বাংলা গানের পাশে দাঁড়ানোর প্রলাপ বৃথা

কোনও বাঙালি উদ্যোগপতি (যদি আদৌ থেকে থাকেন কেউ) কি উৎসুক, বাংলা গানের অ্যালবাম কিংবা মঞ্চানুষ্ঠানে টাকা ঢালতে? যদি না-থেকে থাকেন, কার ভরসায় চলবে বাংলা গান? পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ভরসায়?

গেল শতকের তিনের দশক। রবীন্দ্রনাথ সত্তর ছুঁয়েছেন, বীরবিক্রমে জাতীয় রাজনীতির চালচিত্রে আগুয়ান সুভাষচন্দ্র বসু। হিন্দু আর মুসলমানের সম্প্রীতির খোয়াব মুছে যাচ্ছে ক্রমশ, দ্রুত আদল পাচ্ছে দেশভাগের চাপা আকাঙ্ক্ষা, উল্কার মতো উঠে আসছে কৃষক-প্রজা পার্টি, আসন্ন নির্বাচনেও তাক লাগিয়ে দেবে তারা। গোটা ভারতব্যাপী কোনও সংহত, শৃঙ্খলিত জাতীয়তাবাদী কল্পনা প্রায় অস্তমিত। ইতিহাসবিদরা মোটামুটি একমত: রাজনীতির চশমায় দেখলে, এ হলো সেই সময়, যখন ‘মাস’ হয়ে উঠছে নয়া রাজনীতির অমোঘ ভাগ্যবিধাতা— চালু হচ্ছে মাস পলিটিক্সের যুগ। আ-ভারত বিস্তৃত কোনও ‘একটিই মাত্র’ জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের বদলে, স্ফূরণ ঘটছে বিভিন্ন প্রদেশভিত্তিক জাতিসত্তার। ভাষা— তার অন্যতম নিয়ন্ত্রক।

এ হলো সেই সময়, যখন মধ্যবিত্ত প্রথম আস্বাদ পাচ্ছে আধুনিকতার। একটু খোলসা করা দরকার বোধ হয়—এ-আধুনিকতা কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শ নয়। উনিশ শতকের পাটোয়ারি ছকে এই আধুনিকতার ঠিকানা মিলবে না। বরং, সত্যজিৎ রায়ের আত্মকথা, ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ থেকে থেকে জানান দেয় আধুনিকতার এই রং আর গন্ধ— যখন বাঙালির মধ্যবিত্ত ঘরে ঢুকছে বাহারি ল্যাভেন্ডার সাবান, হেঁশেলে লিপটনের চা, বৈঠকখানায় গ্র্যান্ড পিয়ানো। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর গেরস্তঘরে থাকে ভেনেশীয় খড়খড়ি, মেঝেতে মোজাইক। আর, সেই সুবাদেই, আরও দু'টি জিনিস ক্রমশ ছেয়ে ফেলছিল বিশ শতকের বাঙালি ভদ্রলোকের পণ্যজগৎ। এক, গ্রামোফোন, এবং, দুই, রেডিও।

