বিধবার দেবীপক্ষ! 'আবার আসিস মা', ডাকের সঙ্গে মিশে চোখের জল

Durgapuja 2022: ব্রাহ্মণ বালকটির বিধবা মা সকলের আগে উঠলেন। দেবী দুর্গার মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, “এমনি করে মা বছর বছর আসিস।”

‘দুর্গাদালানে বিধবার যেতে মানা'

ওমা তুমি, বিধবার অর্ঘ, বিধবার অঞ্জলি, বিধবার এয়োত্ব উপহার লইবে না কি! ওমা লইও, লইও, গোপনে লইও! লোকের অলক্ষ্যে বিধবার অশ্রুজল মুছাইও! দুর্গাদালানে বিধবার যেতে মানা; সধবা মানা করেন। ওমা বিধবার চোখের জল মুছাও। তোমার পদ্ম-হস্তের স্পর্শটুকু ছাড়া ও জল মুছাইবার শক্তি আর কিছুর নাই।

দেবী মহামায়ার উদ্দেশে এই করুণ আবেদন করেছিলেন ‘শারদীয় সাহিত্য’ (১৮৯৬) রচয়িতা শ্রীঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় (১৮৫১-১৯০৩)। গদ্যপদ্যময় পুস্তকটির ‘প্রথম স্তবক’-এর নাম ‘অশ্রু মুছাও’। বিধবার সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাল লাগা, মন্দ-লাগা এই সব কিছুর মুশকিল আসান যেন লুকিয়ে আছে মা দুর্গার কাছে। আবার অন্যদিকে উনিশ শতকীয় বিধবাদের ওপর সামাজিক বিধিনিষেধের বাস্তব দলিল এই গ্রন্থ। যা স্মরণ করিয়ে দেয় কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা: দ্বিতীয় ভাগ’-এর (১৮৬৩) ‘দুর্গোৎসব’ অংশের কথা। সেখানে ‘অমুকবাবুর’ বাড়িতে পূজার মহাধুমের বর্ণনা করেছেন কালীপ্রসন্ন। সেই ‘অমুকবাবুর’ সভাপণ্ডিত মহাশয় যখন বাবুর অনুদানের তালিকা প্রস্তুত করছিলেন, তখন পিরিলীর বাড়ির বিদেয় নেওয়া এবং বিধবাদলের ও বিপক্ষদলের ব্রাহ্মণদের নাম কাটছেন তিনি। ‘বিধবা’র বাড়ি যাওয়া ব্রাহ্মণদের দুরবস্থার কথা কালীপ্রসন্নের বয়ানে খানিকটা এরকম:

অনেকে তাঁর পা ছুঁয়ে দিব্বি গালচেন যে, তাঁরা পিরিলীর বাড়ি চেনেন না; বিধবা বিয়ের সভায় যাওয়া চুলোয় যাক, গত বৎসর শয্যাগত ছিলেন বল্লেই হয়।

সভাপণ্ডিত মশাই কিন্তু নট নড়নচড়ন।

বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠানে যাওয়ার অপরাধে যে এক অংশের ব্রাহ্মণদের সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল, এ ঐতিহাসিক সত্য দীর্ঘদিন ধরে অনালোচিত রয়ে গেছে। ফলে পিরিলীর বাড়ি যাওয়া, বিধবা বিবাহে অংশ নেওয়া ব্রাহ্মণদের ইতিহাসও মুছে গেছে বাঙালির স্মৃতি থেকে। ঠিক যেমন চাপা পড়ে গেছে অন্তঃপুরে বন্দী মহিলাদের দুর্গোৎসবে মেতে ওঠার ইতিহাসমালা। রামসর্ব্বস্ব বিদ্যাভূষণ রচিত ‘আসমানের নকশা—পল্লীগ্রামস্থ বাবুদের দুর্গোৎসব’-এ (১৮৬৮) পাওয়া যায় দুর্গাপূজার সপ্তমীতে বঙ্গমহিলাদের অঞ্জলি দেওয়ার দৃষ্টান্ত। ‘বাবু’-র বাড়ির বালিকা, যুবতী এবং বৃদ্ধাগণ অঞ্জলি দেওয়ার জন্য বহির্বাটীতে অগণিত দর্শকের মাঝে এসে উপস্থিত হন:

