দাঁত-নখ আরও প্রকট। আমাদের অনিশ্চয়তাকে, আসন্ন বিপদ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতাকে আমরা 'ভয়' বলে চিনি।
জিগমান্ট বাউম্যান
পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক জিগমান্ট বাউম্যানের এই উক্তিটি হাঙ্গেরিয়ান-কানাডিয়ান বুদ্ধিজীবী এবং সমাজতত্ত্ব বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক ফুরেদি নিজের বই 'হাউ ফিয়ার ওয়ার্কস'-এ উল্লেখ করেছেন। ফুরেদি এই বইতে একবিংশ শতকের বিশ্বকে গ্রাস করতে বসা ভীতির সংস্কৃতিকে কাটাছেঁড়া করেছেন। আমাদের প্রাথমিক সংবেদনের অন্যতম এই ভয়, যা মানুষের ভয়ের সংস্কৃতির চালিকাশক্তি, আবার দিকনির্দেশকও বটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভীতির সংস্কৃতি হয়ে এসেছে নৈতিক নিয়মকানুনের নির্ধারক, বেঁচে থাকা এবং নানাবিধ উদ্ভাবনের অনুঘটক এবং কখনও কখনও গণমানুষকে নিয়ন্ত্রণের শক্তিশালী যন্ত্রও বটে। ফুরেদি তাঁর বইয়ে বলছেন, ভয়ের নির্ধারক আচরণগুলো যে সবসময় শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কিত, এমনটা নয়। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, আমাদের সবথেকে তীব্র ভীতিগুলির উৎস লুকিয়ে আছে সম্মানহানি, অমর্যাদা বা খ্যাতিতে আঘাত আসার সম্ভাবনায়।
আমরা এক ত্রাসের দুনিয়ায় বাস করি। এমন এক দুনিয়া, যেখানে সবসময় আতঙ্কিত হতে হয়, এই ক্রমশ খণ্ডিত ও মেরুবিভক্ত হয়ে আসা সমাজ যদি আমাকে স্বীকার না করে! ভয়ের আখ্যান, ভয়ের শর্ত ও প্রকৃতিও সভ্যতার বদলের অগুনতি স্তরের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। 'মৃত্যুভয়' থেকে 'ঈশ্বরভীতি' হয়ে 'ভয়ের প্রতিই ভয়'- ভয় নিজের ঠিকানা বদলেছে বারবার। কিন্তু এই সবক'টি স্তরের মধ্যেও যা ধ্রুবক রয়ে গেছে, তা হল ভয়ের রাজনীতিকরণ। এক-একসময় 'হিংসা' ও 'ভয়' হয়ে ওঠে সহচর।
আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন
হিংসা এমন এক প্রবৃত্তি, যা মানবমনের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। হিংসার বৈজ্ঞানিক ও জৈবিক উৎস এখনও গবেষণার আতসকাচের তলায়। প্রাথমিকভাবে, হিংসার অভিব্যক্তি জন্মেছিল বিপদের আশঙ্কা থেকে, এক নতুন গড়ে উঠতে থাকা পৃথিবীতে যা কিছু অজানা-অচেনা, তার প্রতি ভয় থেকে, নতুন সেই পৃথিবীতে সদ্য-আবিষ্কৃত যা কিছু, তার সঙ্গে লড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেতনা থেকে। কিন্তু ইতিহাস বাঁক বদলায়, তার সঙ্গে সঙ্গে হিংসা হয়ে ওঠে নিরাকার, নিরাবয়ব, বিক্ষিপ্ত। এক নিয়ত ভয়ের সঙ্গে তার বোঝাপড়া। প্রতিবেশী বা অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক যেভাবে কায়েম রাখতে চাই নিজেদের, সেই অধিকার যদি না থাকে- এই আতঙ্ক গ্রাস করে। আর তা থেকেই বেড়ে উঠতে থাকে হিংসা, এই আতঙ্ক থেকেই তৈরি হয় এক নিরবচ্ছিন্ন অথচ ভিত্তিহীন আশঙ্কার বোধ। আধুনিক রাজনীতির এটাই বোধহয় সবচেয়ে দানবীয় উদ্ভাবন।
ভাষার উৎপত্তির প্রায় ১,৫০,০০০ বছর কেটে গেছে, অন্যকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করার অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে তাও কোনও শব্দের ছকে ধরা গেল না। ইতিহাসে যে নথি আছে বা নেই, সেই তামাম অসংগঠিত অপরাধের বাইরেও, শতকের পর শতক যা ধ্রুব রয়ে গেছে, তা হল 'যুদ্ধ'। আজ পাঁচ মাস হয়ে গেল, রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধলিপ্ত এবং খুব সম্প্রতি রাশিয়ান সেনাবাহিনী লাইসিঞ্চানস্ক শহর পুরোদস্তুর দখল করেছে। মানবজীবনের অশেষ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া এই সারবত্তাহীন যুদ্ধগুলিতে যে কিছুই হয় না, সেই মূল সত্যটিকে আবিশ্ব যথারীতি উপেক্ষা করে চলেছে। এহেন অবস্থায় সামরিক ঝোঁকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা ও স্মৃতিচারণ গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ করার জন্য মানুষের অপ্রতিরোধ্য তৃষ্ণার নেপথ্যে থাকা যুক্তি ও মানসিক গঠনতন্ত্র মনোবিদ, ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও নৃতত্ত্ববিদদের কাছে ব্যাপক পর্যালোচনা, গবেষণা ও বাগবিতণ্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছে। এটা কি আমাদের জিনে নিহিত থাকা কোনও প্রবণতা, যার চর্চা মানবসভ্যতার গোড়া থেকেই আমরা করে আসছি? এসব প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর যদিও এখনও পাওয়া যায়নি, কিন্তু কিছু গবেষণা আমাদের নিজেদের অতীত সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে গোছানো একটি জানাবোঝার পরিসর তৈরি করতে সাহায্য করে।
বিবর্তনের ফসল হিসেবে মানুষের অস্তিত্ব ও চেতনা দানা বাঁধতে শুরু করে এমন একটি গ্রহে, যা নিয়ে তাদের প্রায় কোনও ধারণাই ছিল না। ক্রমে তারা আগুন আবিষ্কার করে, লড়াই করতে শেখে খিদে, রোগ-জরা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদির সঙ্গে। জাদুকরের ভেলকি দেখার মতো অবাক সম্ভ্রমের সঙ্গে আমরা দেখেছি মানুষ কীভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র জানল, কীভাবে শিখল মহাকাশে উড়ে যেতে, কীভাবে তৈরি হলো তার প্রতিরোধের মন, কীভাবে ভাবনা প্রকাশ করতে শিখল সে অনুকরণীয়, সৃষ্টিশীল বিবিধ মোকামে।
