তরুণ মজুমদার জানতেন, রাজনীতির চেয়ে মনুষ্যত্বর বয়স বেশি
আমার মনে হয়, বাংলা চলচ্চিত্রে একদিকে যেমন ঋত্বিক ঘটক কাহিনিকে ভেঙেচুরে শিল্পের এক কাঞ্চনজঙ্ঘা তৈরি করেন, অন্যদিকে তরুণ মজুমদার কিন্তু গল্পের পর গল্পে টিলার পর টিলা তৈরি করে রাখেন ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা উপত্যকায়।
হয়তো নবতিপর তরুণ মজুমদার আর ছবি করতে পারতেন না, কিন্তু তাঁর প্রয়াণ আমাদের চলচ্চিত্র-ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু জরুরি প্রশ্ন পুনরুত্থাপন করল। প্রথমত, কোনও রহস্যজনক কারণে, মূলত ফিল্ম সোসাইটির সৌজন্যে, আমরা ভাবতে চাইছিলাম যে, জনপ্রিয়তা বোধহয় শিল্পে উত্তরণের প্রতিবন্ধক। এর একটা কারণ, যখন স্বাধীনতার বছরে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির পত্তন হয় তখন সেই সোসাইটির মূল প্রতিনিধিরা- সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমুখ, বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, চলচ্চিত্রে রুচির ক্ষেত্রে একটি প্রতিপ্রস্তাব প্রয়োজনীয়, যাতে বাস্তববোধ কখনওই অতিশয়োক্তিপরায়ণ হবে না এবং সংগীতের প্রয়োগ থাকবে সীমিত। বলা বাহুল্য, তাঁরা সিনেমাকে সাহিত্যের অনুবাদ ভাবতে রাজি ছিলেন না আর। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে ছয় এবং সাতের দশকে আমরা ক্রমাগত বাংলা ছবির মূল ঘরানার প্রতিনিধিকে অস্বীকার করে গিয়েছি। কাগজের পর কাগজে নির্মল দে, অজয় কর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, বিভূতি লাহা, অসিত সেন, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, তপন সিংহ ও তরুণ মজুমদারকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি। এমনকী, তপন সিংহ মধ্য-ষাটে যে অসামান্য ছবিটি করেছিলেন, 'গল্প হলেও সত্যি', তাতে ত্রুফোর উচ্চারণে যে তাচ্ছিল্য ছিল, তাতেই বোঝা যায় যে, তপনবাবু একটি প্রজন্মের বিলাপ ছুড়ে দিতে চাইছিলেন এই মধ্যবিত্ত এস্টাবলিশমেন্টের রুচির দিকে। আজ তরুণবাবুর প্রয়াণে আবারও প্রমাণিত হচ্ছে যে, গল্প বলার সুচারু দিকটি শিল্পের পরিপন্থী নয়।
এক ঐতিহাসিক সমাপতন হলো এই যে, তরুণ মজুমদারের জন্ম এবং ভারতীয় ছবির সবাক হওয়া একই বছরে। এই যে আমাদের ছবিতে শব্দ জুড়ল, তাতে দেশের এক নম্বর প্রযোজক বীরেন সরকার অন্তত বুঝেছিলেন যে, বাঙালিরা গল্প শুনতে ভালবাসে আর শরৎচন্দ্রকে শিরোভূষণ করে বাঙালি লেখকদের দিয়ে যদি গল্প বলানো যায়, তাহলে সেই ছবির জনভিত্তি এবং তার মান্যতা অন্য পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে। একথা তাঁরা প্রমাণও করতে পেরেছিলেন। যদি আমরা সে-যুগের অন্য স্টুডিওগুলোর দিকে তাকাই, যেমন তৎকালীন বম্বে-র বম্বে টকিজ, পুনে-র প্রভাত স্টুডিও, বা মাদ্রাজের জেমিনি- তাহলেই বোঝা যাবে যে, তখনকার বিখ্যাত 'ফিল্ম ইন্ডিয়া' পত্রিকা কেন লিখছে "It is new