সন্তানদের জন্য লাইব্রেরি বানান, অভিভাবকদের বলেছিলেন তরুণ মজুমদার
একটা ঘটনা বলে শেষ করি। চন্দননগরের একটা বইমেলা উদ্বোধনে গিয়েছিলাম। তরুণবাবুও গিয়েছেন। তখন সবে 'চাঁদের বাড়ি' মুক্তি পেয়েছে, খুব হইচই ওখানে। উনি বলেছিলেন সেই সভায়, "আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, যাঁরা অভিভাবক, আপনাদের যত কষ্ট...
যতদূর মনে পড়ে, সালটা ২০০৫ বা '০৬। হঠাৎ একদিন ফোন এল। ফোনের ওপার থেকে একজন বললেন, "আমি তরুণ মজুমদার বলছি।" আমি তো স্তম্ভিত! তরুণ মজুমদার স্বয়ং ফোন করছেন! তরুণবাবু সেদিন বলেছিলেন, "আপনি আমাকে একটা গল্পের হদিশ দিতে পারেন, একটু পারিবারিক গল্প, যার মধ্যে সুখ-দুঃখ বা সাংসারিক বন্ধনের কথা বলা আছে? আমি আপনার দু'-তিনটে গল্প পড়েছি, যেগুলো পরিবারকেন্দ্রিক। আমি এরমই একটা ছবি করছি, আমার মনে হয়, যা আমি চাইছি, তা আপনার কাছে আছে।"
তখন আমি ভেবে-চিন্তে একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তরুণ মজুমদারকে দিই। উপন্যাসটার নাম 'চাঁদের বাড়ি'। তখনও সেটা বই হয়নি, কিন্তু আমি নাম দিয়ে ফেলেছি 'চাঁদের বাড়ি'। আগে কখনও কোথাও বলিনি, আজ বলি, এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি কিছু জায়গায় প্রকাশের চেষ্টা করেছিলাম আমি। প্রত্যেকটি জায়গা থেকে আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। এমনকী, 'চাঁদের বাড়ি' নামটি শুনে কেউ কেউ বলেছেন, "এটা কোনও নাম হলো? 'চাঁদের পাহাড়' আছে শুনেছি, 'চাঁদের বাড়ি'!" উপন্যাসটা তখন কেউ পড়েও দেখেনি। যাই হোক, আমার এই একটা সম্পদ ছিল তরুণবাবুকে দেওয়ার মতো। 'চাঁদের বাড়ি' একদম পরিবার নিয়ে গল্প। আরও দু'-তিনটে গল্প-সহ 'চাঁদের বাড়ি' আমি ওঁর কাছে পৌঁছে দিলাম।
উনি বলেছিলেন, গল্প খুঁজছেন, তার মানেই সেই গল্প নিয়ে ছবি করবেন কি না, তা তো তখন জানি না। কিন্তু তখনই আমার পা যেন আর মাটিতে নেই। আত্মহারা হয়ে গেছি প্রায়। আমার গল্প তো উনি নিয়েছেন, ছুঁয়ে দেখেছেন পাণ্ডুলিপিটা। কার না গল্প নিয়ে ছবি করেছেন! তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই বিভূতিভূষণ (বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুখোপাধ্যায়), প্রেমেন্দ্র মিত্র, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু...কত নাম করব! সাহিত্যধর্মী ছবি করিয়ে হিসেবে তরুণ মজুমদার বাংলার অন্যতম সেরা তো বটেই, দেশ তথা আন্তর্জাতিক স্তরেও তাঁর খ্যাতি। তিনি আমার মতো এক নগণ্য লেখকেরও গল্প চাইলেন! যা পড়লে লোকে হাসে, পরিবারের গল্প লিখছি বলে যা নিয়ে লোকে পরিহাস করে, সেই গল্প তো আমার থেকে তিনি চেয়ে নিলেন!
এরও প্রায় একমাস পরের কথা। আমার মোবাইল ফোনে আবার ফোন। আবারও ওপার থেকে, "আমি তরুণ মজুমদার বলছি।" ওঁর এইটা ট্রেডমার্ক ছিল বলা চলে। বললেন, "আমি বর্ধমান থেকে ফোন করছি।" আমার মনে আছে আজও সেদিন ওঁর বলা কথাগুলো।
"আমি আপনার গল্পটা পড়েছি। আপনি আমায় একটু সময় দেবেন কথা বলার?"
আমি বললাম, বলুন কী কথা?