কিন্তু মানুষের এই সমস্ত বিস্ময়কর ক্ষমতা ও বহুমুখী চরিত্রের মাঝে একদিন হঠাৎ সহাবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করার এই অদম্য চাহিদার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে খুঁজে পায় তার 'ইউরেকা' মুহূর্ত। এইভাবে বললে হয়তো বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা ক্ষয়ক্ষতির ধারাবাহিকতার সরলীকরণ করা হয়, কিন্তু মানুষের হিংসার প্রকাশের মধ্যে যে একটি ধাঁচ আছে, তা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব, বিশেষ করে যেখানে সহিষ্ণু হয়ে থাকতে পারার অক্ষমতা এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। লিডস বেকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের বরিষ্ঠ অধ্যাপক স্টিভ টেলরের বক্তব্যের অনুষঙ্গ টেনে বলা যায়, বিশ্ব ইতিহাসের যাবতীয় বইয়ের সূচনা হয় সচরাচর ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বেড়ে ওঠা মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার উল্লেখ করে। সেই সময় থেকে আজকের দিন অবধি, ইতিহাস যুদ্ধের এক অফুরান ফর্দ ছাড়া কিছুই নয়। ১৭৪০ এবং ১৮৯৭ সালের মধ্যে ইউরোপে ২৩০টি যুদ্ধ ও বিপ্লব ঘটেছে, বিংশ শতক সাক্ষী থেকেছে দু'টি বিশ্বযুদ্ধের। আজ একবিংশ শতাব্দীর এই চলতি সময় পর্যন্ত মানবসভ্যতার নিয়তি ক্রমশ নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আমাদের কীর্তিকলাপের বিষাক্ত ফলাফল হিসেবে পৃথিবীতে প্রাণধারণের জন্য অনিবার্য যে সুন্দর এবং বিরল ভারসাম্য, তা বিপন্ন হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি বিদ্রোহ করছে, এবং তার বিদ্রোহ ততদিন চলবে, যতদিন না মানুষ পৃথিবীর কাছে এবং পৃথিবী মানুষের কাছে অতীত হয়ে যাবে। অথচ তা সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট, অপরিসীম দারিদ্র এবং অতিমারীর সময়ে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গ্রহেও যুদ্ধের ভবিষ্যৎ একইরকম উজ্জ্বল এবং বিভিন্ন দেশ সামরিক ব্যয়বাহুল্যে এখনও দেউলিয়া হয়ে চলেছে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘবদ্ধ হিংসার প্রথম যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায় লক্ষ অযুত বছর আগে নয়, মাত্র ১৩,০০০ বছর আগে। এই প্রমাণ হলো নীলনদের উপত্যকায় পাওয়া একটি গণকবরস্থান। নৃতত্ত্ববিদ আর. ব্রায়ান ফার্গুসন বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন যে, যুদ্ধবিগ্রহের বয়স মাত্র ১০,০০০ বছরের কাছাকাছি। তাই প্রশ্ন ওঠে, যুদ্ধ কি সত্যিই এক আদিম জৈবিক অভিশাপ, না নির্দিষ্ট একদল মানুষের স্বার্থে হওয়া একটি সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন? 'সংঘাত' শব্দটির সমার্থক শব্দগুলি পরিবর্তনশীল। কখনও আমরা একে বলি 'যুদ্ধ', কখনও 'গৃহযুদ্ধ' বা 'ঠান্ডা লড়াই' বা 'প্রতিনিধিত্বমূলক যুদ্ধ' বা 'গেরিলা যুদ্ধ', কখনও আবার এর নাম হয় 'দাঙ্গা' বা 'গণঅভ্যুত্থান'। শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত-ঐতিহাসিক এরিক হবসবম অফুরন্ত যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসসম্মত একটি হিসেব দিয়ে দেখিয়ে দেন, বিশ্বায়ন-পরবর্তী ভীষণরকম ঘনসন্নিবিষ্ট একটি দুনিয়ায় 'আতঙ্ক' এবং আধুনিক সামরিকতা কোনদিকে এগোচ্ছে। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের সামান্যতম সম্ভাবনাও বিশ্বের অর্থনীতিকে চুরমার করে দেবে, এবং 'ডমিনো এফেক্ট'-এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী এক অর্থনৈতিক ভাঙন নেমে আসবে। ঠিক ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের দিন থেকে এই অর্থনৈতিক ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে গেছে। শ্রেণির পিরামিডের মধ্য থেকে নিম্ন- সব অংশেই হতাশার অশনি সংকেত বেজে উঠেছে।
এরিক হবসবম
তাঁর 'গ্লোবালাইজেশন, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেররিজম' বইতে হবসবম বলেন, "একবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই আমরা এমন এক দুনিয়ার অঙ্গ, যেখানে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড মূলত সরকার বা স্বীকৃত কর্মকর্তাদের হাতে সীমাবদ্ধ নেই, এবং যেখানে যুদ্ধরত দলগুলির মধ্যে হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করার ইচ্ছে ব্যতীত কোনও সাধারণ বৈশিষ্ট্য, স্থিতি বা উদ্দেশ্য নেই। আমরা কেবল চক্রাকারে ঘুরে চলেছি একটিমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, যা হলো আধিপত্য আরোপ করার এক নিরবচ্ছিন্ন বাসনা।" হবসবম এই উপসর্গকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেন, "১৪৯২-এর পর সারা দুনিয়ার নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে, যদিও তাকে সারা দুনিয়ার ওপর ক্ষমতা কায়েম করার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।" একটি প্রজাতি হিসেবে আমরা একটিমাত্র স্বার্থকে ধাওয়া করছি, যাদের আমরা 'দুর্বল' মনে করি, তাদের ওপর দখল কায়েম করে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই ধাওয়া করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা হিংসা ও মানুষের জীবনহানিকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার ভয়ংকর একটি অভ্যেস তৈরি করে ফেলেছি। শাসক বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে বারবার 'কোল্যাটারাল ড্যামেজ' বা 'ছোট ক্ষতি, কিন্তু এর পিছনে বৃহত্তর কারণ রয়েছে'- জাতীয় স্বঘোষিত অজুহাত ও তকমা তৈরি করে হিংসা ও হানাহানিকে দেখার অসংবেদনশীল চোখ তৈরি করে, তা প্রত্যক্ষ করেই একজন আম-মানুষও প্রকাশ্য দিবালোকে হিংসাত্মক আচরণ করার আত্মবিশ্বাস পেয়ে যায়। তারা বোঝে না যে, তাদের এই আগ্রাসনকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র শেষ অবধি অসংগঠিত হিংসাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে পরিণত করবে।
