টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল শহরে, মহানায়ককে শেষ দেখা দেখতে বয়ে গিয়েছিল জনস্রোত
সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমারের মৃত্যুতে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় বলেওছেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে আরও একটি ছবি তিনি করতে চেয়েছিলেন।
উত্তমকুমার চলে গেছেন, এই উপলব্ধি আজ পর্যন্ত বাঙালির হয়নি, এতটাই ব্যাপ্ত অবস্থান তাঁর। আমার আজও মনে আছে ১৯৮০-র ২৪ জুলাই তারিখটি, আমি তখন সদ্য বিদেশ থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করে ফিরেছি। আমাকে কভার করতে পাঠানো হয়েছিল আমার সংবাদপত্র থেকে। প্রায় কাছাকাছি সময় আরেকটি মৃত্যু আমাকে খুব বেদনা দিয়েছিল, জর্জ বিশ্বাসের মৃত্যু। কিন্তু উত্তমকুমারের মৃত্যু আজও বাঙালি মননে ততটা ছাপ ফেলেনি, যতটা ছাপ রেখেছে তার জীবন ও কর্ম। আমাদের বাড়ির কাছে 'উত্তম-সুচিত্রা' নামে একটি রেস্তোরাঁ হয়েছে নতুন, বোঝাই যায়, বঙ্গজীবনের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে এখনও এই নামদুটো। একই কথা খাটে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও, কারণে-অকারণে তাঁর গান বেজে উঠলে তাঁর অভাব বোধ হয় না মোটেই।
উত্তমকুমার যে-সময় থেকে আস্তে আস্তে নায়কের চরিত্র করা ছেড়ে দিচ্ছিলেন, তখনও ছবিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিই। 'যদুবংশ' ছবির কথাই ধরা যাক, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় নায়ক সেখানে, নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। সেই ছবিতে 'গনাদা'-র চরিত্রে উত্তমকুমার। যে অবিস্মরণীয় অভিনয় তিনি সেই চরিত্রে করেছিলেন, বাদবাকি কাউকে আর চোখেই পড়েনি যেন। 'ধন্যি মেয়ে'-তে তাঁর চরিত্রটাও তেমন, ছবিজুড়ে তাঁকেই যেন খুঁজে চলেছে সবাই।
উত্তমকুমারের যে ছবিটি সততই ফ্লপ করল, তা হলো 'ছোটি সি মুলাকাত'। এই ছবিটি প্রযোজনা করে অনেকটা লোকসানের মুখোমুখি হলেন তিনি। 'অগ্নিপরীক্ষা'-র হিন্দি ভার্সন এই ছবিটি, অথচ বাংলা ছবিটার সঙ্গে তার তুলনাই চলে না। বাংলা ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা জুটির যে ম্যাজিক চোখে পড়েছিল, হিন্দিতে উত্তমবাবুর সঙ্গে বৈজয়ন্তীমালার জুটিতে তা ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ল না। হিন্দি ছবিটির গানগুলিরও সেই আবেদন ছিল না। কিন্তু সাতের দশকে, এর কিছুদিন পরেই হলো 'অমানুষ', হিন্দি-বাংলা দুই ভাষাতেই হিট করেছিল সেই ছবি। কিঞ্চিৎ বয়স্ক চরিত্র, নায়কোচিত কোনও লুকও নেই, কিন্তু যে অভিনয় তিনি করলেন, তাতেই বাজিমাত হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: তিরিশ বছর ধরে বাংলা ফিল্মে একাই ছড়ি ঘুরিয়ে গেলাম: উত্তমকুমার