বাইরের দালানে লোকারণ্য! নিমন্ত্রিত অনাহূত ও দর্শকমণ্ডলীতে বহির্বাটী ব্যাপ্ত! তথাপি বাড়ির কি বালিকা, কি যুবতী, কি বৃদ্ধা সকলকেই আজ লজ্জা ছেড়ে দালানে অঞ্জলি দিতে হয়।

আরও পড়ুন: আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা

ওপরের বর্ণনাটি নানা কারণে জরুরি। আচার-ধর্মে ঘেরা বাংলাদেশে সেদিন মেয়েরা চাইলেও ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু দুর্গাপুজো তার সামনে এমন এক খোলা পরিসর তৈরি করে দেয়, যেখানে তাঁরা চেনা-অচেনা লোকেদের ভিড়ে নিজের স্বগর্ব উপস্থিতিটুকু জাহির করতে পারেন। পুজোর পরিমণ্ডল তাঁদের অন্তঃপুরের ‘লজ্জা’ ছেড়ে আঙিনায় আসার অধিকার দিয়েছে। নারীর ঘর থেকে বাইরে আসার পথে উৎসবের এই ভূমিকা তাই বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে।

'দারোগার দপ্তর', বিধবা ও দুর্গোৎসব   
‘পল্লীগ্রামস্থ বাবুদের দুর্গোৎসব’ (১৮৬৮) নকশায় ‘বাবু’র বাড়ির মেয়েদের কথা থাকলেও, বিধবাদের কোনও উপস্থিতি দেখা যায় না। কিন্তু তা'বলে যে তাঁরা ছিলেন না, এমনটা নয়। উনিশ শতকের খুন, চুরি, জালিয়াতি প্রভৃতি শতেক অপরাধের মাঝেই কেমন চুপটি করে বসেছিল বিধবা এবং শারদীয়ার সম্পর্ক কথা। তৎকালের দুঁদে দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৯৪৭) ঔপনিবেশিক শাসকের বিশ্বস্ত অনুচর। কলকাতা শহরে নিত্য নতুন ঘটে চলা অপরাধের তদন্তে পাকা খিলাড়ি তিনি। অপরাধী শনাক্ত করতে দরকার পড়লে ডাক্তারের সাহায্যও নেন তিনি। বিলিতি অপরাধ বিদ্যার নিত্য নতুন আবিষ্কার চাইলেই তার হাতের নাগালে। এহেন করিতকর্মা মানুষটি তাঁর বাস্তব তদন্ত-কাহিনির ওপর ভর করে লিখে ফেলেছেন রোমাঞ্চকর কাহিনি এবং কিস্তিতে কিস্তিতে সেগুলি প্রকাশ করেছেন ‘দারোগার দপ্তর’-এর পাতায়। বাংলার আদি পর্বের গোয়েন্দা কাহিনি হিসাবে পরিচিত এই গল্পগুলিতে কি শুধুই মারামারি আর কাটাকাটির কাহিনি। এসবের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে কি ঢুকে পড়েনি সামাজিক চাওয়া পাওয়ার অন্য ধরণের গল্পগাছাও। যারা সামাজে অবহেলিত, নিপীড়িত সেই বিধবাদের আনন্দ যাত্রার কথা ফুটে উঠেছে প্রিয়নাথের কলমে। ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ‘কাটামুণ্ড’ কাহিনিতে লেখা হয়: 

আজ ১লা কার্ত্তিক, ৺শারদীয়া পূজার প্রথম দিবস। সপ্তমীপূজা উপলক্ষে আজ আমার হিন্দু পাঠকগণ সকলেই আনন্দিত। কুটীরবাসী দরিদ্র হইতে অট্টালিকাবাসী হিন্দুসম্রাট পর্য্যন্ত সকলেই আজ মহামায়ার দর্শন-লালসায় একান্ত ব্যস্ত। আজ সকলের হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতেছে। সম্বৎসর পরে ভগবতীকে দর্শন করিবার আশায় আজ বিধবা বৈধব্যযন্ত্রণা ভুলিয়াছেন, স্নেহময়ী মাতা কাল-কবলিত পুত্রের শোক বিস্মৃত হইয়াছেন।