তাই বলা যায়, সত্যিকারের 'ভয়'-এর ধারণা সমাজ থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে। আমাদের একাত্মতা ও পরিচয়ের নিয়ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা খুব সহজেই অনুবাদ করে দেওয়া যায় জাতিবাদ, জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যাকরণে। চেনা পরিচয়ের 'স্বীকৃতি' হারানোর ভয়ে আমরা ক্রমশ ত্রস্ত হয়ে উঠছি। গোষ্ঠীপরিচয়ের সবথেকে ভয়ংকর দিকটিকে মনোবিদরা বলেন নৈতিক প্রত্যাখ্যান, অর্থাৎ অন্যান্য গোষ্ঠীর নৈতিক ও মানবিক অধিকার খর্ব করা, তাদের প্রাপ্য সম্মান ও ন্যায় থেকে বঞ্চিত করা। ফলত, শিক্ষার অধিকার ও শিক্ষালাভের ক্ষমতা, যা দিয়ে কিনা যৌক্তিক চিন্তাধারা ও নির্বাচনের ক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভব, তা থাকা সত্ত্বেও সমাজের একটি বড় অংশ শেষমেশ নিজেদের কিছু মুষ্টিমেয় লোকের দ্বারা সঞ্চালিত হতে দেয়, যারা আমাদের হিংসার হাতের পুতুল করে তোলে। এই হিংসা আদতে ভয়, লজ্জা ও রাগের মতো আমাদের মৌলিক কিছু অনুভূতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন অভিব্যক্তি।
প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর, প্রতিপক্ষ থাকার গুরুত্ব অনুধাবন করতে এটি প্রয়োজনীয়ও বটে। কারণ একমাত্র প্রতিযোগিতার বোধ থাকলে তবেই উন্নতি সম্ভব এবং তা থাকলেই 'দ্বন্দ্ব'-র ধারণা টিকে থাকবে। কিন্তু সমস্যার শুরু তখনই হয়, যখন রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ বিরোধীশূন্য রাজনীতি কামনা করতে থাকেন, এবং 'তাঁদের' যাপনের কাঠামোকে জারিত করতে থাকেন সাধারণের মধ্যে। জনপ্রতিনিধিরা যদি বারংবার এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে থাকেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই রোজকার জীবনেও বিরুদ্ধমতের প্রতি আমাদের মনোভাব একইরকম অসহিষ্ণু ও অস্থির হয়ে উঠবে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও মতামতের সহাবস্থান মেনে নেওয়ার অপারগতা শুরু হয় পরিবার থেকেই। রোজকার জীবনের সাধারণ কাজকর্ম ও আচার-আচরণের মধ্যেই ফ্যাসিবাদের চিহ্ন ও ছায়া পরিণত হতে থাকে, অঙ্কুরিত হয় স্বৈরাচারের বীজ। আমাদের সবার পরিবারেই এমন একজন থাকেন, যিনি তাঁর জীবনের কোনও না কোনও সময় 'তাঁর যাপন' অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং যে তা অগ্রাহ্য করেছে, যুক্তি ও প্রশ্ন তুলেছে, তার প্রতিরোধকে হয় জবরদস্তি, অথবা অন্য কোনও উপায়ে তাকে কবর দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যেমন, হয়তো এমন মাত্রায় মগজধোলাই করা হয়েছে, ফলে যে প্রতিবাদী, সে তার যুক্তিবোধ ও ব্যক্তিসত্তা ফিরে পাওয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশ্বের দাবার ছক থেকে বড় ঘুঁটিগুলিকে সরিয়ে ফেলে তাদের পরস্পরের প্রতি আগ্রাসী আচরণকে স্থগিত রাখা যাক। ফুটবল দলের অনুগামীদের পরস্পরের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের কথা মনে করা যাক। বিভিন্ন ফুটবল দল/ক্লাবের অনুগামীদের মধ্যে মারদাঙ্গার এমন অসংখ্য নজির আছে, যেখানে গুরুতর শারীরিক আঘাত অবধি জল গড়িয়েছে। একটি সহজ খেলা, যার উদ্দেশ্য একটি সহজ প্রতিযোগিতা তৈরি করা, দর্শকদের বিনোদন দেওয়া, শরীর ও মনের ব্যায়াম করানো, জীবন গড়ে তোলা এবং যেখানে খেলাধুলোর অন্তরের ঐকতানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল 'কোনওভাবেই কোনও জীবিত প্রাণীর ক্ষতির কারণ না হওয়া', সেখানে সেই খেলাটিও আমাদের প্রজাতিকে শান্ত করতে পারে না। এভাবেই সুস্থ প্রতিযোগিতার সীমারেখা অতিক্রম করে গঠনমূলক সমালোচনা অশ্লীল বাগযুদ্ধে পরিণত হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সাধারণ ক্রিকেট খেলা ক্রমান্বয়ে দুই দেশের ক্রিকেট-অনুগামীদের গভীরে প্রোথিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনকে প্রকট করে তোলে, যা কিনা শেষ অবধি হিংস্র মোকাবিলার নেশাকেই প্রতিষ্ঠা করে। তাই আমরা যদি ফুটবল বা ক্রিকেটের সাধারণ একটা খেলাতেই সীমা ছাড়িয়ে ফেলি, তাহলে জাতিরাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক বিভাজনের প্রেক্ষিতে কী করবে, তা অনুমেয়, বিশেষ করে যখন সেখানে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং 'ক্ষমতা'-য় থাকার নেশার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।