theatres against the entire lot of producers. Whether from Bombay, Calcutta or the Punjab. It is sheer quality against so much quantity." ফরাসি চলচ্চিত্রের স্রষ্টা গোদার একবার হলিউড প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন- "মার্কিনিরা ভালো গল্প বলতে পারে, আমরা পারি না।" গোদার বস্তুত জানাতে চাইছিলেন, ফরাসিরা ছবি বলতে শুধু আখ্যানভাগ বোঝে না। ওই মন্তব্য বাঙালিদের সমন্ধেও প্রযোজ্য।
মধ্যবিত্ত বাঙালি ছবিঘরে যায় আলোকচিত্রায়িত কাহিনি দেখতে। বীরেন সরকার আমাদের সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতা জানতেন, সুতরাং তিনি সে-যুগের তরুণ গদ্যশিল্পীদের সাহায্য নিলেন। ক্রমে ক্রমে শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত চিত্রনাট্যকার হিসেবে বাংলা ছবিতে যোগ দিলেন। ফলে এক তুলনামূলক আভিজাত্য বাংলা চলচ্চিত্র-ঘরানায় দেখা দিল আর সাহিত্যের জমিতে পা থাকায় নিউ থিয়েটার্সের বাণিজ্য-সফলতাও ছিল সুনিশ্চিত। আজ চলচ্চিত্রের বিশেষজ্ঞরা এদেশে-ওদেশে স্টুডিওর গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করেন। হলিউডের শিল্পসাফল্য নিয়ে কথা বলার সময় লক্ষ্মী ও সরস্বতী- উভয়েরই বরপুত্র বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা জন ফোর্ড বলেছিলেন, "আমাদের পেশায় শৈল্পিক ব্যর্থতার কোনও দামই নেই; অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যর্থতা হলো শাস্তি পাওয়া। রহস্য হলো, কী করে সেইসব চলচ্চিত্র বানানো যায়, যা জনসাধারণকে খুশি করবে, আর সুযোগ দেবে পরিচালককে ব্যক্তিত্বের উন্মোচনের।" এই রহস্য ভেদ করতেই স্টুডিও ব্যবস্থার অভ্যুদয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন এমজিএম বা প্যারামাউন্ট, ভারতেও তেমন নিউ থিয়েটার্স বা অন্যান্য স্টুডিও। একদা প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বসু বা বিমল রায়ের মতো পরিচালকরা নিউ থিয়েটার্সের স্নেহচ্ছায়াতেই পল্লবিত হয়েছেন। আমি বলব, তরুণ মজুমদার এই ঘরানার শেষ প্রতিনিধি। বাঙালিরা যে ছবি বলতে 'বই' বোঝে, তা শেষবারের মতো প্রমাণ করে গেলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর ছবি দেখলে মূলত আমরা সাহিত্যকেই এক সুন্দরতর চিত্রনাট্যে সুন্দরতমভাবে পরিবেশিত হতে দেখি।
বম্বেতে যেমন বিমল রায় এক ধরনের গল্প বলার ঐতিহ্যের প্রবর্তন করেছেন নিউ থিয়েটার্সের সৌজন্যে, তেমন কলকাতাতেও এই গল্প বলার ঐতিহ্যটি নির্মল দে থেকে তরুণ মজুমদার পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে গেছে। আজ আর গল্প বলার কেউ রইল না। তরুণ মজুমদারের ছবিতে এই যে অদূরের 'পশ্চিম'- এও তো অনেকটা নিউ থিয়েটার্সের অবদান। ১৯৩৭ সালে যখন 'মুক্তি' ছবিটির চিত্রনাট্য রবীন্দ্রনাথের সামনে প্রমথেশ বড়ুয়া পড়েছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথই অদূরবর্তী