একজন বিধবা নারীরও যে নিজের মতো করে পুজো উদযাপনের জীবন থাকতে পারে, সেকথা চট করে ভাবতে চাইতাম না আমরা। প্রিয়নাথের কাহিনিগুলিকে সমাজের ‘ভদ্র’ পরিসর খুব ভালো চোখে দেখেনি সেদিন। প্রিয়নাথ মানুষের চরিত্রের সেই দিকগুলি নিয়ে কাজ করেন যাকে ‘ভদ্র’ সামাজিক অঞ্চল স্বীকৃতি দিতে চায় না। এক জন বিধবা নারীও যে সেদিনের সামাজিকতায় নিজের মতো করে দুর্গা পুজোর আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে পারে একথা বোধহয় প্রিয়নাথের মতো একজন দারোগাই ভাবতে পারেন। দারোগা হিসেবে প্রিয়নাথকে সেদিন সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছিল।

সমাজ যখন বিধবা নারীকে ব্রতধর্ম পালন, উপবাস-অনাহারে বেঁচে থাকার বিধান দেয়, তখন সেই নিয়মকে মেনে নিয়েও সে নিজের মতো করে আনন্দের পরিসর খুঁজে নেয়। আমরা এমন কোনও সাধারণীকরণ করতে চাইছি না যে, দুর্গোৎসব সমস্ত বিধবাদের জীবনে আনন্দের মুহূর্ত হয়ে দেখা দিয়েছিল। বরং উৎসবের পরিমণ্ডলেই বিধবাদের প্রতি শাসনের আগুনে আরও একটু বেশি করে আঁচ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই আঁচের মধ্যেও অনেকে পুজোকে কেন্দ্র করে নিজের মতো আনন্দের পথ খুঁজে নেন। তবে বিধবা হয়েও সামাজিক শিকলকে যারা উপেক্ষা করেন, সেখানে বৈধব্যের সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্নও জুড়ে থাকে। যেমনটা ঘটেছিল মা সারদা এবং রানী রাসমণির ক্ষেত্রে। তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে খানিক দেখে নেওয়া দরকার উৎসবের মরশুমে কেমন করে শাসনদণ্ডের সজাগ দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় বৈধব্যের প্রতি।

‘নেই কেবল কাপড়ের গুলজার পাড়’   
১৮৯৪ সালের ১৯ আশ্বিন, ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকায় উঠে আসে দুর্গোৎসব উদযাপনের কথা। মায় অমৃতলাল বসু ‘দুর্গাপূজা’ নামে লিখলেন জমাটি কবিতা। শারদীয় সংখ্যাটির প্রায় মাসখানেক পূর্বে ‘ভাদ্র’ মাসে ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছিলেন শ্রীপাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৬-১৯২৩)। নিবন্ধের শিরোনাম: ‘হিন্দু-বিধবা’। বাঙালিদের ঘরে ঘরে বিধবার চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লেখকের অভিযোগ:

সধবা হইতে বিধবাকে এখন আর সহজে বাছিয়া লওয়া যায় না। সধবার ন্যায় বিধবারও তেমনি আগুল্‌ফবিলম্বিত, সুগন্ধি তৈলসিক্ত, সুচিক্কণ গুচ্ছ গুচ্ছ কেশরাশি, দুগ্ধঘৃতাদি উষ্ণ এবং উদ্দীপক আহারে পরিপুষ্ট পূর্ণাবয়ব দেহযষ্টি, সর্ব্বদাই অধরৌষ্ঠ তাম্বুলরাগেরঞ্জিত; নাই কেবল কাপড়ের গুলজার পাড়, হাতে বলয়াদি অলঙ্কার, এবং সিঁথিতে সিন্দুর বিন্দুপ্রভা ও চারুচরণযুগলে অলক্তকশোভা।

বিধবা সুগন্ধি তেল ব্যবহার করছে, ‘উদ্দীপক আহার’ খাচ্ছে এমন দৃশ্য পাঁচকড়িবাবুর ‘হিন্দু’ সমাজ সইবে কেন! অবশ্য অভিযোগ শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। উনিশ শতকের ফুলে ফেঁপে ওঠা বাংলা বই-এর বাজার বিধবার শুদ্ধতা রক্ষার খাস শত্রু হয়ে উঠেছিল সেদিন।   

সভ্যা বাঙ্গালিনী বিধবা, সধবার ন্যায় সর্ব্বদা উপন্যাস-নাটক-নভেল-পাঠরতা, প্রণয়বিরহ মিলনাদির প্রসঙ্গে প্রমোদিতা, নবোঢ়াদম্পতি বিশেষের ব্যবহার সমালোচিনতৎপরা; এবং আড়িপাতায়, বাসরজাগরণে, কোন নিরক্ষরা কিশোরীর প্রথম প্রণয়-পত্রের সুরতাল উত্তর লিখনে সিদ্ধা।