১৯১৪ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে নানাভাবে যে হিংসার উগ্র প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, সেই ইতিহাসের কিছু সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত মনে করা যাক। ১৯১৪ থেকে ১৯৪০-এর শেষ ভাগ অবধি যে টানা অস্থির হিংস্রতার উত্থান ও অমানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গিয়েছিল, তার ওপর আলোকপাত করেছেন হবসবম। এটি ছিল দু'টি বিশ্বযুদ্ধ এবং তাদের বৈপ্লবিক ফলাফলের যুগ, এবং একই সঙ্গে হিটলার ও স্তালিনের যুগও বটে। একদিকে ছিল ভয়াবহ হলোকাস্ট, 'গ্রেট পাৰ্জ' বা 'মহা নিষ্কাশন'-এর নামে লক্ষ লক্ষ ইহুদির নিয়মমাফিক হত্যা, অন্যদিকে এই সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যুর হার পৌঁছে যায় বারো লক্ষর কাছাকাছি, সেভলদ মায়ারহোল্ডের মতো শিল্পীদের গ্রেপ্তার ও অত্যাচার করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
১৯১৯ সালের ৫ এপ্রিল, পৃথিবী সাক্ষী থাকে পিনস্ক হত্যাকাণ্ডের, যেখানে পোলিশ সৈন্যদল ৩৫ জন ইহুদিকে প্রকাশ্যে হত্যা করে। একই বছর ১৩ এপ্রিল, অমৃতসরে কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ-ভারতীয় সৈন্য দলের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ভারতীয়দের গণনিধনের সন্ত্রাস গুঞ্জিত হয় জালিয়ানওয়ালাবাগের দেওয়ালে দেওয়ালে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একদিকে পশ্চিমের দেশগুলিতে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অত্যাচারী কর্মীদের উত্থান দেখা যায়, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে দেখা যায় ঐতিহাসিকভাবে অভূতপূর্ব সামরিকতন্ত্রর জোয়ার এবং নাগরিকদের বিরুদ্ধে তাদের কলঙ্কিত যুদ্ধ। মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় নয়ের দশকে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্দীপ্ত ধর্মীয় সংঘাত ক্রুসেড-যুদ্ধে মেতে ওঠা পরস্পরবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলির ধর্মীয় মৌলবাদী আদর্শে আরও জোর পায় বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। অন্তর্দেশীয় বা রাষ্ট্র-প্রণোদিত যুদ্ধবিগ্রহের রক্তক্ষরণ ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে এই সময় একের পর এক ঘটে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ১৯৭০-এ আফ্রিকা ও আফগানিস্তানের বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার পরোক্ষ লড়াই, ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-বাংলাদেশ ও ইরাক-ইরান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এর পাশাপাশি আসে অগুনতি গেরিলা যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদী দলগুলির উত্থান, আত্মঘাতী বোমাবাজদের আবির্ভাব এবং আরও সাম্প্রতিক তালিবানদের হাতে আফগানিস্তানের পতন, ইথিওপিয়া, কাশ্মীর, মায়ানমার, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ইত্যাদি এলাকায় সন্ত্রাস এবং সদ্য ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ। এছাড়াও, অসংগঠিত অপরাধের খতিয়ান দেওয়া শুরু করলে শেষ করা যাবে না, কু ক্লাক্স ক্লানের সন্ত্রাস থেকে শুরু করে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্রশস্ত্রের অধিকার বিষয়ক অদ্ভুত ও ক্ষতিকর আইনের কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে বন্দুকবাজের হামলার একের পর এক ঘটনা, বা ভারতে অতি-দক্ষিণপন্থী দলগুলি ও অন্ধবিশ্বাসী উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের দ্বারা জনরোষে হত্যা ও হনার কিলিং বা পরিবারের সম্মানরক্ষার্থে হত্যার দৃষ্টান্ত- সবই এর অন্তর্গত।
ইতিহাসের সবথেকে ভয়ংকর পারমাণবিক বিপর্যয়গুলির অন্যতম চেরনোবিল বিপর্যয়, যার পরিণামস্বরূপ একটি শহরের একটি গোটা অংশ আজ অবধি বিকিরণের কারণে বসবাসের অযোগ্য, তা ঘটেছিল আজ থেকে বহু দশক আগে ইউক্রেনের সোভিয়েত-সমাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের উত্তরাংশে। সেই সময় ইউক্রেন ও রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ হিসেবে সংযুক্ত ছিল, যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বিপর্যয়ের সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বহু বছর পর, রুশ সৈন্যবাহিনী ও ইউক্রেনীয় সৈন্যবাহিনীর তীব্রতম সংঘাতগুলির একটি সংঘটিত হয় চেরনোবিলের এই অভিশপ্ত, পাণ্ডববর্জিত এলাকায়, যা কিনা এখনও সেই পারমাণবিক বিকিরণের ইতিহাস বহন করে চলছে, যার দায় দুই দেশের উপরেই বর্তায়। প্রাচীন কালে মানুষ যখন নতুন পরিবেশে ঘোরাফেরা করত, সে অজানাকে ভয় পেত। কিন্তু এখন সে চেনা জিনিসে ভয় পায়। হিংসা বা হিংসার সমার্থক অভিব্যক্তির আলোচনায় দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে সামান্যতম তুলনা টানলেও দুই পক্ষেরই স্বচিত্রিত সত্যের বয়ান ধাক্কা খায়। হিংসার প্রকাশ যে আদতে সব দ্বন্দ্বরত তত্ত্বকেই এক সূত্রে গেঁথে রাখে, এবং একই তরিকায় সন্ত্রাস কায়েম করার সর্বগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীতে অর্থপূর্ণ বদল আনার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ানোয় অবশেষে যে বিশ্বাস ও উদ্দেশ্যের সব তফাৎ তুচ্ছ হয়ে যায়, সেই সারসত্যের উপলব্ধি থেকে এদের আড়াল করে রাখে এই মিথ্যে বয়ান।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের ছবি