ওঁর ভদ্রতা তো চরম। শেখার মতো বাঙালি ভদ্রতা! কোথাও বিনয় নেই, কিন্তু অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মার্জিত আচরণ। প্রায় আধঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন সেদিন। আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, বা বলা ভালো, জেরা করলেন, কড়া জিজ্ঞাসাবাদ এবং জেরা। "এই জায়গাটা আপনি লিখেছেন কেন... আচ্ছা ওই চরিত্রটা কোত্থেকে এল... আচ্ছা, আপনি যে বলছেন, এ ওকে ভালবাসে, কিন্তু মনের মধ্যে অনেক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, আবার সামনে তা প্রকাশ করে না, রাগ দেখায়- এই কথাটার কোনও মানে হলো, বলুন তো? একজন একজনকে ভালবাসে, আবার সামনে রাগ দেখায়- এটা আপনি বলছেন কেন?"
আমি আমার মতো উত্তর দিয়েই যাচ্ছি, আর উনি আমাকে ক্রস করেই যাচ্ছেন। আমি যে উত্তর দিচ্ছি, সেটা সবসময় ওঁর পছন্দ হচ্ছে না, সেকথা উনি বলছেন। বলছেন, "আচ্ছা, এই যে আপনি বললেন যে, একজন আরেকজনকে ভালবাসে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না, লেখায় তো আপনি দিব্যি সেটা লিখতে পারলেন, কিন্তু ছবিতে আমি কী করে দেখাব?" সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটা চরিত্র করেছিলেন, যে গ্রাম থেকে এসে এই বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সেই মানুষটা আস্তে আস্তে ওই বাড়ির লোক হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা করেছেন। একটা মানুষ কেন ওই বাড়ির লোক হয়ে যাবে, এই প্রশ্নটা করে আমার ভাবনাটা বুঝে নিতে চেয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, একটা সাহিত্য, একটা উপন্যাসকে উনি কীভাবে ভেঙেচুরে তার প্রতিটি ধাপ বুঝে নিতে চাইছেন। মনে হচ্ছে যেন, মৌচাক থেকে মধু বের করার চেষ্টা করছেন। বড় সাহিত্যরসিক না হলে কিন্তু এমনটা হয় না।
শেষে বললেন, "আমি বর্ধমান থেকে ফিরছি আরও একমাস পরে। এবং আমি আবার বসব!"
'চাঁদের বাড়ি' বইয়ের প্রচ্ছদ
আমার উপন্যাসের সঙ্গে উনি কিছুটা সংযোজন করলেন। কিছু বাদ দেননি। আমার মনে আছে, তরুণ মজুদারের মতো শিল্পী কীভাবে একটা কাজ করেন, তা দেখার জন্য আমি বহু দিন ছবির শুটিং দেখেছি। কীভাবে উনি আমার ভাবনাকে ক্যামেরার লেন্সে ধরছেন, আমি দেখতাম। আমি ওঁকে দেখতাম, উনি আমাকে মাঝে মাঝে ডেকেও নিতেন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার জন্য। কী ভালো লেখালিখি হচ্ছে, তা নিয়ে কথা হতো।
এরপর আমার 'ভালবাসার বাড়ি', যা 'আজকাল' পত্রিকা-র 'রবিবাসর'-এ প্রকাশিত হয়েছিল, সেই কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন তরুণ মজুমদার। আমার মনে আছে, ২০০৭-এ মুক্তি পেল 'চাঁদের বাড়ি'। সাহিত্যকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়, তা ওঁকে দেখে শেখার। আমার মনে আছে, কলেজস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আমরা একসঙ্গে, আমি আর তরুণ মজুমদার, ভিড় হয়ে যাচ্ছে চারপাশে। মানুষ চিনতে পারছে, তিনি কিন্তু সেসব খেয়ালই রাখছেন না। এত জনপ্রিয় একজন মানুষ, ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন আমার সঙ্গে। আমাকে বলেছিলেন, "দেখুন 'চাঁদের বাড়ি' ছবি হলো। আপনি তো লেখক, এবার কিন্তু ছবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এবার আপনার আরেক রকম পরিচয় হয়ে যাবে। আপনার ভালোও লাগতে পারে, মন্দও লাগতে পারে।"