আসামের গৌরীপুরের নিসর্গমায়ায় অভিভূত হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ছবিটার নাম দাও 'মুক্তি', এতে অবকাশ আছে। প্রমথেশ বড়ুয়া সেই যে 'মুক্তি'-র নাম দিলেন, তাতেই কিন্তু দেখা যায়, তরুণ মজুমদারের 'বালিকা বধূ' বা 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' বা 'দাদার কীর্তি' যে অদূরের বাংলাকে সম্বল করে গড়ে ওঠে, যেখানে মায়া ও অলীক শান্তিনিকেতন আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখছে।
তরুণ মজুমদারের ছবির দিকে যদি তাকাই, তাহলে একথা ঠিক, তার কোনও কাহিনি বা আখ্যানেই সমকালের স্পর্শ নেই। বস্তুত তিনি হয়তো বিশ্বাসও করতেন রাজনীতির থেকে, ক্ষমতার পদশব্দের থেকেও মনুষ্যত্বর বয়স বেশি। এবং তিনি যে বাঙালিকে দেখেছেন, তারা মধ্যবিত্তের স্বর্ণযুগের বাঙালি, যাদের হাসি-কান্না-বিরহ পদ্মপাতায় জলের মতোই ঝলমল করে ওঠে। সেখানে বাজারশোভন বামপন্থা কিংবা ব্যোদলেয়ারীয় নির্বেদের আশা করাই অন্যায়। এই জন্যই আজকে যাঁরা বাংলা সংস্কৃতিতে পাঁচের দশক হিসেবে পরিগৃহীত হন, তাঁদের মধ্যে থেকেও তরুণ মজুমদারের কাহিনিতে কোনও ময়লা দাগ নেই, তিক্ততা, রিরংসা নেই। একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় যা সহজেই চোখে পড়ে, এমন ক্ষয় ও পতন; অথবা অলোকরঞ্জন বা শঙ্খ ঘোষের সাংকেতিক জগতও তাঁর নয়। তিনি আমাদের দৃশ্য-সংস্কৃতিতে স্মৃতির কিছু মূল্যবান নুড়িপাথর, যা শৈশবের বলেই হয়তো ফেলে দেওয়ার নয়। এবং এই কথা বলার সময় আমি এটা মনে রাখছি যে, এই যে গল্প বলা, সেটা শুধুই সাহিত্যিক ধরনের গল্প বলা নয়, যদি তরুণ মজুমদারের পলাতক ছবিটির দিকে তাকাই, যদি 'সংসার সীমান্ত'-কে বেছে নিই, তাহলে দেখা যাবে 'পলাতক'-এ আলোকচিত্রের যে মহিমা, সৌম্যেন্দু রায়ের দিনে তোলা রাত্রির ফোটোগ্রাফি, বা ধরা যাক 'বালিকা বধূ'-তে মাস্টারমশাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় যে ইম্প্রেশনিস্ট আলো, অথবা 'সংসার সীমান্তে'-তে যে ধরনের প্রামাণ্য গণিকাপল্লী তিনি রচনা করেন, তাতে বোঝা যায় যে, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে নিউ থিয়েটার্সের যে সিনেমা-বিষয়ক শৃঙ্খলা, তা হেঁটে চলেছে। আজ আর অস্বীকার করে লাভ নেই যে, ১৯৭০-'৮০ পর্যন্ত যে তিনটি ছবি তরুণ মজুমদার তৈরি করেন, 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ', 'ফুলেশ্বরী' ও 'দাদার কীর্তি', তা মধ্যবয়সি বাঙালিদের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রেমের মডেল হিসেবে কাজ করে যায়। এই ধরনের প্রেম বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র এমনকী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়েও ছিল না। এই প্রেম সাহিত্যে ছিল না। তরুণবাবু কিন্তু কোনওরকম অতিরিক্ত উচ্ছাস ছাড়াই এই পরিবেশন করেছিলেন, যা বাঙালি আটপৌরে ঘরের পাঁচমিশালি তরকারির মতো স্বাদু ও মনোরম হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, এক ধরনের পারিবারিক ছবি বানানোর দক্ষতা তাঁর ছিল।
