সমাজ থেকে সরকার, মুখ ফিরিয়ে নেয় সবাই! 'হিজড়ে'-দের পুজোয় তবু সকলের নিমন্ত্রণ

Durgapuja 2022: 'হিজড়ে' বলেই আমরা চিনি তাঁদের, পুজো কেমন কাটল সেই মানুষগুলির?

সমাজের চোখে তারা 'অপরজন'। আদারাইজেশনের জাঁতাকলে পিষতে পিষতে সমাজের সব উৎসব-অনুষ্ঠানেই তারা ব্রাত্যজন। ব্যতিক্রম নয় দুর্গাপুজোও। মূলধারার সমাজ তাদের ব্যঙ্গ করে ডাকে 'হিজড়ে' বলে। এখনও বাঙালি সমাজের প্রচলিত প্রবাদ 'হিজড়েদের' নাম করলে দিন খারাপ যায়। সময় এগিয়েছে। আমরা আধুনিক হয়েছি। কিন্তু সংস্কার বদলায়নি একটুও।

অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজড়ে ইন বেঙ্গল-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা রঞ্জিতা সিনহার কথায়, "দুর্গাপুজো তো সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু এই উৎসবগুলোতেও আমাদের মতো যারা প্রান্তিক মানুষ, তাদের কথা কেউ মনে রাখে না। যে কোনও পুজো প্যান্ডেলে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার স্বীকার হতে হয় রূপান্তরকামীদের। সমাজের মূল স্রোতের মানুষের কাছে আমাদের অবস্থা অনেকটা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পথকুকুরদের মতো। পুজোর অনুষ্ঠানে আমাদের সম্প্রদায়ের কোনও মানুষ গেলে তাদের দিকে গরম জল বা থুতু ছুড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।"

দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আইনের যুদ্ধ জিতলেও সাধারণ মানুষের চোখে 'হিজড়ে' বা 'অপয়া' হয়েই থেকে যেতে হয়েছে তাঁদের। যাঁরা পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, এবং যাঁরা এখনও পরিবারের মধ্য থেকে নিজেদের লিঙ্গপরিচয়ের লড়াই করছেন- প্রত্যেককেই দুর্গাপুজোর সময় সামাজিক নিপীড়নের ভয়ে মুখ লুকোতে হয়েছে ঘরের কোণে। 

সমাজের এই চাপে কোণঠাসা হতে হতেই রূপান্তরকামীদের নিজের উদ্যোগে দুর্গাপুজো শুরু করার পরিকল্পনা মাথায় আসে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিতা সিনহার। ১৯৯৯ সালে যে শহর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রাইড ওয়াকের সাক্ষী থেকেছিল, সেই কলকাতা শহরেই ২০১৭ সালে ট্রান্সজেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের গোখেল রোডের রেজিস্টার্ড অফিসে শুরু হয় দুর্গাপুজো। সাধারণ দুর্গামূর্তি নয়, নিজেদের লিঙ্গরাজনীতির লড়াই ফুটিয়ে তুলতে তৈরি হয় অর্ধনারীশ্বর প্রতিমা। একই শরীরে শিব এবং পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। এই স্ট্রাকচার কেবল রূপান্তরকামীদের আইনি লড়াইয়ের জয়ের চিহ্ন শুধু নয়, প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও স্থাপত্যের এক মূর্ত রূপ।

শহরের আর পাঁচটা দুর্গাপুজোর থেকে এই পুজো অনেকটাই আলাদা। নয় রাত্রি ধরে চলে মায়ের পুজো ও আরাধনা। রঞ্জিতা সিনহার কথায়, "আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষরা বেশিরভাগই পরিবারছুট। আমাদের মা থেকেও তাই অনেক সময় থাকে না। তাই দুর্গাপুজো আমাদের কাছে আমাদের ঘরের মায়েরই উদযাপন। তাই আমরা ঠাকুরের বিসর্জন দিই না। আমাদের মা সারাবছরই আমাদের সঙ্গেই থাকেন।"

এই পুজো যে কেবল রূপান্তরকামী সম্প্রদায়েরই পুজো, তা কিন্তু নয়। সামাজিক লাঞ্ছনার ইতিহাসকে মাথায় রেখেই সমাজের সব স্তরের প্রান্তিক মানুষেরই অবাধ প্রবেশাধিকার থাকে এই উৎসবে। পথশিশু থেকে ফুটপাথের বাসিন্দা, অ্যাসিড-আক্রান্ত থেকে যৌন কর্মী, সকলের সঙ্গেই আনন্দ-আহ্লাদ ভাগ করে নেন রূপান্তরকামীরা। পুজোর নয়দিন ধরে চলে খাওয়াদাওয়া ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

প্রথাগত কুমারীপুজোর ছক ভেঙে নিজেদের মতো করেই নিয়ম রক্ষা করেন রূপান্তরকামীরা। এই প্রসঙ্গে রঞ্জিতা সিনহা বলেন, "আমরা সমাজের প্রচলিত নিয়মে কুমারী পুজো করি না। পথশিশু, সে মেয়ে হোক বা ছেলে- যে কাউকে দিয়েই আমরা কুমারী পুজো সেরে থাকি।"