একটা সময় বোঝা যাচ্ছিল, নায়কের জ্যোতির্বলয় থেকে বেরিয়ে আসছেন উত্তমকুমার। পার্শ্বচরিত্র করছেন অনেক বেশি, বয়সেরও ছাপ পড়ছে। কিন্তু একই সঙ্গে, তিনি নায়কও থেকে যাচ্ছেন। শেষ যে ছবিটায় তাঁকে আমরা দেখলাম, 'ওগো বধূ সুন্দরী', সেখানে কেবল 'এই তো জীবন' গানের দৃশ্যটাতেই তাঁর অভিনয়ের জাদুস্পর্শ লুকিয়ে। জীবনের শেষ শট অবধি প্রতিটি শটকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতেন তিনি।
অনেকেই জানেন না, উত্তমকুমার ক্যামেরাটা খুবই ভাল বুঝতেন। 'উত্তম মুহূর্ত' বলে একটি বই লিখেছিলাম আমি, সেই বইতে বিখ্যাত আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষের তোলা ছবি ছিল, সত্যজিৎ রায়ের সারাজীবনের কাজ যাঁর লেন্সে ধরা রয়েছে। সেই নিমাই ঘোষ আমাকে বলেছিলেন, 'গ্রিনরুমে, বাড়িতে, কিছুটা আচমকাও কখনও, নানা ভাবে, নানা জায়গায় তো উত্তমকুমারের ছবি আমি তুলেছি। একটি ছবিও খারাপ ওঠেনি। কারণ প্রতিটি মুহূর্তের জন্য তৈরি থাকতেন ইনি। নিমাই ঘোষই বলতেন, ক্যামেরা ওঁকে কীভাবে ধরছে, বা চিত্রগ্রাহকের চোখে তিনি কেমন, তা তিনি মনে মনে দেখতে পেতেন।
সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমারের মৃত্যুতে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় বলেওছেন, উত্তমকুমারকে নিয়ে আরও একটি ছবি তিনি করতে চেয়েছিলেন। কারণ, ওঁর মনে হয়েছিল, 'নায়ক' এবার 'চিড়িয়াখানা'-র পরেও উত্তমকুমারের অভিনয় প্রতিভাকে ব্যবহার করা বাকি রয়ে গেছে ওঁর। আমাকেও বলেছিলেন সেকথা, মনে পড়ে।
হিন্দি ছবিতে কাজ করতে যাওয়া উত্তমবাবুর পক্ষে সঠিক কাজ হয়নি বলেই মনে হয়। যেমন 'দেশপ্রেমী' ছবিটিতে নায়ক ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, সেখানে এমন একটি চরিত্র উত্তমকুমার করছেন, যাকে কোনওমতেই সিরিয়াস বলা যাবে না। তাঁর অভিনয় সেখানেও খারাপ নয়, কিন্তু যে ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অন্য নায়ক, সেখানে উত্তমকুমারের মাপের একজন অভিনেতার ওরকম একটি চরিত্র করা মানে নিজেকে ছোট করা। অমিতাভ বচ্চন নিজে বলেছেন, কলকাতায় চাকরি করার সময় নায়ক বলতে তিনি বুঝতেন উত্তমকুমারকে, উত্তমবাবুর বহু ছবি তিনি দেখেছিলেন। উত্তমকুমার তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল। সেই উত্তমকুমার অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ছবিতে ওর'ম একটা অকিঞ্চিৎকর চরিত্র করবেন?
