বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া

তিগমাংশু ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তাঁর কাজের দর্শন, ভাবনা, ইরফান খানের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধুত্বের সাতসতেরো।

তিগমাংশু ধুলিয়া বলিউডের প্রসিদ্ধ পরিচালক। 'হাসিল', 'চরস', 'সাহেব বিবি অর গ‍্যাংস্টার', 'শাগির্দ', 'পান সি‌ং তোমর' থেকে 'গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার'-এর মতো ওয়েব সিরিজ- তিগমাংশুর কাজ নতুন আঙ্গিকের জন্ম দিয়েছে বারবার। 'গ‍্যাংস অফ ওয়াসিপুর'-এর রামাধীর সি‌ংয়ের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় ইতিহাস হয়ে উঠেছে। তিগমাংশু ইনস্ক্রিপ্ট-এর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তাঁর কাজের দর্শন, ভাবনা, ইরফান খানের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধুত্বের সাতসতেরো। তাঁর সঙ্গে কথায় সিরাজ মুখোপাধ্যায়, লেখক, চিত্রনাট‍্যকার, অভিনেতা, চিত্রপরিচালক। এই মুহূর্তে মুম্বইয়ে 'ফিঙ্গারপ্রিন্ট ফিল্মস'-এ ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসারের ভূমিকায় রয়েছেন তিনি।

 

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ধন্যবাদ আপনাকে, এই কথোপকথনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। প্রথমেই যে প্রশ্নটা করতে চাইব আপনাকে, আমরা, যারা একটু আগের প্রজন্মের, তারা সিনেমা বলতে এখনও সিনেমা হল বুঝি। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ, সপরিবার সিনেমা দেখতে যাওয়া, পপকর্ন খাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ভালমন্দ নানা কারণে, এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে, এখন মানুষ সিনেমা দেখে কম্পিউটার বা মোবাইলে। আগে যখন কেউ জিজ্ঞেস করত "'হাসিল' (তিগমাংশু ধুলিয়ার প্রথম ছবি) কোথায় দেখলে?", তখন উল্টোদিক থেকে উত্তর আসত, "হ্যাঁ, অমুক সিনেমা হলে দেখলাম।" এখন এই উত্তরটাই পাল্টে গিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নেটফ্লিক্সে দেখলাম বা আমাজনে দেখলাম। এই বদলটাকে আপনি কী চোখে দেখেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: এখন কতজন পিকনিকে যায়? আগে সকলে দল বেঁধে পিকনিকে যেত। কাজেই সময়টা বদলে গেছে। এর একটা নয়, অজস্র কারণ আছে। প্রথমত, প্রযুক্তি এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে। সেজন্য 'সমাজ' বলতে যে বিষয়টাকে আমরা বুঝতাম, তা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। এখন তো আমরা প্রতিবেশীদের চিনিই না, আগে তো এমন ছিল না। আমি তো আমার প্রতিবেশীদের সঙ্গেই হেসেখেলে বড় হয়েছি। মনে আছে, আমার মা যখন কাজের পর বাড়ি ফিরতেন, তখন প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে ফিরতেন। এখন তো আমি আমার প্রতিবেশীদের চিনিই না, কেউই চিনি না আমরা। সমাজে বিচ্ছিন্নতার ফাটল ধরেছে, আর সেখান দিয়ে ঢুকে পড়েছে প্রযুক্তি। সিনেমা দেখতে যাওয়ার মধ্যে একটা যৌথতা আছে, সেই যৌথযাপনটা, একসঙ্গে থাকার মনটা, সেটাই তো নেই এখন।