উনি প্রচারে বারবার উল্লেখ করেছিলেন, গল্পের কাহিনিকার প্রচেত গুপ্ত। কাহিনিকার প্রচেত গুপ্ত বললে তাঁর ছবির দর্শক কিন্তু একজনও বাড়বে না ২০০৭ সালে। আসলে উনি যে একটা কাহিনি নিয়ে করেছেন ছবিটা, সাহিত্যনির্ভর ছবি করেছেন, এটা উনি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন প্রচারে। বলতে দুঃখ লাগে, কিন্তু এটা তো সত্য, এখন তো চারপাশে দেখি কাহিনিও পরিচালকের, গানও পরিচালকের, সংগীতও পরিচালকের; এমনকী, দর্শকও হয়তো পরিচালক, তেমনটাই বলতে ইচ্ছে করে। সবাই ভাবেন, আমি সত্যজিৎ রায় হয়ে গিয়েছি বোধহয়। ভাবেন, ক্যামেরা ধরলেই ছবি। কিন্তু এ-বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই, বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ সাহিত্য অবলম্বনে তৈরি ছবির যুগ, কোনও সন্দেহ নেই। যখন রাত্রি ন'টার শো হাউসফুল হতো, ১০ দিন বা এক সপ্তাহ আগে টিকিট কাটতে হত। রুচিশীল, পড়াশোনা জানা, স্পর্শকাতর, সচেতন মানুষ বাংলা ছবি দেখতে যেতেন। সেই ছবি হতো সাহিত্যধর্মী। এবং যে ক'জন এই কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম, এই স্বর্ণযুগের স্থপতিদের একজনের নাম তরুণ মজুমদার।
'ভালবাসার বাড়ি' যেদিন বেরল, সকালে গল্পটা পড়ে বললেন, "কাউকে দেবেন না, বেশ ভাল ছবি হয়।" যথারীতি ছবি হলো, যথারীতি আবার ডাকলেন। তবে এটি ছোটগল্প, ফলে, ওঁকে অনেকটা সংযোজন করতে হয়েছে। আমাকে চিত্রনাট্য শুনিয়ে সংযোজন করেছেন। 'চাঁদের বাড়ি'-র সময়েও আমরা সবাই বসে চিত্রনাট্য শুনেছিলাম, মনে আছে। একটা কথা আমাকে বলেছিলেন, যে, "একটা মাটি দিয়ে আপনি মূর্তি বানিয়েছিলেন, আমি মূর্তিটা ভেঙে দিলাম। কিন্তু আপনার মাটি দিয়ে আমি আরেকটা মূর্তি বানাব। আপনার সাহিত্য, আমার ছবি। মাধ্যম আলাদা। কিন্তু আমি তো আপনার মাটিটাই খুঁজেছি এতদিন।"
গর্ব হয় ভেবে, যিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'গণদেবতা' করেছেন, তিনি প্রচেত গুপ্তর লেখা নিয়েও ছবি করছেন। আসলে নাম বড় নয়, সাহিত্যনির্ভর ছবি করার তাগিদটাই আসল। প্রথমদিকে আমার গর্ব হতো খুব, তারপর সেই গর্ব চলে গেল। ওঁর মতো মানুষের সঙ্গে থাকলে গর্ব-টর্ব থাকে না, তখন শিক্ষাটাই জরুরি, সেটাই পাওনা। আমি এই ২০২২ পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে মিশেছি, মানে এই বছর অবধি। টেলিফোনে কথা হয়েছে, দেখাও হয়েছে, প্রচুর অনুষ্ঠান একসঙ্গে করেছি। খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আমাদের। তা ব্যক্তিগত কথা, ব্যক্তিগত থাকাই ভালো হবে।
একটা ঘটনা বলে শেষ করি। চন্দননগরের একটা বইমেলা উদ্বোধনে গিয়েছিলাম। তরুণবাবুও গিয়েছেন। তখন সবে 'চাঁদের বাড়ি' মুক্তি পেয়েছে, খুব হইচই ওখানে। উনি বলেছিলেন সেই সভায়, "আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, যাঁরা অভিভাবক, আপনাদের যত কষ্টই হোক, প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জন্য একটা ছোট্ট আলমারি দিন, বা একটা লাইব্রেরি করে দিন তাকে। নিদেনপক্ষে একটা ছোট্ট তাক দিন, যেখানে গল্পের বই থাকবে, সিলেবাসের বাইরের বই থাকবে।" কথাটা আমি এখন ওঁর কাছ থেকে ধার করেছি, আমি সব জায়গায় বলি ওঁর নাম করে। আমার ধারণাই ছিল না, এমন করে কেউ বলতে পারে।
এই হলেন তরুণ মজুমদার। আমার তাঁকে প্রণাম, আমার কাছে তো উনি থেকে যাবেন, মননে, চেতনায়।