রামচন্দ্র গুহ তাঁর একটি সাম্প্রতিক লেখায় কর্তৃত্বের প্রতি এই নেশার বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে লেখেন, "আমেরিকানরা ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যায়। আঠাশ বছর পর, ২০০৩ সালে তারা ইরাক আক্রমণ করে। সোভিয়েত সেনা ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ত্যাগ করে। তেত্রিশ বছর পর ২০২২-এ রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করে। প্রতি ক্ষেত্রেই বিস্মরণের জন্য যথেষ্ট সময় কেটে গেছে, ইতিমধ্যে মানুষ এবং রাষ্ট্রনেতারা ভুলে গেছেন আগের অভিযানের শেষটুকু কতটা খারাপ ছিল, এবং এক নতুন প্রজন্ম বড় হয়েছে যাদের এমনভাবে মগজধোলাই করা সম্ভব হয়েছে যে, তারা মনে করে, অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করা তাদের দেশের জাতীয় স্বার্থ।" এইভাবে, আমেরিকার আরও বেশি দেশকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বের 'মার্কিনিকরণ'-এর নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাই হোক বা রাশিয়ার প্রবল অহমিকা এবং নিজেকে ইউক্রেনের 'ত্রাতা' ছাড়া অন্য কোনও ভূমিকায় কল্পনা করার অক্ষমতাই হোক- কিছু দিয়েই ইউক্রেনের ওপর অমানবিক আক্রমণকে বা দুই দেশেরই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে ন্যায্য বলে প্ৰমাণ করা যায় না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলা
যদি যুদ্ধবিগ্রহ জৈবিক প্রয়োজনীয়তা না হয়ে নেহাৎ মানুষের তৈরি পন্থা হয়ে থাকে, তবে এর পিছনের কারণকে চিনে নেওয়ার এটাই আদর্শ সময়। ভয় আমাদের যৌক্তিক চিন্তাকে অসাড় করে তোলে, যা শেষ অবধি আমাদের নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক সরকারকে সাহায্য করে আমাদের ব্যক্তিসত্তার গরিমাকে একটিমাত্র ভোটের অঙ্কে সীমাবদ্ধ করে দিতে। আমরা কি স্রেফ 'ভয়ের প্রতি ভয়'-কে ভয় পেয়ে আমাদের শিক্ষা, বিবেক ও চেতনাকে বলি দিচ্ছি? পূর্বতন মার্কিন জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা জেবিগনিউ ব্রজেজিনস্কি বলেছিলেন যে, বুশ শাসনকাল এবং ইরাক যুদ্ধের সময় 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শব্দটির ব্যবহার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি সন্ত্রাসের সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে চালিত হয়েছিল, যাতে যুক্তিবোধকে ঘেঁটে দেওয়া যায়, আবেগকে তীব্রতর করে তুলে ক্ষমতাকামী রাজনীতিবিদদের নিজেদের নীতি কায়েম করার সুবিধার্থে জনতাকে একমুখীভাবে চালিত করার পথ সুগম হয়। হিংস্র নাৎসি নেতা হেরমান গোরিং একবার ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, কীভাবে ভয় দেখিয়ে মানুষকে এমন একটি যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য করা যায়, সাধারণভাবে তারা যার বিরোধিতা করত। তিনি বলেছিলেন, "মানুষ যুদ্ধ চায় না। কিন্তু তাদের যে-কোনও সময় নেতাদের খেলায় হাজির করা যায়। তাদের শুধু বলতে হবে যে, তারা আক্রান্ত, শান্তিবাদীদের যথেষ্ট দেশপ্রেম নেই এবং তারা দেশকে বিপদের মুখে ফেলে দিচ্ছে; এই বলে বাতিল করে দিতে হবে। সব দেশে এই পদ্ধতি একইভাবে চলে।"
ফুরেদির যুক্তি, নৈতিক কর্তৃত্বর প্রকাশ ভীতির সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। ভয় আপাতভাবে নৈতিক অনিশ্চয়তার একটি সাময়িক সমাধান। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী, যতদিন না সমাজ অনিশ্চয়তার প্রতি আরও ইতিবাচক অবস্থান নেবে, ভয়ের রাজনীতিকরণ ঘটেই চলবে। আমরা আক্ষরিক অর্থেই এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যা এই গ্রহে আমাদের অস্তিত্বের নিয়তি নির্ধারণ করবে। এহেন অবস্থায় আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে আমরা ভয়ের সংস্কৃতিকে সেই ক্ষমতা দেব কি না, যাতে সে আমাদের সেই বোধের দরজা বন্ধ করে দিতে পারে, যে বোধ আমাদের মানুষ করে তোলে। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে যে, আমরা ভয়ের সংস্কৃতিকে সেই ক্ষমতা দেব কি না, যাতে সরকার আমাদের ভেলকি দেখিয়ে বিশ্বাস করিয়ে দেবে যে, তাদের দেওয়া বিকল্পগুলির একটিতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই, না কি আমরা সেই ক্ষমতার আশ্রয় নেব, যা আমাদের অন্যান্য প্রজাতির থেকে আলাদা করে তোলে? তা আর কিছুই নয়, আমাদের চেতনা, পরিবর্তনের ক্ষমতা এবং অন্যান্য মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষমতা। আমাদের বর্তমান সময়ের অন্তঃসারশূন্যতাকে উপলব্ধি করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় ৪০০ শিশু নিহত হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, আফগানিস্তান ও কাশ্মীর আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং আমাদের দেশে আবারও ধর্মীয় আবেগের প্রতি ভয়ের ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলছে, ভীতিপ্রদর্শনের ওপর নির্ভর করে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলি রোধ করে আমাদের বহুত্বের ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এই নিয়মমাফিক সাজানো ভয়ের ফাঁদে পা দেওয়া থেকে পরস্পরকে বাঁচাতে যেটুকু করা যায়, আমাদের প্রত্যেককে সেটুকু করতে হবে।