দ্বিতীয় যেটা বলতেই হয়, মাল্টিপ্লেক্স আসার ফলে সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার ধ্বংস করে গেছে। আর মাল্টিপ্লেক্সে টিকিটের দাম এতটাই বেশি যে, সেটা সাধারণ মানুষ অ্যাফোর্ড করতে পারে না। মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখা মানে একটা বিপুল খরচ। ফলে দর্শকরা বেছে নেয় কোন সিনেমা দেখবে। তারা ঠিক করে নেয় যে, "'বাহুবলী'-টা দেখতে যাব", বাদবাকি ছবিগুলো আর হলে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। সেসব ছবি তারা ওটিটি-তে দেখে।

তৃতীয়ত, ট্রাফিক একটা বড় সমস্যা। ছোট-বড় সব শহরেই, সর্বত্র। ১৫ মিনিটে যেখানে পৌঁছে যাওয়া যেত, সেখানে যেতে এখন ৪৫ মিনিট সময় লাগে। মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে বাড়িতে থেকেই সিনেমা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওইজন্য।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে কাছ থেকে চিনি, তাই জানি, আপনার বাবা এলাহাবাদ হাই কোর্টের একজন বরিষ্ঠ এবং সম্মাননীয় বিচারপতি ছিলেন। এরকম একটা পরিবারের ছেলে হয়ে সিনেমায় এলেন কী করে? আপনার মনে পড়ে, প্রথম কোন সিনেমা দেখেছিলেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: 'হাতি মেরে সাথী'।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আচ্ছা! ভাল লেগেছিল ছবিটা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: ওই ছবিটা তো আমার আজও ভালো লাগে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: কতবার দেখেছেন ছবিটা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: ১১ বার।

Movie Poster

'হাতি মেরে সাথী' ছবির পোস্টার

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: প্রথম ছবিটা দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল মনে পড়ে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: ছোটবেলায় পর্দায় হাতি ইত্যাদি দেখতে তো ভালোই লাগে। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ বছর হবে। '৭১-এর ছবি, '৬৭-তে আমার জন্ম। যাই হোক, তো তখন আমার মা এলাহাবাদ থেকে রায়বেরিলিতে ট্রান্সফার হয়েছেন। মা সংস্কৃতর শিক্ষিকা ছিলেন, সেই কর্মসূত্রেই বদলি হন। আমি তখন ভীষণ ছোট, বড় দুই ভাই ছিল আমার, তারা তখন এলাহাবাদে। আমি সেসময় খুব সম্ভবত বছরদেড়েক মতো রায়বেরিলিতে ছিলাম। বাবা বা অন্য কেউ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত, তার সঙ্গেই ঝুলে পড়তাম সিনেমা দেখতে যাব বলে। সেসময় 'হাতি মেরে সাথী' চলছিল, ফলে, বারবার দেখতে গিয়েছি ওই ছবিটাই‌।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ওই ছোটবেলাতেই ১১ বার দেখেছিলেন ছবিটা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: হ্যাঁ।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: বড় হওয়ার পর আর দেখেননি?

তিগমাংশু ধুলিয়া: পুরোপুরি আর দেখিনি। কিন্তু টুকরো টুকরো দেখেছি। অনবদ্য সব গান ছিল, জাভেদ সাবের (আখতার) লেখা।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: 'হাতি মেরে সাথী' কি আজও আপনার প্রিয়তম ছবিগুলোর একটা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: না, তা বলব না। ছবিটার কিছু কিছু মুহূর্ত ভালো লাগে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: কেমন মুহূর্ত?

তিগমাংশু ধুলিয়া: এই ছবিটায় যখন হাতিটা মারা যায়, আর গান হয়, 'নফরত কি দুনিয়া ছোড়কে পেয়ার কি দুনিয়া মে খুশ রহেনা মেরে ইয়ার'... ওটা দেখে আমি আজও কেঁদে ফেলি।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এই যে সিনেমা দেখে কেঁদে ফেলা বা আনন্দ পাওয়া, এই বোধের জায়গাটা কি আজ আর নেই?