এই বছর পাঁচ বছরে পা দিল রূপান্তরকামীদের পুজো। বিগত চার বছর ধরে গোখলে রোডের অফিসে পুজো হলেও এই বছর পুজো হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে রূপান্তরকামীদের জন্য গড়ে দেওয়া 'গরিমা গৃহে'।

পুজোর সব আচার-অনুষ্ঠানও পালন করেন রূপান্তরকামী মানুষেরাই। অর্ধনারীশ্বর মূর্তি তারা নিজেরাই গড়েন। চার বছর ধরে একই মূর্তিতে পুজো হয়ে এলেও এই বছর গোখেল রোডের অফিস থেকে মুকুন্দপুরের গরিমা গৃহে পুজো স্থানান্তরিত হওয়ার পর আবার একটি নতুন অর্ধনারীশ্বর প্রতিমা গড়া হয়েছে। প্রতিমার পুজোর দায়িত্বেও থাকেন রূপান্তরকামী মানুষরাই। প্রথম বছর, ২০১৭ সালে অভিরাজ পোদ্দার নামে এক রূপান্তরকামী পুরুষ পুজো করলেও, ২০১৮ সাল থেকে পুজোর জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন বৈশালী দাস। এরকম এক আনন্দের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে গিয়ে বৈশালী বলেন, "আমি প্রথম পুজো করি আমার ষোলো বছর বয়সে। সেই সময় শীতলা ও মনসা দেবীর পুজো করতাম। পরে যত বড় হলাম, দুর্গাপুজো-সহ অন্য যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেই খুব অপমানিত হতাম। মায়ের কাছ থেকে পুজো শিখেছি। কিন্তু আমাদের পরিচয় জেনে মূলধারার পুজোয় কেউ তো আমাদের ডাকত না। তারপর যখন আমরা পুজো শুরু করি, তখন মা (রঞ্জিতা সিনহা) আমার কাঁধে পুজো করার দায়ভার তুলে দেন।"

বৈশালী দাস

বৈশালী সব আচার-নিয়ম মেনেই প্রত্যেকবার মায়ের পুজো করেন। কলাবউ স্নান থেকে সন্ধিপুজোর ভোগ নিবেদন- পুজোর যাবতীয় প্রচলিত আচার নিষ্ঠাভরে পালন করেন সকলেই। শুধু পুজো করাই নয়, সমাজের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে ফেলে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব পালন করেন রূপান্তরকামী মেয়ে শ্রুতি। শ্রুতির নিজের কথায়,

যখন নিজের মধ্যেকার নারী সত্তাটা প্রথম বুঝতে পারি সেই মুহূর্তে তো কাউকেই বলতে পারিনি। তখন পশ্চিম মেদিনীপুরে নিজেদের বাড়িতে থাকার সময়েই দাদুকে দেখতাম পুজোর একমাস আগে থেকেই স্নান করে চণ্ডীপাঠ করতেন। পুরুষ হিসেবে এই কাজে অংশগ্রহণ করতে পারলেও আমার খুব একটা আনন্দ হতো না। ভাবতাম কবে নিজের মনের মতো করে পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারব। পরে পরিবারের লোকের কাছে যখন নিজের আসল সত্তার কথা তুলে ধরি, তারা কেউই মেনে নেয়নি। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার প্রথম দুর্গাপুজো দেখা ২০২১ সালে গোখেল রোডে। আর এই বছর থেকে গরিমা গৃহের দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠের দায়িত্বে আমি। ছোটবেলার এতদিনকার ইচ্ছে সার্থক হলো।

শ্রুতি চক্রবর্তী

কিন্তু খুশির রোশনাইয়ের মাঝেও বাজে বিষাদের সুর। গত বছর রাজ্য সরকারের অনুদানের টাকা এলেও ২০২২-এর পুজোয় সরকারের তরফ থেকে কোনও অনুদান আসেনি। এমনকী, ডাক আসেনি রেড রোডের কার্নিভালেও। রঞ্জিতা সিনহা আক্ষেপ করে বলেন, "কেন্দ্রীয় সরকার-রাজ্য সরকারের মতবিরোধের কারণেই হয়তো এই বছর আমাদের ভাগ্যে অনুদান জুটল না। এমনকী, রাজ্য সরকার আয়োজিত রেড রোডের বিসর্জন কার্নিভালেও নিমন্ত্রণ পাইনি আমরা। প্রান্তে যাদের বসবাস, তাদের মূলধারায় ফিরতে সরকার যদি হাত না বাড়িয়ে দেয় এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে!" সরকারি সাহায্য না মিললেও নিজেদের মতো করেই উৎসব অনুষ্ঠানে ত্রুটি রাখেননি রূপান্তরকামী মানুষেরা।

ট্যাবুর বাঁধন ভেঙে কবে 'তাহাদের পুজো' সকলের পুজো হয়ে উঠবে তারই প্রতীক্ষায় রূপান্তরকামীরা।

More Articles