এই কাতর সময়ে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে উইলফ্রেড ওয়েনের 'স্ট্রেঞ্জ মিটিং' নামক একটি কবিতা, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। কবিতাটি বলছে একজন সৈন্যর কথা, যার আগের দিন তার হাতে নিহত বিপক্ষ দলের এক সৈন্যর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কবিতার শেষ কয়েকটি পংক্তি হল,
আমিই সেই শত্রু যাকে তুমি হত্যা করেছিলে, বন্ধু।
তোমাকে এই অন্ধকারেও আমি চিনেছি, কারণ তুমি কালকে
আমাকে বারবার আঘাত করে খুন করার সময়
ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছিলে
যখন আমি তোমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম;
কিন্তু আমার হাতে জোর ছিল না, হাত ঠান্ডা হয়ে এসেছিল।
এসো, আমরা এবার ঘুমোতে যাই...
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
সঙ্গে রইল মূল ইংরেজি লেখাটি:
Fear is at its most fearsome when it is diffuse, scattered, unclear, unattached, unanchored, free floating, with no clear address or cause, when the menace we should be afraid of can be glimpsed everywhere but is nowhere to be seen. ‘Fear’ is the name we give to our uncertainty, to our ignorance of the threat and what is to be done.
-Zygmunt Bauman.
Frank Furedi, the Hungarian-Canadian academic and emeritus professor of sociology quoted the above mentioned thought of the polish sociologist and philosopher Zygmunt Bauman, in his book ‘How Fear Works’ where he analyses the culture of fear engulfing the world of the twenty first century. Fear is one of our primary emotions, driving compass for human beings Culture of Fear through centuries is a dictator of moral codes, a catalyst for inventions and survival and at times a powerful tool that is used for mass manipulation. Furedi quotes in his book that behaviours signalling fear are not always a direct reaction to physical threats, Aristotle pointed out that many of our most troubling fears are related to losing face and being disgraced or suffering slights to our reputation.
We are living in a world which is paranoid , paranoid of feeling invalidated in an increasingly fragmented and polarized society. Stories, conditions and nature of fear has also evolved along with civilization’s innumerable stages of metamorphosis. Fear has shifted it's address from ‘fear of death’ to ‘fear of God’ to ‘fear of fear itself’, but amidst all these stages what remained constant is the politicization of ‘fear’. ‘Violence’ and ‘fear’ at times are like conjoined twins. Violence is an almost ineradicable human instinct, the scientific and biological roots of which are still researched upon. Initially, the expression of violence came from a sense of danger, from the fear of unknown in a newly developing planet, a sense of setting establishment and combatting the discoveries of a new world , but eventually as history unfolded , violence started becoming shapeless , formless , sporadic , stemming from a constant feeling of threat , a threat of being denied the right to ‘belong’ the way we want against the face of our neighbour ,creating this constant apocryphal sense of threat has been one of the most demonic invention of modern day politics.
Roughly, 150,000 years have passed since language came to existence , still, dialogue fails to provide a replacement of our actions containing an uncontrollable desire to inflict pain. Keeping aside the myriad cases of disorganized crime recorded and unrecorded in history , one thing which has remained constant through centuries , ‘war’. Its been five months since Russia is in a state of war with Ukraine and recently the Russian military has full control on the city of Lysychansk and as usual a section of the world continues their ostracization of the truth behind the hollowness of war causing nothing but an unending loss of human life, its essential to discuss and remind ourselves about a brief history and psychology of warfare. The reason and psychology behind human being’s unquenchable thirst of engaging into war has been a widely discussed , researched and debated topic for psychologists, historians, sociologists , philosophers and anthropologists. Is it something embedded in our genes , something we have been practicing right since the birth of human civilization? There are no concrete answers to these questions yet, but there are some studies which helps us with a little more concentrated understanding towards our past.