তিগমাংশু ধুলিয়া: হ্যাঁ, এই বিষয়টার খুবই অভাববোধ করি এখন। বিষয়টা কী, এখন আর আবেগগুলো সৎ নয়, একটা ইমোশনাল সিনেমায় আবেগ তৈরি করা হয় বুদ্ধি করে। তা আর স্বাভাবিকভাবে আসেই না। ফলে, খুব কৃত্রিম, সিন্থেটিক হয়ে গেছে সিনেমায় আবেগের চলাচলটা। ওই সময়টা বদলে গেছে, মানুষ বদলে গেছে , দর্শক বদলে গেছে। সবথেকে বড় কথা, সমাজটাই বদলে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে গোটা ব‍্যবস্থাটা, ঘেঁটে গেছে সম্পূর্ণ। যে-সময় সিনেমার খারাপ লোকরাও কিছুটা ভাল ছিল, সেই সময়টা তো এখন আর নেই। সমাজ বদলে গেলে তার ছাপ তো সিনেমায় পড়বেই। সিনেমা তো আর সমাজবিচ্ছিন্ন নয়।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এবার ওই প্রশ্নটায় ফিরে যাই। এমন একটা পরিবার থেকে আপনি এসেছেন, যার সঙ্গে সরাসরি সিনেমার সম্পর্ক নেই। আপনার নাটক বা সিনেমার প্রতি ঝোঁকটা তৈরি হলো কী করে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: বাড়ির সকলেই কমবেশি সিনেমা দেখতে যেত। আমার মেজদার সঙ্গে আমার বয়সের তফাৎ ছিল আট বছরের, আর বড়দার সঙ্গে সাড়ে ন'বছরের। ওরা সিনেমা দেখতে যেত। আমার বাবা-মা আমার জন্মের আগে থেকেই প্রচুর সিনেমা দেখত। বাবা এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছে আইন নিয়ে, বাবা প্রভূত সিনেমা দেখত। মা তুলনায় কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, অতটাও সিনেমা দেখার ঝোঁক ছিল না মায়ের। আমার ধারণা, বাবার থেকেই আমার এই ঝোঁকটা এসেছে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আপনি সমাজের অবক্ষয়ের কথা যে বলছেন, ডিজিটাল অগ্রগতির সঙ্গে হয়তো তার একটা যোগসূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে। এই যে সিনেমা হল থেকে মোবাইলে সিনেমা দেখার বদলটা হলো, এটাকে কীভাবে দেখেন? আপনি মোবাইলে সিনেমা দেখেছেন কখনও?

