দু'জনেরই খাতায় একটি করে গোল, মেসি-রোনাল্ডোর বিশ্বকাপের শুরুটা যেমন
FIFA World Cup 2022: বলা হচ্ছে, এই বিশ্বকাপ দু'জনেরই শেষতম। ময়দান কি আবারও সাক্ষী থাকবে মেসি-রোনাল্ডো ম্যাজিকের?
গতকাল, অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের কথা। পর্তুগাল বনাম ঘানার ম্যাচটি তখন গড়িয়ে গড়িয়ে প্রায় শেষের পথে। এমন সময় সাইডলাইনের ধার থেকে খেলোয়াড় বদলের আলো জ্বলে উঠল। পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস তাঁর তুরুপের তাসটিকে একটু যত্নে রাখতে চান। গোটা বিশ্বকাপ পড়ে আছে, তাই একটু বিশ্রাম দরকার। কাতার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটি খেলে ৮৮ মিনিটে উঠে গেলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ততক্ষণে তাঁর নামের পাশে ঢুকে আরও একটি রেকর্ড। পেনাল্টির সৌজন্যে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে একটি গোল করে ফেলেছেন তিনি। সেইসঙ্গে ঢুকে পড়েছেন এক বিরল গ্রহে। রোনাল্ডোই একমাত্র ফুটবলার, যিনি পরপর পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করেছেন। ২০০৬ থেকে ২০২২ – এক জয়যাত্রার নাম। ৩৭ বছর তো স্রেফ খাতায়-কলমে, মাঠে নামলে রোনাল্ডো এখনও যৌবনের উড়ন্ত ঘোড়া, তা তো বলার অপেক্ষা থাকে না।
আরও পড়ুন : কোন চালে মাত জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা? আশার আলো দেখাচ্ছে এশীয় ফুটবল
পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে তাকিয়ে দেখুন। প্রত্যেক শিল্প, শিল্পী ও স্রষ্টার নিজস্ব একটি মঞ্চ থাকে। গরাত বাড়লে যেভাবে নিজের জগত আঁকড়ে ধরে কবিতা তুলে নিতেন জীবনানন্দ। বিশ্বকাপ ফুটবলের মহামঞ্চ সেই শিল্পীর জেগে ওঠার মন্ত্র। ছাই হয়ে ঢেকে যাওয়ার পর ফিনিক্স হওয়ার মঞ্চ। একেকটা ড্রিবল, গোলরক্ষকদের ছুঁড়ে দেওয়া শরীর, ছোট ছোট পাসে পৌঁছে যাওয়া বিপক্ষের বক্সে – প্রতিটাই দীর্ঘ কবিতার মতো। ভেবেচিন্তে উচ্চারণ করা শব্দব্রহ্ম। কাতারের এই বিশ্বকাপ শুরু থেকে অনেক বিতর্কের সম্মুখীন। কিন্তু পায়ে বল পড়লে সেসব আর কি মনে থাকে?
ঠিক সেভাবে সামনে আসবেন বিশ্ব ফুটবলের দুই মহারথী। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পাশাপাশি মাঠে নেমেছেন আর্জেন্টাইন স্বপ্নের কারিগর লিওনেল মেসিও। তাঁরম এখন ৩৫ বছর বয়স। বলা যায়, এই বছর দু’জনেরই শেষ বিশ্বকাপ। ‘ওয়ান লাস্ট টাইম’-এর মুহূর্তে দু’জনেই তো জ্বলে উঠতে চাইবেন! সেটাই স্বাভাবিক। আর বাঙালি তো বটেই, গোটা বিশ্ব মেতে উঠবে মেসি বনাম রোনাল্ডোর আলোচনায়। ইতিমধ্যেই দু’জনে নিজেদের দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। শেষ বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। কেমন সেই যাত্রা?
আরও পড়ুন : পরকীয়া, অবাধ যৌনতা! মেসিদের হারের নেপথ্যনায়ক হার্ভে রেনার্ডের জীবন নিয়ে তোলপাড়
আগেই বলে নেওয়া ভালো, আমি সামান্য এক ফুটবল ভক্ত। বিশ্বকাপ, ইউরো বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সময় এলে রাত জেগে পায়ের ওপর পা তুলে খেলা দেখি। মাপকাঠি দিয়ে মেপে, তুল্যমূল্য বিচার করে খেলার ওজন মাপতে গেলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। তবে খেলার একটু ভিতরে তো যাওয়াই যায়। লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো – দু’জনেই এবার একটি গোল করে অভিযান শুরু করেছেন। কাকতালীয়ভাবে দু’জনেই পেনাল্টি থেকে গোল করেছেন। নিজেদের ঝলক দেখিয়েছেন মাঠে। কিন্তু তাতে কি আদৌ মন ভরল? প্রথম ম্যাচের পর মন ভরার প্রসঙ্গ ওঠা উচিত নয় ঠিকই। কিন্তু দু’জনের থেকেই আরও অনেকটা আশা করে বসে আছি আমরা। অন্যদিকে পর্তুগাল ঘানাকে পরাস্ত করলেও, আর্জেন্টিনা নিজেদের খাতা খুলেছে পরাজয় দিয়ে। রেকর্ডের পাশে সেটাও একটা প্রধান ব্যাপার।