Sapiens and their consciousness crystallized as a result of evolution in a planet which they were scarcely aware of , eventually they discovered fire, learnt to combat hunger , plagues, natural disasters. Almost like watching a conjurer, we spectated in awe man’s advance in medicine , steering rockets, power of resistance and ability to convey thoughts in the most creative and inimitable ways. But amidst all the wonders of man and his multifaceted personalities, one day he met his ‘Eureka’ moment discovering this insatiable desire of rejecting to coexist . Perhaps this statement or thought ends up becoming a simplification of an issue or multitudinous issues agonizing the world ,but, its almost impossible to ignore a pattern in the expression of human violence , particularly when it comes to the situation of the inability to coexist and warfare. Drawing reference from Steve Taylor , a senior lecturer in psychology at Leeds Beckett University , books on world history usually begin with the civilizations of Egypt and Sumer , which arose around 3000 BC. From that point until today , history is a little more than a catalogue of endless wars. Between 1740 and 1897 there were 230 wars and revolutions in Europe and the 20th and the 20th century saw both the world wars , since then till now as 21st century progresses the fate of human civilization is becoming increasingly dismal . As a result of the venomous burden of our deeds the beautiful and rare balance and phenomenon of supporting life on this planet has become tumultuous , nature is and will revolt more till we become a ghost to the earth and the earth becomes a ghost to us , yet , in a time of global hunger crisis , unending poverty , pandemics and a planet on the brink of collapse , the fortune of war is still dazzling and countries are bankrupting themselves with their military expenditure.
The first solid evidence of lethal group violence among our ancestors dates back to not millions , hundreds of thousands , or even tens of thousands of years , but only 13,000 years . The evidence consists of a mass grave found in the Nile Valley, at a location in modern day Sudan . Anthropologist R. Brian Ferguson garnered convincing evidence to show that warfare is only around 10,000 years old . Thus , is war a primordial biological curse or merely a cultural innovation benefitting only an exclusive group of people . The synonyms of the word ‘combat’ keeps on changing. Sometimes we call it ‘war’, sometimes ‘civil war’ or ‘cold war’ or ‘proxy war’ or ‘guerilla war’, sometimes we call it a ‘riot’ or ‘mob violence’. The erudite and estimable historian Eric Hobsbawm gives us an account of the history of unending warfare and tells us where ‘terror’ and modern warfare is heading in a world post globalization, a world which is heavily integrated. The slightest chance of another world war will shatter the world economy in minutes, as a domino effect will take place, resulting into a global financial breakdown. Right from the day of Russian invasion in Ukraine, the economic carnage has begun, ringing the siren despair for all the classes from middle to lower end of the ladder.
Hobsbawm, in his book Globalization, Democracy and Terrorism says, “At the start of the twenty first century we find ourselves in a world when armed operations are no longer essentially in the hands of the governments or their authorized agents, and where contending parties have no common characteristics, status or objectives, except the willingness to use violence. We are merely moving in circles, with only one motive, the constant desire to impose supremacy. Hobsbawm articulates this syndrome, “A global reach became possible after 1492 , but that should not be confused with global domination”. The only thing as a species we’re after is establishing a global supremacy by taking over whom we perceive ‘weak’. Thus, in the process of doing so, we’ve given birth to a dangerous habit of justifying violence, justifying loss of human life. Witnessing the political parties’ (ruling or opposition) repeated actions of treating violence and manslaughter insensitively by developing self-proclaimed excuses and tags like ‘collateral damage’ or ‘its ultimately for a cause’ has given the public the confidence to practice violence in broad daylight, starting from incidents spanning from mild to extreme, without them realizing that their aggression will be ultimately used by the state, turning disorganized violence into a state sponsored one.
So can we say that the idea of true ‘fear’ is being eradicated from the society or we are increasingly becoming paranoid because of the fear of losing ‘validation’ , because as a species we have a constant need for belonging and identity which can easily manifest itself into ethnicism , nationalism or religious dogmatism . One of the most dangerous aspects of group identity is what psychologists call moral exclusion which happens when we withdraw moral and human rights to other groups and deny them respect and justice . So ,a large section of the society inspite of having the right and access to education which prompts rational thinking and gives us the power of making a choice ultimately falls short by allowing ourselves to get manipulated by a handful of people which makes us marionettes in the hand of violence , violence which is an expression formed due to an amalgamation of our basic emotions consisting of fear , shame and anger.
A competition is healthy, its essential to realize the necessity of having an opposition, because that’s the only way progress happens, because of the existence of the idea of ‘conflict’. But the problem arises from the time when world leaders or political parties started desiring an opposition-free politics and by trying to constantly establish the process of homogenization of ‘their’ way of living. If this example is set time and again by public representatives, it’s only expected that we would turn intolerant and volatile towards differing opinions in our day to day lives. The inability to accept co-existing opinions and the struggle to establish supremacy starts within our family. The signs and shadows of fascism starts developing and showing symptoms amidst the regular mundane activities and gestures of daily life. We all have that one person in a family who at some point of their life attempts to establish ‘their way’ of living on others and when someone becomes defiant and tries to reason and question, the expression of defense from the other end will either come by using ‘force’ or by finding other ways like indoctrinating one to the extent where the subject will lose the ability to restore the quality of rationalization and individuality.
Let’s keep aside the big chess pieces off the world board for a moment and pause their acts of hostility towards each other. Let’s recall the violence practiced amongst fans of a football team. There are innumerable instances of physical abuse between fans of different football teams/clubs which has resulted in serious physical injury. A simple game, the aim of which is to simply generate a healthy competition, entertaining the spectators, exercising the body and mind, developing life skills and one of the most important criteria of the Sport Accord ‘be in no way harmful to any living creature’ can’t placate our species. Thus the line of a healthy competition is crossed , constructive criticism turns into lewd verbal war and a simple cricket match between India and Pakistan eventually unveils the deep rooted political and religious differences embedded within the cricket fans of both the countries, ultimately establishing the addictive urge for violent confrontation. So, if we cross a line in a simple game of football or cricket , then what can nations do to each other on the basis of political differences, that too where personal economic prosperity and the addiction of being in ‘power’ is involved.
Let us recall a brief account of the history as well as the ongoing violence raging across the world in various forms since 1914.