ধান ভানতে শিবের ভণিতা করতেই হলো। বস্তুত, বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে পণ্যের এই প্রভূত ব্যাপকতা না-খেয়াল করে, বাংলা গানের বাজার নিয়ে কোনও অনুসিদ্ধান্তে আসাই যাবে না। বিশ শতকের গোড়া থেকেই তার সামনে খুলে যাচ্ছিল একের পর এক শ্রুতিমাধ্যমের জানলা— গান আর অন্তর্মুখী, নিভৃত বেদনার বিবৃতি থাকছিল না মোটেই। রবীন্দ্রনাথ ‘আমার কী বেদনা সে কি জানো, ওগো মিতা সুদূরের মিতা’ লিখছেন ১৯৩৫ সালে, আর, তার প্রায় আট দশক পর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় আচমকা খেয়াল করছেন, বিজয়া চৌধুরী-র সিলেটজীবনের স্মৃতিকথায় ওই গানের টাটকা উল্লেখ। অস্যার্থ: পুঁজির বুনিয়াদি ধর্ম মেনে, গানও গতিশীল হয়ে উঠছে ক্রমশ। রবীন্দ্রনাথ—যিনি তাঁর গানের বাজারমূল্য নিয়ে চিন্তিতই ছিলেন না কোনও দিন, গান বেচে যাঁকে চালাতে হয়নি ঠাকুরবাড়ির সংসার, এমনকী, বাজার-প্রণোদিত রবীন্দ্রগানের নমুনায় যিনি শেষ জীবনে ক্রুদ্ধ, মায় বিমর্ষ— বাজারের বিচিত্র দশচক্রে তিনিও ‘ভূত’ হয়ে উঠছিলেন কালে-কালে। কর্তার ওই প্রচ্ছন্ন ‘ভৌতিকতা’-র টানেই, লাইভ পারফরমেন্সের এত কালের কেজো নিগড় ভেঙে, বিশ শতকের তৃতীয় দশক-বরাবর, গান ক্রমে সমর্পিত হতে থাকল বাজারি খদ্দেরের হাতে।

আরও পড়ুন: সুশান্ত থেকে কে কে- আমাদের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তের প্রতিশোধ

এ-হেন বাজারিকরণের ইতিহাস দীর্ঘ, বিচিত্র। তার সঙ্গে আষ্টেস্পৃষ্টে ছিল গানের জনসমাজ, বা পাবলিক লাইফ গড়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। সেই হয়ে-ওঠার এক দিকে আকাশবাণী কিংবা বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানের রমরমা, আর অন্য দিকে, প্রযুক্তির প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানবাজনার দিগন্তে একঝাঁক দক্ষ গীতিকার-সুরকার-যন্ত্রীর অভূতপূর্ব আবির্ভাব। গান আর একটি নিটোল ‘গান’ থাকল না যেন। ছড়িয়ে গেল ‘কথা’, ‘সুর’, ‘বাজনা’-গোছের নানা অণু-বর্গে, শ্রমবিভাজনের কেতাবি সূত্র অনুযায়ী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকল রুচিশীল এক উপভোক্তা সম্প্রদায়, যাঁদের কাছে বাংলা আধুনিক গান শোনা, হয়ে উঠল, কালচারাল ক্যাপিটালের আত্ম-বিজ্ঞাপন। তার আগে অবস্থাটা এরকম ছিল না মোটেই। বস্তুত, রামপ্রসাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, বাংলা গানের আবহমান ধারায়, গান লেখা হত, মূলত, গান-রচয়িতার তদ্গত ভাবের উৎসারণ হিসেবে। উল্লেখ্য, ‘আমাদের সংগীত’ নামের এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে যখন গান ডালপালা মেলল, সেখানে কথা আর সুর এল মিতালি পাতিয়ে, ‘গলাগলি করে’।

প্রযুক্তিপটে আমূল বদল এসে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আর সেরকমটা রইল না। নতুন আমলে এখন বাজারের ফর্দ মেনে শ্যামাসংগীত লেখা হয়: কথা ও সুর জোগান নজরুল, গান করেন কে মল্লিক। সঙ্গে থাকেন নামহারা অগুনতি বাদ্যযন্ত্রী। এই চার আয়ুধেই সেজে উঠছিল বাংলা গান, যাকে বলে ‘বেসিক গান’-এর শরীর— গান সেখানে নিঃশর্ত দায়বদ্ধ একমাত্র ‘মাস’, অর্থাৎ তার ভোক্তার কাছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল আগে, ‘প্রাদেশিক ভাষা’-য় আধুনিক গানের এই বোলবোলাও ছিল একরকম ‘নিজস্ব’ আধুনিকতারই সন্ধান, যার মীমাংসা আর করা যাচ্ছিল না পল্লিগান বা মার্গসংগীতের প্রচলে। এই আধুনিক গানের ভাষা বাংলা— কিন্তু, পরিখা-কাটা কোনও বাংলাপনার কাছে এই গান দাসখত লেখেনি। অবশ্য, আত্মশ্লাঘার কোনও দুর্বল মুহূর্তে এ-কথাটাও মাথায় রাখা ভাল, যে, বেসিক গানের এ-হেন ঐতিহ্য কেবল বাঙালিরই একচেটিয়া ছিল না। অসম বা উড়িষ্যার মতো বাংলা-সংলগ্ন বিভিন্ন প্রদেশে স্বভাষিক গানের একটা স্বতন্ত্র বাজার ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রমশ, স্বকীয় গানের আলাদা শ্রোতৃমণ্ডলী ছিল পাঞ্জাবেও।