তিগমাংশু ধুলিয়া: হ্যাঁ দেখেছি।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: কতটা আলাদা এই অভিজ্ঞতাটা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: এটাকে তো কোনওভাবেই সিনেমা হলের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কিন্তু এটা ঠিক যে, এই সুবিধেটা আছে যে, মানুষ যখন চাইবে, তখন দেখতে পারবে সিনেমা। আর এতকিছু রয়েছে ওটিটি-তে, এত বৈচিত্র্য। দর্শক তো আর সব দেখছে না। যা দেখতে চাইছে, সেটা বেছে নিচ্ছে। ফলে, ব্যাপারটা এখন অনেক হাতের মুঠোয়। আর ব‍্যক্তিগতভাবে আমি সিনেমা হলে যাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি। এক্ষেত্রে ট্রাফিকের সমস্যা কোনও কারণ নয়, কারণ আমার বাড়ি থেকে সিনেমা হল দু'পা।   বড়জোর ছ'মিনিট লাগবে পৌঁছতে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: তাহলে যান না কেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: সিনেমা হলটা এখন একটা বারোয়ারি বৈঠকখানা হয়ে গেছে। মানুষ সব সময় ফোনে কথা বলে চলেছে, খাবার পরিবেশন করছে একদল লোক। কম্বল পর্যন্ত দেওয়া হয় এখন সিনেমা হলে। ঘরদোর হয়ে গেছে ওটা। কী ঘটছে পর্দায়, তার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান নেই কারও। ভাবটা এমন যেন, পর্দায় যাদের দেখা যাচ্ছে, বা যারা ছবিটা বানিয়েছে, তারা দর্শকদের চাকর। এই অভিজ্ঞতাটা আমার একেবারেই ভালো লাগে না। আমি তাই ঘরেই দেখি সিনেমা।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: মানুষ ফোনে সিনেমা দেখছে, এটা মাথায় রেখে কি কাজ করেন এখন? মানে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে এই বিষয়টা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: এখন আমি এসব নিয়ে খুব একটা মাথাই ঘামাই না। আগেও যে খুব ভাবতাম তা নয়, মাঝে একটু সচেতন হয়ে পড়েছিলাম, আর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। সেটা করা মোটেই ঠিক হয়নি তখন। যখন সিনেমা বানাতে শুরু করেছিলাম, তখন তো নিজের জন‍্যই সিনেমা বানাতে চেয়েছিলাম। কারণ এই মাধ্যমটাকে আমি ভালবাসি। গল্প বলতে চেয়েছিলাম। ফলে প্রথমে, যখন সিনেমা বানাতে শুরু করেছিলাম, তখন আমার ভাবনাচিন্তা ছিল অনেক সৎ, আমার চেষ্টাটা খুব পবিত্র ছিল, অনেকটা উদ্দীপনা ছিল তাতে। তারপর সেটা পেশা হয়ে গেল। এখানেই হলো গোলমালটা। আমি সত্যিই এখন দর্শক কী চায় না চায়, তা এক পয়সাও পরোয়া করি না। আমি সিনেমা-সিরিজ যাইই বানাই, নিজের জন্য করব। দর্শক, মানুষ, সমাজ সব গোল্লায় গেছে। এদের জন্য আমি ছবি বানাব কেন? হাতে গোনা কিছু লোকের সঙ্গে মনমেজাজ মেলে, তাদের জন্য তো আর ছবি বানানো যায় না। বড়জোর একটা জমায়েত করে সেখানে একক প্রদর্শনী করা যায়।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: নিজের জন্য যা বানাবেন, সেটা আগের চেয়েও ভালো হবে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: তা জানি না। সেটা কী করে বলব? তবে হ্যাঁ, আমি আমার নিজের বিচারক, আমিই সবকিছু। এই বয়সে, এই পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাওয়ার পর তো বটেই।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: অনেকের মনেই একটা প্রশ্ন, তিগমাংশু ধুলিয়া কোনও কমেডি বানাচ্ছেন না কেন? আপনি তো একটাও কমেডি বানাননি...

তিগমাংশু ধুলিয়া: আমি ঠিক জানি না। একটা কমেডির চিত্রনাট্য লিখব, এরকম কখনও ভাবিনি আমি। নিজের ব‍্যক্তিগত পরিসরে আমি হাসিঠাট্টা করতেই পারি। আমি জানি, আমি ভালো কমেডি বানাতে পারি। কিন্তু কখনও ভাবিনি বানানোর কথা।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: নিঃসন্দেহে এর মতো সৎ উত্তর আর হয় না। এবার একটা প্রশ্ন চলেই আসে। মেগাস্টার‌দের যে ব্লকবাস্টার ছবিগুলো, সেগুলো পরের পর ফ্লপ করছে। দর্শক দেখছে না। কেন এটা হচ্ছে বলে মনে হয়?