বিধবার ‘উপন্যাস-নাটক-নভেল’ পাঠে যদি এমন আপত্তি থাকে প্রাবন্ধিকের, তাহলে বিধবা নারী প্রণয়ের কবিতা লিখলে কেমন চোখে দেখবেন শ্রীপাঁচকড়িবাবু তা সহজেই অনুমান করা যায়। লেখকের নিজের ভাষায়: 

তবে এখন অনেক বাঙ্গালিনী গ্রন্থকর্ত্রী কবি এবং সমালোচিকা হইয়াছেন। হয়ত অনেক লেখিকা বিধবা, কিন্তু তাঁহাদের পদ্যের চরণে চরণে প্রেমের ঢেউ উঠিয়াছে—রসের ফোয়ারা ফুটিয়াছে, এবং বিষাদের, ক্ষোভের বিকট উক্তিতে পুস্তক ও প্রবন্ধ সকল কলুষিত।

‘বিধবা লেখিকা’ সম্পর্কে এই উক্তি কিন্তু সাধারণীকরণ দোষে দুষ্ট নয়। বরং এর উদ্দিষ্ট বিশেষ রয়েছে। উনিশ শতকের ‘মহিলা কবি’ মানকুমারী বসু ‘সাড়ে আঠারো’ বছর বয়সে বিধবা হন। বৈধব্যের পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রিয়-প্রসঙ্গ’ (১৮৮৪) গ্রন্থ ঘিরেই সম্ভবত পাঁচকড়িবাবুর এতো আপত্তির ঝড়। মানকুমারী দেবীর নিজের ভাষায়: এই গ্রন্থের জন্য “অনেক হিংসা, দ্বেষ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা আমাকে সহিতে হইয়াছিল।”

মা সারদা এবং রানি রাসমণির কথা 
ষোড়শ শতকের বাঙালি নাট্যকার ও সাহিত্যতাত্ত্বিক পরমানন্দ সেন রচিত সংস্কৃত-নাটক ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়ম’ পড়লে বৈধব্য ও ক্ষমতার একটি প্রতর্ক লক্ষ্য করা যায়। নাটকটির দ্বিতীয় অঙ্কে দেখা যায় অদ্বৈত, শ্রীবাস এবং শ্রীচৈতন্যদেব নিজেদের মধ্যে আলোচনারত। এমন সময় নেপথ্যে শোনা গেল, বিশ্বজননী শচীদেবী বলে পাঠিয়েছেন—“আমাদের অতিভাগ্যে যদি অদ্বৈতের শুভাগমন হল তবে অন্য কোথাও তাঁর বিশ্রামস্থান হওয়া উচিত নয়। আজ আমার গৃহে তাঁহার নিমন্ত্রণ, তিনি আমার গৃহে আসিয়া বিশ্রাম করিবেন।’ এই কথা শুনে অদ্বৈত বললেন, জগন্মাতার যেরূপ আদেশ, শচীমাতাকে বলো—“ভগবান শ্রীবিশ্বম্ভরের সঙ্গে আমার আজ আহার হবে, এই মহানন্দে আমার দেহ জড়তা প্রাপ্ত হচ্ছে।” শ্রীবাসও তো এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চান না। তিনি বলেন, “আমার জন্যও ঈশ্বর আজ শচীগৃহে অন্ন মাপিবেন।” সমস্ত ঘটনার সাপেক্ষে শ্রীচৈতন্যদেব বলেন, তা হলে বহুজনের রান্না করতে আজ অদ্বৈতের অত্যন্ত পরিশ্রম হবে। চৈতন্যের এমন বক্তব্যের মূলে তৎকালের আচার ধর্মের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। যে আচারধর্মে বিধবার হাতের রান্না খেতে মানা করবে সমাজ। অবশ্য অদ্বৈত সেই সামাজিক শাসনকে উপেক্ষা করেন। শ্রীশচীদেবী জগন্মাতা—তাঁর হাতের পাচিত অন্ন খেতে কি কারও আপত্তি থাকতে পারে! ‘বিধবা’ শচী দেবীর হাতে রান্না খাওয়া শুধু নিপাট বৈষ্ণব উদারতার বিষয় নয়। বরং চৈতন্য সেদিনের সমাজে বড় ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আচার ধর্মকে তাই সেদিন সমঝোতা করতে হয়েছিল শচীদেবীর বৈধব্য এবং তার পালনীয় কর্তব্য নিয়ে।