ভালোই তো চলছিল। অতঃপর, গোলমালটা হল কোথায়?

আট-দশকের মাঝামাঝি, সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদিত 'ধ্রুবপদ' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কবীর সুমন। নাম, ‘আধুনিক বাংলা গান: আকালের সন্ধানে?’ নানা কারণেই প্রবন্ধটি মাইলফলক। সময়টাও স্মর্তব্য। আটের দশক। ধুয়া উঠেছে, বাংলা আধুনিক গান আর নজর কাড়তে পারছে না তার পয়লা খদ্দের, অর্থাৎ শিক্ষিত বাঙালি জনসমাজের। এমনও বলা হচ্ছে, বাংলা গানের এন্তেকাল প্রায় সমাসন্ন। সচকিত গণসমাজ সহসা আবিষ্কার করে বসেছে, তাদের সাংস্কৃতিক পুঁজি-প্রদর্শনের প্রধান একটি ফিকির অভাবিত সংকটের মুখোমুখি।

গানবাজারের চলতি সংকটের আশু নিরসনে ওই লেখায় শনাক্ত করা গিয়েছিল যে দু’-তিনটি কারণ, তার প্রধান: খদ্দের-উপযোগী গানের ভাষার অপ্রতুলতা। অতঃপর, নতুন বাংলা গানের প্রকল্প কী হওয়া উচিত, সে নিয়ে একটা স্পষ্ট দিকনির্দেশও ছিল সেই লেখায়। বলা হয়েছিল, গানকে প্রকৃত অর্থেই হতে হবে আধুনিক— তার বিষয় এবং ভাষার নবীকরণ না-ঘটিয়ে এগোনো যাবে না কোনওভাবেই। যে যুক্তির ছায়ায় সে-দিন ওই প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল, তা আজ কার্যত স্বীকৃত হয়ে গেছে। নয়ের দশকের গানমঞ্চে প্রবন্ধকারের আবির্ভাব এবং সেই গানে নগরবাসী শ্রোতার সাদর অভ্যর্থনা এই ভাষ্যে শিলমোহরও জুগিয়েছিল।

কিন্তু, এই বিশ্লেষণ একুশ শতকের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে পড়লে যতটা তুখড় মনে হয়, ততটাই অসম্পূর্ণ লাগে। সমস্যাটা কেবল গানের আধুনিকীকরণের কি? নিশ্চিতভাবেই, গানের বিষয়, আঙ্গিক, ভাষা— এগুলি সন্দেহাতীত গুরুত্ববহ। কিন্তু, ঘটনা হলো, বাজারের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন কেবলই তার শিল্পমূল্যের ওপর নির্ভর করে না। তার জন্য দরকার হয় পুঁজির তাগদ: অর্থনীতির সচল প্রতিরক্ষা না-থাকলে, যে-কোনও শিল্পেরই মাজা ভেঙে যেতে বাধ্য। এই মুহূর্তে বাংলা গানের প্রযুক্তিগত দৌড় কতটা? পেশাদারভাবে করেকম্মে খেতে পারেন এই ইন্ডাস্ট্রির কত জন? কোনও বাঙালি উদ্যোগপতি (যদি আদৌ থেকে থাকেন কেউ) কি উৎসুক, বাংলা গানের অ্যালবাম কিংবা মঞ্চানুষ্ঠানে টাকা ঢালতে? যদি না-থেকে থাকেন, কার ভরসায় চলবে বাংলা গান? পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ভরসায়?

খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এই প্রবণতা কেবল বাংলা গানের একার বরাতেই জোটেনি। হালে সিনেমা-পরিচালকদের চিৎকৃত স্বরে আহ্বান জানাতে হয়েছে, বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান। সর্বত্র একটা ফিসফাস শুনতে পাওয়া যাচ্ছে: বাঙালি না-কি আর বাংলা গান শোনে না, বাংলা সিনেমা দেখে না, বাংলা ভাষার সঙ্গেই তার মধ্যবিত্ত সমাজের যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। বারংবার, নানা সূত্রে, একই রেটোরিক ঘুরেফিরে আসতে থাকলে জিজ্ঞাসা ওঠা স্বাভাবিক: বিসমিল্লাতেই গলদ থেকে যাচ্ছে না তো কোনও? শিল্পকলা ও বিনোদনের যে রাজ্যভিত্তিক এবং স্বাভাবিক বাজার, তার অবক্ষয় কী জানান দিচ্ছে? প্রশ্ন ওঠা জরুরি: শুধু ‘ভালবাসা’, ‘ভাষাপ্রেম’, ‘শিকড়প্রীতি’-র মতো কতগুলি অন্তঃসারশূন্য, প্রবঞ্চক, এবং অর্থহীন স্লোগান তুলেই কি বাংলা বাজার তার কালাতিপাত করবে? সন্দেহ জাগে, বস্তাপচা কথাগুলির এমন পুনরাবর্তন আসলে নিজেদের অক্ষমতা এবং অপারগতা ভুলে থাকার ছলনা নয় তো?

এই সমস্ত প্রবণতা নির্দেশ করে একটা অভিন্ন অভিমুখেই। তা হল, পুঁজি-দুঃস্থ বঙ্গভূমে আর শিল্পকর্ম সওদা হওয়ার বিশেষ পরিসর টিকে নেই। এখানকার খদ্দেরের না আছে তেমন শ্রমভিত্তিক সঞ্চয় (শাসক দল-আশ্রিত লুম্পেনগোষ্ঠীর বিপুল বিত্তের কথা আলাদা), তার পকেটে টান। উপরন্তু, গানকে ‘আধুনিক’ মোড়কে প্রচারিত করার জন্য দরকার পড়ে যে মৌলিক প্রযুক্তিগত এবং বিজ্ঞাপনী রেস্তের , তা-ও আদৌ বাঙালির হাতে নেই। অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ছাড়া, কেবলই ‘শিল্পে’র দোহাই দিয়ে বাজারের চিঁড়ে ভিজবে কি?

সম্ভবত না। গত কুড়ি-তিরিশ বছরে, গানবাজনার দুনিয়ায় মোদ্দা বদলটা এসেছে প্রযুক্তিতে। সেই সঙ্গে, সম্প্রচার-মাধ্যমে। তিনের দশক থেকে একে-একে গ্রামোফোন, লং প্লে রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডির আমল পেরিয়ে আমরা হাজির ইউটিউবের যুগে। খুলে গেছে সম্প্রচারের অভিনব সব শৈলী, বেড়ে গেছে গানের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের পরিমাণ। অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে উপনীত হয়েছে সংগীত। এই সন্ধিসময়ে দাঁড়িয়ে, নতুনতর সব প্রচারমাধ্যম, কারিগরি দক্ষতা আর যন্ত্রপাতির ওপর বাঙালির দখল কতটা? আদৌ রয়েছে কি?