তিগমাংশু ধুলিয়া: তার একটা বড় কারণ আমার মনে হয়, ছবিগুলোই খারাপ। মানুষ এখন আন্তর্জাতিক কনটেন্টের সঙ্গে পরিচিত। খুব ভালো কিছু না হলেও মার্ভেল মুভিজ তো দেখছে। সুপারহিরো ছবিগুলো সব দেখছে। সেগুলো তো টেকনিক্যাল দিক থেকে ঢের এগিয়ে আমাদের চেয়ে। আর যা বললাম, আবেগটা আরোপিত, জোর করে চাপানো। বিশেষত, হিন্দিতে। দক্ষিণে সৎ ছবি হচ্ছে বলে সেই ছবি অনেক বেশি সফল। ব্যক্তিগতভাবে আমার 'আরআরআর' যেমন খুব পছন্দ হয়েছে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এবার বাঙালি পাঠকদের হয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য অ্যাডপ্ট করতে চান না? শেক্সপিয়র যেমন অনেকেই অ্যাডপ্ট করে। সত‍্যজিৎ রায় হিন্দি সাহিত্য থেকে ছবি করেছেন। আপনি কখনও ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ছবি করার কথা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: রবীন্দ্রনাথের কিছু নাটক আমি পড়েছি, আর পড়েছি 'গীতাঞ্জলি'। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু পড়িনি। তবে রবীন্দ্রনাথের নাটক আমি করেছি, যেমন 'রাজা' করেছি, আর একটা কিছু করেছিলাম কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে। কিন্তু সেভাবে রবীন্দ্রনাথ অ্যাডপ্ট করার কথা কখনও ভেবে দেখিনি।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: কোনও সুযোগ যদি কখনও সামনে আসে, তাহলে করবেন? কোনও ভালো লেখকের সঙ্গ যদি পান...

তিগমাংশু ধুলিয়া: এখন প্রশ্নটা শুনে মনে হচ্ছে, করতেই চাইব। তবে আগামী দু'-তিন বছরে তো নয়। অন্য কিছু পরিকল্পনা রয়েছে আমার।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এবার একটা প্রশ্ন চলেই আসে, 'গ‍্যাংস অফ ওয়াসিপুর'-এর দশ বছর। রামাধীর সিং তো কাল্ট হয়ে গেছে! তারপরেও বেশ কিছু অভিনয় করেছেন। অভিনয় তো বেশ উপভোগ করছেন আপনি!

তিগমাংশু ধুলিয়া: আমার তো মনে হয়, অভিনয় সবচেয়ে সহজ আর্ট ফর্ম। এমনকী, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সহজ ধারা এইটাই। অন্তত হিন্দিতে তো বটেই।

Movie Scene

রামাধীরের চরিত্রে

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: কেন বলছেন একথা?

তিগমাংশু ধুলিয়া: কারণ, অভিনয় করার জন্য সে অর্থে কোনও পরিশ্রম করতে হয় না। বাকি সবাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। তোমার একটা মেক আপ ভ্যান থাকবে নিজস্ব। তোমার মেক আপ অন্য লোক করে দেবে। অ্যাসিস্ট‍্যান্ট ডিরেক্টররা আছে অন্য আরেকজনের লেখা চিত্রনাট্য তোমাকে পড়িয়ে, বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। ক্যামেরাম্যান আলো সাজিয়ে দিচ্ছে। পরিচালক তোমাকে সবটা বুঝিয়ে দেবে। সবাই তোমার জন্য সবকিছু করে দেবে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ন‍্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে আপনি অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু প্রথমদিকে তো আপনি অভিনয় করেননি। একসময় হঠাৎ করেই শুরু করলেন। নিশ্চয়ই অভিনয় উপভোগ না করলে করতেন না।