প্রায় তিন শতাব্দী পরের ঘটনা। ১৮৯৩-'৯৪ সাল। স্বামী বিবেকানন্দ তখন আমেরিকায়। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠার প্রাক্‌কালে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য অনুগামীদের চিঠিতে (পত্রাবলী, সংখ্যা ১৫৪) তিনি জানান:

মা-ঠাকুরণ কী বস্তু বুঝতে পারনি, এখন কেউই পার না, ক্রমে পারবে। শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হয় না।...মা ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন।

১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর, তাঁর শিষ্যরা শ্রীমা সারদাকে আর কোনোভাবেই হারাতে চান না। স্বামী বিবেকানন্দ চিঠিটিতে তাই বলছেন:

এইজন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই। রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা-ঠাকুরাণী গেলে সর্বনাশ।

এরপর আসা যাক ১৯০১ সালের এক ঐতিহাসিক ঘটনায়। ততদিনে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলছে। ১৯০১ সালে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারাই দুর্গাপুজো প্রথম অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রীমা সারদা (১৮৫৩-১৯২০) পুজোর সময় বেলুড় মঠে উপস্থিত ছিলেন। সারদা দেবীর নামেই পূজার ‘সংকল্প’ করা হয়েছিল। ১৯২০ সাল অর্থাৎ মহাসমাধির পূর্ব পর্যন্ত শ্রীমা সারদা বেলুড় মঠের প্রত্যেক দুর্গোৎসবে উপস্থিত থাকতেন। শ্রীমা সারদার কথা স্মরণ করলে, অবশ্যই উনিশ শতকের অপর এক ‘বিধবা’র প্রসঙ্গ চলে আসে। তিনি হলেন জানবাজারের রানি রাসমণি দাস (১৭৯৩-১৮৬১)।

রাজচন্দ্র দাসের জীবদ্দশাতেই তাঁদের বাড়িতে দুর্গোৎসব হতো। তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত কাজকর্মের ভার পড়ল রানি রাসমণির ওপর। রাসমণি দেবী ‘বিধবা’ হওয়া সত্ত্বেও দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যায়নি তাঁদের বাড়িতে। আরো জাঁকজমক ও ধূমধামের সঙ্গে পালিত হতো বাড়ির দুর্গোৎসব। পূজার নৈবেদ্য, উপকরণ প্রভৃতিতে তিনি যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন, তেমনি পূজা উপলক্ষে লোকজন খাওয়ানো, দান-ধ্যান করতেও ভুলতেন না। পূজার কদিন আগে থেকে শুরু করে কয়েকদিন পর পর্যন্ত রাসমণি দেবী নানা ধরণের যাত্রা ও গানের দল এনে আনন্দময়ীর আগমনকে মহানন্দে পরিণত করতেন।

এক বছর দুর্গাপুজোর সময় ষষ্ঠীর দিন সকালে রানিমার পূজারী ব্রাহ্মণগণ যখন প্রচুর লোকজন নিয়ে বাদ্যরোল সহযোগে নবপত্রিকা স্নান করাতে যাচ্ছিলেন, তখন কোনও এক ইংরেজ সাহেব বাবুরোডের পাশের অট্টালিকায় ঘুমাচ্ছিল। নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়, তিনি চটে যান এবং পুলিসে দরখাস্ত করেন। রানিমার কানে যখন কথাটা পৌঁছল, তিনি আরও অধিক বাদ্যকর নিয়ে মহা ধূমধামে দুর্গাপুজো করতে লাগলেন। তিনদিন পর রানীমার কাছে নিষেধসূচক এক পত্র এল। মোকদ্দমা বাঁধল। তিনি তখন রাজচন্দ্র বাবুর কৃত গ্যারিজন অফিসারের মঞ্জুর করা দলিল পত্র কোর্টে পাঠালেন এবং বলে দিলেন, “আমার রাস্তা, আমি যা ইচ্ছে তাই করব, এতে সরকার বাহাদুর বাধা দিলে আমি যে ব্যয়ে রাস্তা করেছি তার দ্বিগুণ ব্যয়ে রাস্তাটি উচ্ছেদ করব।” তুমুল গণ্ডগোল শুরু হল। হুকুম অমান্য করার জন্য রানীমার ৫০ টাকা জরিমানা ধার্য হয়েছে।  রানীও ছাড়বার পাত্র নয়। তিনি কাঠ দিয়ে জানবাজারের বাড়ি থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে বেড়া দিয়ে দেন। ফলে অন্য রাস্তার যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষ ইংরেজ সরকার পরাজয় স্বীকার করে। রানিমার জরিমানা টাকাও ফেরত দেয়।