সম্প্রতি চিদানন্দ দাশগুপ্তর একটি লেখায় দেখছি যে, এই যে চলচ্চিত্রে রুচি নির্মাণের আন্দোলন, তার ফলে একটা ক্ষতি হয়েছে যে, শিল্পরচনার আগ্রহে পারিবারিক ছবি বা সকলে মিলে দেখার ছবি, তা থেকে জনসাধারণ বঞ্চিত হয়েছে এবং এই বঞ্চনা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তরুণ মজুমদার আমাদের এক ধরনের পোতাশ্রয় ছিলেন। তার প্রথম ছবি উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেনকে নিয়ে হলেও তিনি নক্ষত্রব্যবস্থার বাইরে, এমনকী, এই যে স্বাধীন শিল্পসত্তা নির্মাণের চেষ্টা সত্যজিৎ-ঋত্বিক প্রমুখের, তার বাইরে শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন যে, যেহেতু চলচ্চিত্র জনহিতায় চ, সুতরাং তাকে একটি সমবায় প্রথার মধ্যে আনা যায় কি না। এতে তিনি একা নন, বিভূতি লাহা ছিলেন, আরও অনেকেই ছিলেন। এই যে অগ্রগামী, অগ্রদূত এবং যাত্রিকের যে প্রয়াস, তা উপেক্ষা করার নয়। স্টুডিও যুগের অবসান আর ব্যক্তিযুগের পত্তনের মধ্যে এই যাত্রিক ছিল একটি সাঁকো। মনে রাখতে হবে, যে 'পলাতক'-এর মতো ছবিতে যখন তিনি অনুপকুমারের মতো একজন গৌণ ব্যক্তিকে নায়ক করার প্রস্তাব রেখেছিলেন, বাঙালি প্রযোজকরা রাজি ছিলেন না। সেই ছবিতে কিন্তু টাকা ঢালতে হয়েছিল ভি শান্তারামকে। এবং শান্তারামের এই বিনিয়োগের উত্তরে তিনি যে লাভের অঙ্ক তুলে দেন, সেখানেই বোঝা যায় যে, সিনেমা ব্যাবসায় একটা দান-প্রতিদানের অঙ্ক আছে এবং সেখানে পরিচালককে সাফল্য অর্জন করতেই হবে। আলফ্রেড হিচককের মতো বা হিউস্টনের মতো বা ফোর্ড অথবা হাওয়ার্ড হক্সের মতো।
তরুণ মজুমদার আমাদের খুদে ব্যবস্থায় খুদে বাঙালির মতো লক্ষ্মীর খুদে বরপুত্র ছিলেন। যদি আমরা তাঁর অভিনেতাদের লক্ষ করি, তাহলে দেখব 'সংসার সীমান্তে' ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যে অভিনয়, তাই সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ের ছবির বাইরে তাঁর সেরা অভিনয়। এরকম ব্যতিক্রমী চরিত্র যে তৈরি করতে পেরেছিলেন তরুণ মজুমদার, তা নীরবেই পেরেছিলেন। সেটা কম কথা নয়। আমাদের সাংবাদিকরা, আমাদের ফিল্ম সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা কেউই তাঁর দিকে তাকাননি। এবং এখন যখন তাকানো হচ্ছে, তাও কিন্তু মনে করা হচ্ছে, তিনি বামপন্থার এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি, তা নয়। আমার মনে হয়, বাংলা চলচ্চিত্রে একদিকে যেমন ঋত্বিক ঘটক কাহিনিকে ভেঙেচুরে শিল্পের এক কাঞ্চনজঙ্ঘা তৈরি করেন, অন্যদিকে তরুণ মজুমদার কিন্তু গল্পের পর গল্পে টিলার পর টিলা তৈরি করে রাখেন ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা উপত্যকায়। আমাদের দুটো দিয়েই বিচার করা উচিত, নাহলে সিনেমার ইতিহাস রচনা করা যাবে না।