তিগমাংশু ধুলিয়া: যখন আমি অভিনয় করছি, তখন সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই কাজটা করি। নিজের বুদ্ধি, চেতনা দিয়ে চিত্রনাট‍্যটাকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টাটুকু অন্তত করি। নিজের মতামত, পরামর্শ দিই। কখনও টাকার জন্য সেটা করি, কখনও বন্ধুদের জন‍্য করি।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এবার প্রশ্ন ইরফান খানকে নিয়ে। আপনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল। এনএসডি-তে আপনার সিনিয়র ছিলেন ইরফান। কবে, কোথায় ইরফানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মনে পড়ে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: র‍্যাগিংয়ের সময় দেখা হয়েছিল প্রথম। সবার সঙ্গে সবার র‍্যাগিংয়ের সময়েই পরিচয় হতো।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: র‍্যাগিং বলতে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: র‍্যাগিং বলতে সেরকম নয়, সবার সঙ্গে সবার আলাপের পর্ব ছিল ওটা। মনে আছে, ইরফান আর সুতপা এককোণে বসে থাকত। খুব বেশি কথা বলত না। ইরফানের খুব বেশি বন্ধু ছিল না। যাই হোক, প্রথম পারফরমেন্স দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম ইরফান কী করতে পারে, কতটা ক্ষমতা রাখে ও! ওই একই নাটকে ক্লাসের বাকিরাও অভিনয় করছে, তাদের মধ্যে আশ্চর্য আত্মপ্রদর্শনের প্রবণতা। জ্যাক নিকোলসন যেমন অভিনয় করেন না, আমাকে দেখো গোছের! সবাই নিজেদের দেখাতে ব‍্যস্ত ছিল। ইরফানই একমাত্র যেন বলছিল, অভিনেতাকে নয়, চরিত্রকে দেখো। সেখানেই ও আলাদা। আমি দু'-বছরের জুনিয়র ছিলাম। সেই নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আপনি তো শেখর কাপুরের সহকারী পরিচালক ছিলেন 'ব্যান্ডিট কুইন'-এ। সেসময়ই নাকি আপনি 'পান সিং তোমর' করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: হ্যাঁ, সেসময় থেকেই গবেষণা শুরু ক‍রি, গল্পটা ভাবতে শুরু করি। নিশ্চিত ছিলাম যে, একদিন না একদিন এই সিনেমাটা আমি বানাবই।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: 'ব্যান্ডিট কুইন'-এর সময়ে আপনি পান সিং তোমরের গল্পটা জানতে পারেন। এবং সেসময়েই সিদ্ধান্ত নেন, এই বিষয়ে সিনেমা বানাবেন। কিন্তু আপনি সঠিক অভিনেতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

Movie Scene

'পান সিং তোমর'-এর একটি দৃশ্যে ইরফান খান ও নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি

তিগমাংশু ধুলিয়া: না, না। ব্যাপারটা তেমন নয়। এটা তো একটা সত্যি ঘটনা। কিন্তু এবিষয়ে কোথাও কোনও তথ্য ছিল না। তখন ইন্টারনেট এত সুলভ নয়। ফলে যথেষ্ট গবেষণা করে উঠতে পারছিলাম না, যার ওপর নির্ভর করে একটা চিত্রনাট্য লেখা যায়। ইউটিভি-তে গিয়ে যখন সিনেমাটা করার প্রস্তাব রাখি, তখন ওরা বলে, চিত্রনাট্য লিখে তারপর এসো। এরপর আমি গবেষণা করতে শুরু করি পুরোদমে। যখন সব তথ্য পেলাম, চরিত্রটা যখন পরিষ্কার হয়ে উঠল, বুঝলাম, ইরফান ছাড়া এই চরিত্রটা কেউ করতে পারবে না। ততদিনে আমি ওর সঙ্গে কাজও করে ফেলেছি।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ইরফান নাকি কাজ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন, আপনি বলেছিলেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডটা নিয়ে তারপর যেও। এটা কি সত্যি?

তিগমাংশু ধুলিয়া: সত্যিই মনে নেই, এমন কিছু আমি বলেছিলাম কি না। আমি কী করে নিশ্চিত হব যে আমি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাবই? হয়তো ইরফানকে একটু উদ্বুদ্ধ করার জন্য এমনটা বলে থাকতে পারি। তবে আমার খুব একটা মনে নেই।

Movie scene

দুই বন্ধু। 'হাসিল'-এর সময়

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ইরফান তো আপনার কাছে কেবল অভিনেতা নয়, খুব ভাল বন্ধুও বটে। কোনও চরিত্রের জন্য ইরফান কীভাবে প্রস্তুত হতেন? আপনার থেকে শুনতে চাই...