‘এমনি করে মা বছর বছর আসিস’
দুর্গাপুজোকে উপলক্ষ করে ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আগমনী’ পূজাবার্ষিকী, যার সম্পাদক ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (১৮৭০-১৯২১)। গ্রন্থটিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল— ‘বামুনের দুর্গোৎসব’। আট-নয় বছরের ব্রাহ্মণ বালক এবং তাঁর বিধবা মায়ের গল্প। বিধবা মায়ের চোখে জল দেখে বালক বড়ই অস্থির হয়ে ওঠে। আসলে চৈত্রমাসে বাড়ির কর্তা মারা যাওয়ার পর মা-ছেলের দুনিয়া পালটে গেছে। বিধবা মায়ের কান্না দেখে বালক কিশোরীদাদাকে সঙ্গে নিয়ে কাঠামোপুজোর আয়োজন শুরু করে। এসব দেখে পাড়ার লোক বিধবা বউকে বলে, “সংসার চলাচলেরই কষ্ট। তুমি কি সাহসে কাঠামপূজা করে দুর্গোৎসবে ঝাঁপ দিলে?” পাড়ার লোকের সমালোচনা সহ্য করে ব্রাহ্মণ বিধবা চোখের জল ফেলতে থাকে। আজকের কথা নয়, সেই কবে থেকে দেবীর আরাধনা করে তারা। এভাবে তো পুজো বন্ধ করা যায় না। বালকের জেদ আরও বেড়ে যায়। সে বার্ষিক আদায়ের জন্য বাগবাজার থেকে হাটখোলা ঘুরে ঘুরে ভদ্রলোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। ছেলে যে বার্ষিক আনবে বিধবা মা তা বিশ্বাস করতে পারেনি। ছেলের আনা ৩০/৪০ টাকা বার্ষিক দিয়েই দুর্গোৎসবের কেনাকাটা শুরু হয়।

পঞ্চমীতে গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে যায়: নবকিশোর শিরোমণির ছেলে প্রতিমা এনেছে, মা তাতে অধিষ্ঠান করবেন। গ্রামের যার যা ভালো জিনিস ছিল তাই নিয়ে এসে পুজোয় সমর্পন করলেন। সকলের সাহচর্যে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী সুষ্টুভাবে কাটল। নবমীর মহাসন্ধ্যায় মহাসন্ধির পূজা। রাশি রাশি ধূপধুনা পুড়ছে। শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক, কাসি—সব উদ্দাম শব্দ তুলছে। এরপর পূজার সময় সকলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল এবং দণ্ডবৎ ভূতলে পড়ল। ব্রাহ্মণ বালকটির বিধবা মা সকলের আগে উঠলেন। দেবী দুর্গার মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, “এমনি করে মা বছর বছর আসিস।” হোক না নিছক গল্পকথা, তবু বিধবার দুর্গোৎসবের আনন্দে সামিল হওয়ার বিশেষ নিদর্শন এই আখ্যান। আচার-ধর্মের বুকে আঘাত হেনে বিধবার দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ যেমন নারীর নতুন এক পরিসরের ইঙ্গিত দেয়, তেমনই দেবী দুর্গাকে ঘিরে গড়ে ওঠা উৎসবেরও বিশেষ ভূমিকা ছিল বৈধব্যের নতুন প্রতর্ক নির্মাণে। আমরা এই প্রবন্ধে বিধবার তরফ থেকে দেবী দুর্গার কাছে পৌঁছনোর গল্প বললাম। কিন্তু একটা অন্য গল্পও আছে, যেখানে উৎসবের সংস্কৃতি নিজের মতো করে এগিয়ে গিয়েছিল বিধবার দিকে। 

More Articles