শুরু করা যাক মেসিকে দিয়ে। দীর্ঘদিনের সঙ্গী বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজি-তে গিয়েছেন এলএম১০। প্যারিসের মাটিতেও দেখা গিয়েছে তাঁর জাদু। এদিকে ২০২১-এ আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছেন। ডি মারিয়া, মার্তিনেজ, ডিবালাদের নিয়ে ইউরোজয়ী ইতালিদের হারিয়ে জিতেছেন ফাইনালিসিমাও। টানা ৩৬ টি ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডও সঙ্গী। এতকিছু নিয়ে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন মেসি। শুরুতে পেনাল্টি থেকে কাঙ্খিত গোলও করলেন। প্রথমার্ধের বাকি সময় জুড়ে রইল ভিএআর এবং অফসাইড। দ্বিতীয়ার্ধে সৌদি আরবের অসামান্য ডিফেন্স, গোলরক্ষক আল ওয়েইসির দুরন্ত হাতের সামনে মেসির সব আক্রমণই ফিকে হয়ে যায়। মেসিদের একের পর এক শট প্রতিহত করেছে আরব। উল্টোদিকে দু’টো গোল করে এগিয়ে যায় সৌদি আরব। ডি মারিয়া, লোটারো মার্তিনেজ, ডে পলদের সঙ্গে নিয়েও ব্যর্থ হলেন মেসি। মাথা নিচু করে ছাড়তে হল স্টেডিয়াম।
আরও পড়ুন : বারবার বাজিমাত! লেভ ইয়াসিন থেকে কান, ফিরে দেখা বিশ্বকাপের গোলরক্ষকদের
অন্যদিকে পর্তুগাল ও রোনাল্ডোর গল্পটাও একইরকম হতে পারত। পর্তুগাল বনাম ঘানা ম্যাচের দিকে এমনিতেই নজর ছিল সবার। একদিকে বিতর্কিত ইন্টারভিউ, তার জেরে সাধের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে যাওয়া, পাশাপাশি এক ভক্তের মোবাইল আছড়ে ভেঙে দেওয়া – এমনিতেই নানাভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন রোনাল্ডো। ম্যাচের প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকলেও, দ্বিতীয়ার্ধের ৬৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান রোনাল্ডো। এই বয়সেও তাঁর অসামান্য ফিটনেস নজরে পড়ে। ম্যাচের পর একটি ছবি ভাইরালও হয়। যেখানে দেখা যায়, হেড নেওয়ার জন্য ঘানার বক্সে লাফিয়েছেন রোনাল্ডো। সেই সময় মাটি থেকে প্রায় হাফ মিটার উচ্চতায় লাফিয়েছেন তিনি। এর আগেও অবশ্য এই কাজটি করেছেন রোনাল্ডো। এবার তিনি পাশেও পেয়েছেন ম্যাঞ্চেস্টার সতীর্থ ব্রুনো ফার্নান্ডেজকে। পর্তুগাল ম্যাচটি ৩-২ গোলে জিতলও, তবুও প্রশ্ন রয়েই যায়। ঘানার ফুটবল অবশ্যই মন জয় করেছে আমাদের। শেষ মুহূর্তে ঘানা সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে হয়তো অন্য গল্প লিখতে হত। পেনাল্টি নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতেই হবে। অফ দ্য ফিল্ড রোনাল্ডোর ভূমিকা ভুললেও চলবে না। ৮৮ মিনিটে উঠে যাওয়ার পরও সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন, পরিকল্পনাও দিয়েছেন। দলের সিনিয়র ও অভিজ্ঞতম খেলোয়াড়ের এমন ভূমিকা দেখা গিয়েছিল ইউরো ২০১৬-র ফাইনালেও।
আরও পড়ুন : ব্যাড বয় না কি রাজপুত্র? মারাদোনাকে ছাড়া আজীবন ফিকে বিশ্বকাপের ময়দান!
দেশের হয়ে পারফর্মেন্সের তুল্যমূল্য বিচার যদি করা হয়, তাহলে এখনও অবধি মেসির চেয়ে রোনাল্ডোর ম্যাচের সংখ্যা বেশি। গোলের সংখ্যার দিক থেকেও এগিয়ে আছেন রোনাল্ডো। কিন্তু ময়দানে নামলে পরিসংখ্যান কি সবসময় মনে আসে? পায়ে বল পড়লে সবকিছুই ভুলে যেতে হয়। নতুন লড়াই, নতুন পথ চলা। মেসি না রোনাল্ডো- দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলা এই বিতর্কের অবসান নেই। যেমন নেই পেলে আর মারাদোনার তুল্যমূল্য বিচারে। ফুটবল বিশ্ব আবার এমন যুযুধানের সাক্ষী কবে থাকবে, জানা নেই। তাই দু’জনে যতদিন মাঠে আছেন, ভক্তদের একটাই প্রার্থনা, আরেকটু থাকুক না হয়। তাড়াতাড়ি চলে গেলে তো চলবে না। ‘যেতে নাহি দিব’। সেই না যেতে দেওয়ার মন্ত্র, হাতে বিশ্বকাপ দেখার স্বপ্ন নিয়ে আবারও রাত জাগার পালা শুরু। মেসি ইতিমধ্যেই একবার বিশ্বকাপের কাছে গিয়েও ফিরেগিয়েছেন। এবার কি পারবেন বাজিমাত করতে? ২০১১-র ওয়াংখেড়ের টেন্ডুলকার হতে পারবেন মেসি? রোনাল্ডোও কি একবার ছোঁবেন সোনালি কাপটি? এখন এমন প্রার্থনাই চলছে বুয়েনস এয়ারস, লিসবন থেকে ভারতের গলি থেকে মফস্বলে।