মাথায় রাখা ভাল, এ কোনও ‘অর্থনীতিই এক মাত্র সত্য’-গোছের স্তালিনবাদী কুসংস্কারের ক্লিশে অনুবর্তন নয়। আসলে, বাঙালি সমাজে হালফিল গতিহীনতা প্রায় সর্বব্যাপ্ত। পুঁজির ধর্ম অস্থিতি, বাঙালির ধর্ম আঁকড়ে-থাকা। মনে পড়ছে, বছর কয়েক আগেই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজারে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করেছিলেন: দিল্লি এই মুহূর্তে ইন্টেলেকচুয়ালি অনেকটাই এগিয়ে কলকাতার থেকে। তার প্রধান কারণ, কলকাতায় এমন কোনও শ্রেণি গত কয়েক দশকে গড়ে উঠতে পারে নি, যাদের হাতে উদ্বৃত্ত পয়সা থাকবে, এবং সেই পয়সা বরাদ্দ করা যাবে শিল্পকলা বা মেধাচর্চার বিভিন্ন খাতে। সমস্যাটা, এক অর্থে, কাঠামোগত, স্ট্রাকচারাল— এবং ঝটিতি কোনও গোলমাল নয়। দশকের পর দশক সলিলহীন কূপে থাকতে থাকতে যে অন্ধকার ভবিতব্য, বাঙালির বরাতে ঠিক তা-ই হয়েছে। পয়সা না-থাকার দরুন, বহির্বিশ্বের নজর কাড়তে পারে— এমন কোনও প্রকরণ তার হাতে নেই। বাঙালির গান-সংস্কৃতির পরতে পরতে ছিল এই উদ্বৃত্ত পুঁজির বিনিয়োগ, আর নানা ভাষা ও প্রদেশের ভেতর অবারিত চলাচলের ইতিহাস। আধুনিক গান এবং মার্গসংগীত— দু'-ক্ষেত্রেই তা সত্যি। আজকের প্রায়-গতিহীন, এঁদো বঙ্গসমাজের নিক্তিতে এই উদ্দীপনা মেপে ওঠা মুশকিল।

নেহাত বাঙালি শিল্পরসিক জাতি, তাই সে একমাত্র শিল্প নিয়ে কান্নাকাটি করে। নইলে, বৃহত্তর এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত তার চোখ এড়াত না। মিছিমিছি শ্রোতাকে দোষ দিয়েও লাভ আছে কি? গুণমানে অনুন্নত যে পণ্য, তাতে লটারি লাগিয়ে কোন ভাষাপ্রেম এবং দীনতার অভিমানই-বা বাঙালি শ্রোতা ইস্তেমাল করতে পারে? বঞ্চিত, এবং হীন— যে ভাষার আত্মপরিচয় এমনটা, তাতে কেনই বা হাত পোড়াতে যাবে সচ্ছল, উদীয়মান মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান? তার কারণও নেই। সাংস্কৃতিক পুঁজি কখনওই একা একা টিকে থাকে না। তার দরকার পড়ে একটা শক্তপোক্ত কোনও পাদানির। তিনের দশকে পুঁজি, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন আর মেধার মিলিত উদ্যোগে যে বাজার বাঙালি তৈরি করতে পেরেছিল— আজ, এই দুর্বল অর্থনীতির ক্রান্তিমুহূর্তে দাঁড়িয়ে তার কিছুই অবশিষ্ট থাকার নয়। থাকেওনি। বাজারের কোমর ভেঙে গেছে বহু কাল হলো। 'কপালকুণ্ডলা'-য় বঙ্কিম বলেছিলেন না, ‘বাঙালী অবস্থার বশীভূত, অবস্থা বাঙালীর বশীভূত হয় না।’ ফেসবুকে গায়কের নিশীথ-প্রলাপ, আর তার উল্টোদিকে দেখনদারি-সর্বস্ব, উন্মত্ত ও আকাট প্রতিক্রিয়াই এখন বাঙালির যষ্টি।

হাতে অবশ্য একটি অব্যর্থ পেনসিলই রয়ে গেছে। স্বর্ণযুগ। ফেলুদা। মানিকদা। নস্টালজিয়া। ‘কলি কালে কালে কালে, কাল হইয়াছে।'

 

More Articles