Hobsbawm’s sheds light on the rise of continuous and uneven barbarism, the peak of inhumanity between 1914 and the late 1940s, in the era of the two world wars and their revolutionary aftermath, and of Hitler and Stalin. From the blood curdling Holocaust, executed by Adolf Hitler and the Nazi Party, the systematic murder of millions of Jews to the ‘Great Purge’, a time when the death toll in Soviet Union rose up to more than one point two million, times when groundbreaking artists like Vsevolod Meyerhold was arrested tortured and executed.
On April 5 1919, one part of the world witnessed the Pinsk Massacre, the mass execution of thirty-five Jews by the Polish army and on April 13th in Amritsar, the horror of the mass massacre of Indians by the British Indian Army unit led by Colonel Reginald Dyer echoed the walls of Jallianwala Bagh. In the West, the period between 1960 to 1985 saw the rise of officially trained torturers and a historically unprecedented wave of military regimes in Latin America and the Mediterranean waging ‘dirty wars’ on their citizens. The sheer scale of human suffering increased dramatically in the 1990s, religious wars fueled up by secular ideologies were reinforced with, or replaced by, a return to various brands of crusading and counter – crusading religious fundamentalism. The bloodshed and destruction of inner-state or state sponsored warfare continued, the Vietnam war, the indirect super power confrontations of the 1970s in Africa and Afghanistan, the Indo- Pakistan, the Pakistan – Bangladesh and Iraq-Iran wars. Along with this came innumerable guerilla wars, rise of terror groups, the introduction of the suicide bomber and presently the fall of Afghanistan in the hands of Taliban, terror in Ethiopia, Kashmir, Myanmar, Algeria, Tunisia, Libya, Yemen, Syria and recently the Russian invasion in Ukraine. Apart from these, the account of disorganized crime will be unending, starting from the terrors spread by the Ku Klux Klan to the murder of George Floyd or a series of mass shootouts in the United States in 2021 and 2022 because of the US’s bizarre and draconian law of the right to posses arms and ammunitions or the mob lynching and honor killings in India carried out by ultra-right groups and upper caste fanatics.
The Chernobyl disaster, one of the worst nuclear disasters in history, which permanently led a section of the city abandoned till date due to an immense amount of radiation, took place decades back in the North of the Ukrainian SSR, a time when Ukraine and Russia were tied under the Soviet Union, the same Soviet Union which tried to bury the truth behind the catastrophic nuclear disaster. Years later, one of the worst combats between the Russian army and Ukrainian army took place in the Chernobyl exclusion zone, a place which still holds the history of radiation for which both the countries were responsible. In the beginning, as man wandered around a new surrounding, he feared the unknown, but today, he fears the known. The slightest comparison drawn between opposing parties while talking about synonymous expression of violence jolts their self-created version of truth , which masks them away from realizing that the expression and method of conducting violence unites all the conflicting theories, where the differences in beliefs and intents eventually become insignificant because of the over shadowing desire to practice violence in an identical way, leading to a global failure of bringing impactful change.
Ramchandra Guha provided an account of this obsession of supremacy in one of his recent articles where he states, “The Americans exited Vietnam in 1975 , they invaded Iraq in 2003, twenty-eight years later. The Soviet Army exited Afghanistan in 1989, the Russian army invaded Ukraine in 2022, thirty-three years later. In each case, enough time has passed for amnesia to set in, for people and leaders to forget how badly the previous misadventures had ended, for a new generation to come of age which could be brainwashed into thinking that it was their country’s national interest to go to war with another”. Thus, whether it is America’s continuous effort to ‘Americanize’ the world, an effect of which is to put more countries under the NATO or Russia’s enormous ego and inability to stop identifying itself as the ‘liberator’ of Ukraine, nothing justifies this barbaric attack on Ukraine, nothing justifies the suffering of the civilians of both the countries."
If warfare is only an invention and not a biological necessity ,then its high time to realise the causes behind it. Fear is paralyzing our rational thinking which is ultimately helping the governments , our manipulators ,to redeem our pride of individuality down a to a just a mere vote. Are we allowing our education , conscience and consciousness to get compromised because of our fear of fearing fear ? Former US National Security Advisor Zbigniew Brzezinski said that the use of the term ‘War on Terror‘ during the Bush administration and Iraq war was intended to generate a culture of fear deliberately because it obscures reason, intensifies emotions and makes it easier for demagogic politicians to mobilize the public on behalf of the policies they want to pursue. The barbaric Nazi leader Hermann Goring once explained how people can be made fearful and to support a war they otherwise would oppose , he said,
The people don’t want war , but they can always be brought to the bidding of the leaders, all you have to tell them is that they are being attacked and denounce the pacifists for lack of patriotism and for exposing country danger , it works the same way in every country.
Furedi argues that one of the main drivers of culture of fear is unravelling of moral authority . Fear appears to provide a provisional solution to moral uncertainty . He predicts that until society finds a more positive orientation towards uncertainty the politicization of fear will flourish . As we stand in the beginning of an epoch which will literally decide the fate of our existence on this planet , we need to question ourselves , should we allow the culture of fear to mute our senses which makes us human and allow our governments to legerdemain us into believing that we need to resort to the choices they offer or we should fall back on what seperates us from the rest of the species , our consciousness and power to change and educate our fellow beings . Lets realise the hollowness of our times , almost 400 children were killed and injured in the Russia Ukraine war , millions are homeless due to the war in the middle east , Afghanistan and Kashmir are once again in Darkness and our country is again harping on fear of religious sentiments to create a divide in our communal harmony, trying to erase our history of diversity by playing the fear card by silencing voices of dissent, lets do our bit to prevent each other from falling in trap of this systematically designed web of fear.
This harrowing time reminds me of a poem by Wilfred Owen, 'Strange Meeting', written against the backdrop of the atrocities of the first world war, a poem narrated by a soldier who meets the enemy soldier whom he killed the day before. The poem ends with the lines,
I am the enemy you killed, my friend.
I knew you in this dark: for so you frowned
Yesterday through me as you jabbed and killed
I parried; nut my hands were loath and cold.
Let us sleep now...