তিগমাংশু ধুলিয়া: ও যেসব চরিত্র করেছে, তার কোনওটার জন্যই শারীরিক প্রস্তুতির দরকার পড়েনি। প্রয়োজন হত মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির। 'বেঞ্জামিন বাটন'-এর মতো চরিত্র তো আর ইরফান করেনি। ওই ধরনের শারীরিক প্রস্তুতির কোনও অর্থ ছিল না ওর কাছে। ইরফান ছিল এক জন চিন্তাশীল অভিনেতা। সব সময়েই চরিত্র নিয়ে ভাবত ও। কখন যে চরিত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করত, বুঝতে পারতাম না।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: অনেক পরিচালক অভিনয় করে দেখান শিল্পীদের। ইরফানের সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কি সেরকমই ছিল?

তিগমাংশু ধুলিয়া: ইরফান ছিল বাকি সব অভিনেতার থেকে আলাদা। ওর মতো কাউকেই আর দেখিনি কখনও। চরিত্র আয়ত্ত করার দক্ষতার কথা বাদই দিচ্ছি, গোটা চিত্রনাট্যটাই ও আত্মস্থ করত। শুধু নিজের অভিনেতার ব্যাপারে নয়, চিত্রনাট্যে কোথায় কী গলদ আছে, কেমন হওয়া উচিত, এসমস্ত দিকে ওর নজর ছিল এবং তা নিয়ে কথাও বলত। নিজের চরিত্রের মধ্যেই শুধু সীমিত থাকত না ইরফান।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: মানে চিত্রনাট্য ঘষামাজা করার ব্যাপারে ইরফানের সাহায্য আপনি পেতেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ইরফানের সঙ্গে আমার একটা নির্দিষ্ট সমঝোতা ছিল। দু'-তিনটি দৃশ্য কখনও গোটা গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেইসব দৃশ্যগুলোর সংলাপ নিয়েও ওর সঙ্গে আমার কথা হত। 'পান সিং তোমর'-এর ক্ষেত্রেও আমার হয়েছিল। যে দৃশ্যে ইরফান জাহাঙ্গিরকে মারছে, সেই দৃশ্যের সংলাপ আমি আর ও আলোচনা করেই ঠিক করেছিলাম।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আপনার প্রথম ছবি 'হাসিল'-এ একটা দৃশ্য আছে, সেখানে ইরফান চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় বসে। এবং ওর মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে। সেই দৃশ্যটার ব্যাপারে কিছু মনে আছে আপনার?

তিগমাংশু ধুলিয়া: ওই দৃশ্যটা খুব জরুরি। বিস্ফোরণটা হয় বলেই ইরফানের চরিত্রটা আশুতোষ রানা অভিনীত চরিত্রটাকে খুন করতে সাহস পায়। ওই দৃশ্যে ইরফানের অভিনয় সিনেমাটাকে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিয়েছিল।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে একটু আভাস দেওয়া যায়?