'লাল পাথর'-এর কথা বলতে হয় এই প্রসঙ্গে। ১৯৬৪ সালের সেই ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় চিরস্মরণীয়। গল্পটি এতই পছন্দ হয়েছিল তাঁর, এই ছবি করার জন্য পরিচালক সুশীল মজুমদারকে তিনি নিজেই অনুরোধ করেন। ১৯৭১ সালে সেই ছবি হিন্দিতে হলো। অভিনয় করলেন রাজকুমার। এই ছবিতে তাঁর চরিত্রে কেন তাঁকেই ভাবা হলো না, এই নিয়ে কিছুটা দুঃখও পেয়েছিলেন উত্তমকুমার।
হিন্দিতে উত্তমকুমারের সফল না হওয়ার পিছনে একটি কারণ ছিল, হিন্দি ভাষায় তিনি ততটাই সাবলীল ছিলেন না। তবু তিনি হিন্দি ছবিতে কেন অভিনয় করতে গেলেন? তার নেপথ্যে দু'টি কারণ ছিল। একটি হলো, বাংলা ছবির সেই সময়ের পড়তি অবস্থা। দ্বিতীয়ত, 'ছোটি সি মুলাকাত'-এর ফলে যে ধারদেনার জালে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন, তা শোধ করার জন্যও ওঁকে বেশি করে হিন্দি ছবি করতে হচ্ছিল, সুপ্রিয়া দেবীর সাক্ষাৎকারেও উঠে এসেছিল সেই কথা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ব্যর্থ হওয়ার পর আর বম্বের দিকে ফিরে তাকাননি, উত্তম কিন্তু নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি এক্ষেত্রে।
ওই একই সময় আরও কিছু বিষয়ে নিজেকে জড়াচ্ছেন উত্তম। অভিনেতৃ সংঘ-র হয়ে একটি ছবির চিত্রনাট্য লিখলেন ও পরিচালনা করলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি এই ছবির সংগীতেও অবদান ছিল তাঁর। উত্তমকুমার চেয়েছিলেন, যে অবস্থান বাংলা ছবির জগতে তাঁর ছিল, তা কাজে লাগিয়ে আরও কাজ করতে। আর এই কাজের অতিরিক্ত চাপ ছাপ ফেলছিল তাঁর শরীরেও। শরীর ক্রমে ভাঙছিল।
আমার ধারণা, ওঁর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার পিছনে ওঁর মানসিক ক্লান্তিও কাজ করছিল কিছুটা। সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে তখন সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন চলছিল উত্তমকুমারের। এই সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের কাছেও গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু সত্যজিৎ চাননি, ওঁর পারিবারিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়তে। কিন্তু আরও একটা ভাল ছবি অবশ্যই করতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমারকে নিয়ে। মানুষের জীবন তো শুধু কাজের জমিতে আটকে থাকে না, ব্যক্তিজীবনও সেখানে প্রভাব ফেলছিল। ওঁর সঙ্গে একটা সুটকেস থাকত, সেখানে ব্ল্যাক লেবেল হুইস্কি থাকত, কাজের পর সন্ধেবেলার অবসরের জন্য। এই দিনে কর্মযোগী ও রাতে ভবঘুরে, এই জীবনও তাঁকে কিছুটা ভাঙছিল ভেতর থেকে।
বলে রাখা ভাল, যাঁকে উত্তমকুমারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হয়, সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজে কিন্তু কখনও উত্তমকুমারকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেননি। উত্তমকুমার সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি, অনেক সুখস্মৃতি ছিল ওঁদের দু'জনের।
আরও দশটা বছর বেঁচে থাকলে আরও পনেরোটা ভাল ছবি হয়তো উপহার দিতে পারতেন তিনি। ২৪ জুলাই, ওঁর মৃত্যুর দিনটা খুব মনে পড়ে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। কলকাতার রাস্তায় বিপুল জনস্রোত। তুলনা করছি না, কিন্তু এর কিছুদিন আগেই প্যারিসে জঁ পল সার্ত্রর মৃত্যুমিছিল দেখেছি আমি। প্যারিস শহরেও বৃষ্টি পড়েছিল সেই দিন। মানুষের সেই ভিড় দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, ফরাসিরা বলে 'ইমার্সন'। সংস্কৃতির মধ্যে, যাপনের মধ্যে ডুবে যাওয়া, নিমগ্ন হয়ে যাওয়া। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর যেন সেই ইমার্সন হয়েছিল কলকাতা শহরেও, আমি সাংবাদিক হিসেবে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি ওই জনস্রোতের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম। পর্দায় দেখা নায়ককে মৃত্যুর পর সামনে থেকে দেখার জন্য ওই ভিড়ই প্রমাণ করে, তাঁর মৃত্যুর ঊর্ধ্বে আসলে তাঁর বেঁচে থাকা, তাঁর কাজ।