তিগমাংশু ধুলিয়া: কিছু কাজ তো এখন করছিই। তাছাড়াও একটা চিত্রনাট্য মাথায় আছে। সেটা কে আসিফের একটা বায়োপিক। যিনি 'মুঘল-এ-আজম' বানিয়েছিলেন। ঠিক আড়াইখানা ছবি করেছিলেন, তারপর মারা গিয়েছিলেন। কে আসিফ ছিলেন জিনিয়াস। তাঁর জীবনটা, তাঁর সিনেমা বানানোর গল্পগুলো তুলে ধরতে চাই। এছাড়াও আমি আরেকটা সত্যি ঘটনা নিয়ে একটা ছবি করতে চাই। গাড়োয়াল রেজিমেন্টের একজন ধরা পড়েন আফ্রিকায়। একটা পিওডব্লু ক‍্যাম্পে তাঁকে রাখা হয়। কীভাবে তিনি পালিয়েছিলেন, সেই গল্পটা বলার ইচ্ছে আছে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আজকালকার অভিনেতারা কথায় কথায় বলে 'স্ট্রাগল' করছি। তাঁদের কাছে অভিনয় প্রস্তুতি মানেই জিম যাওয়া আর বাইসেপ্স বানানো। এদের প্রতি আপনার কোনও উপদেশ আছে?

তিগমাংশু ধুলিয়া: আমি বলেছি বটে, হিন্দি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য কোনও পরিশ্রম লাগে না। কিন্তু আমি অভিনয়ের প্রক্রিয়াটা কিছুটা হলেও জানি। আমি যেহেতু এনএসডি থেকে প্রশিক্ষিত অভিনেতা, এ ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলতে পারি৷ যারা শুধু শরীর বানিয়ে অভিনয়ের দক্ষতা আয়ত্ত করতে চায়, তারা একটা ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে রয়েছে। অভিনয় ভুলে যাও। এমনকী, সহকারী পরিচালকরাও এখন 'জ্যাক অফ অল ট্রেড', 'মাস্টার অফ নান' হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা যে কোনও কাজ করতেই প্রস্তুত। সে ছোট কোনও কাস্টিং এজেন্সি হোক বা চ্যানেল। আরে ভাই তুমি যদি পরিচালক হতে চাও, তোমার তো প্যাশন লাগবে। আসলে এঁরা সকলেই খারাপ ছাত্র। এখন খারাপ ছাত্ররা মাস কমিউনিকেশন পড়তে যায়। ভাল ছাত্ররা বরং অন্য কোনও ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে এই দুনিয়ায় আসে।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: এখন কোনও ক্ষেত্রে সফল না হলেই লোকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসে। একথা কতটা সত্যি?

তিগমাংশু ধুলিয়া: এখন আসলে সবাই বিখ্যাত হতে চায়। এটা সব সময়েই ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে এটা একটু বেশি মাত্রতেই দেখা যাচ্ছে। ওই জন্যই 'টিকটক' অথবা অন্যান্য ভিডিও প্ল্যাটফর্মের বাড়ন্ত। কারণ এটাই বিখ্যাত হওয়ার সব থেকে সহজ উপায় এখন।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: ইরফান খানের কোনও উত্তরাধিকারী আছে বলে মনে করেন?

তিগমাংশু ধুলিয়া: না, অন্য কোনও অভিনয়ের ধরন নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কোনও অভিনেতা আসবেন৷ কিন্তু ইরফান বা ওর কাছাকাছিও কেউ যেতে পারবে না।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: আপনি তো নিজের চিত্রনাট্য নিজে লেখেন...

তিগমাংশু ধুলিয়া: আর কোনও উপায় নেই আমার কাছে। কারণ ভাল লেখক পাই না।

সিরাজ মুখোপাধ্যায়: যখন চিত্রনাট্য লেখেন, তখন তো কোনও এক জন অভিনেতাকে মাথায় রাখতে হয়। ইরফান তো এখন নেই, সেই অভাবটা বোধ করেন না?

তিগমাংশু ধুলিয়া: খুবই করি। ভীষণভাবেই করি। অভিনেতা হিসেবে ইরফান আমার লেখক-পরিচালক সত্তাকে অনেকটা উপরে নিয়ে গিয়েছে। কারণ যে কোনও জটিল এবং ইন্টারেস্টিং চরিত্র থাকলেই আমি জানতাম, একমাত্র ইরফানই সেটা করতে পারবে। সেটাই আমাকে কাজে অনেক বেশি উৎসাহ দিত।

More Articles