পাকিস্তানের হয়ে একটি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন সচিন!
ক্রিকেটের জগতে ভারত পাকিস্তানের রেশারেশি বহুদিনের। ভর দুপুরে সাদাকালো বা রঙিন পর্দায় কাঁপাকাঁপা ছবিতে সেই ম্যাচ দেখেনি এমন মানুষ কম। বর্তমান প্রজন্মের কথা আলাদা। তবে নব্বইয়ের দশকে যাঁরা খেলে দেখেছেন, এমনকি তার পরের কয়েক বছরেও এই কাঁটো কা টক্করের ছবি তাঁদের মনে গেঁথে রয়েছে। এই খেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল রাওয়াল পিন্ডি এক্সপ্রেস তথা শোয়েব আখতারের বলে সচিনের ব্যাটিং। তখন ভারতীয় দলে নানা মণিমুক্তো। সৌরভ, দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণ–কাকে ছেড়ে কাকে ধরি। অথচ খেলার জগতে সেই ছোটখাটো মানুষটির জনপ্রিয়তা অমলিন রয়ে গেল। ভারতীয় ক্রিকেটের বেতাজ বাদশা, বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম তারকা সচিন তেন্ডুলকর।ওই মানুষটির মাঠে নামা থেকে গ্যালারিতে ফেরা—এই দুইয়ের মাঝের সময়টুকু একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে থাকত হাজার হাজার চোখ। দু'শোটি ওয়ান ডে খেলায় বিশ্বে প্রথম ব্যক্তিত্ব সচিন। আজ সেই কিংবদন্তীর জন্মদিন। এই রবিবার ৪৯ বছর বয়েস হল তাঁর। তাঁর খাদ্যপ্রীতি বা রন্ধনপ্রীতি, গলফের মাঠে হাত পাকানো, পাড়ার ক্রিকেটেও নেমে পড়ার গল্পকথাগুলি ইন্টারনেটের দৌলতে জানেন অনেকেই। কিন্তু তাঁর প্রথম খেলার খবর রাখেন কজন? যদি বলি, সচিনের প্রথম খেলা পাকিস্তানের হয়ে? সচিন ভক্তদের হাতে প্রহার জুটবে?
সবাই জানেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই কিংবদন্তীর আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু ১৯৮৯ সালে করাচিতে। পাকিস্তান ভারত ম্যাচ। কিন্তু অনেকেই জানেন না, সেটি সচিনের খেলা প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ নয়। ভারতীয় টিমে সেই খেলাটি দিয়ে তাঁর জায়গা পাকাপোক্ত হয় বটে, কিন্তু এর আগেও খেলেছেন সচিন। এবং খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। হ্যাঁ, পাকিস্তানই।
মুম্বইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের খেলা ছিল। কয়েক বছর আগেই বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ম্যাচে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হয়ে ফিল্ডিং করেন লিটল মাস্টার। জীবনের ৪৮ টি বছর পার করে পৌঢ় কিংবদন্তী স্মৃতিচারণ করেছেন এই ঘটনার। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’তে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে তিনি লিখছেন, “জানি না ইমরান খানের সে ঘটনা মনে আছে কিনা!” ইমরান তখন পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন। তিনিই ফিল্ডিং করতে নামান তেণ্ডুলকরকে।
আসলে পাকিস্তানের খেলোয়াড় জাভেদ মিয়াঁদাদ ও আবদুল কাদির তখন লাঞ্চে গিয়েছিলেন। ফলে বদলি হিসেবে সচিনকে ফিল্ডিং করতে বলা হয়। তা সে করেও ছিলেন লিটলমাস্টার। এমনকী সেবার কপিল দেবের তোলা ক্যাচ প্রায় ধরেও ফেলেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড জোরে অনেকটা দৌড়ে এসেও বলটার নাগাল পাননি সচিন। তাঁর মতে, তাঁকে যদি লং-অনের পরিবর্তে মিড-অনে রাখা হত, তাহলে হয়তো পাকিস্তানের হয়ে এক উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব থাকত তাঁর।
আরও পড়ুন-রাখিস মা রশেবসে, এ যেন খাদ্যপ্রেমী সচিনের হৃদয়ের কথা
তবে এখানেই শেষ নয়। ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে নেমে যে পরিমাণ চার ছয় হাঁকিয়েছেন পাকিস্তানের বোলারদের বিরুদ্ধে সে কথা আজও স্মরণীয়। ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এখনও ওয়ান ডে-তে সবথেকে বেশি রান করেছেন সচিনই। ৬৯ টি ম্যাচে ২৫২৬ রান। গড়ে প্রতি ম্যাচে প্রায় ৪০.০৯ রান তাঁর। ঝুলিতে রয়েছে পাঁচটি সেঞ্চুরি এবং ১৬ টি হাফ-সেঞ্চুরি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ রান তাঁর ১৪১। সেবার খেলা ছিল পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে। ২০০৪ সাল। এছাড়াও ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম সেঞ্চুরিটি করেন শচীন। খেলতে আসার প্রায় বছর সাতেক পরে। সে সময় তাঁর বয়েস বাইশ বছর। সেবার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার একটি ত্রিদলীয় ওয়ান-ডে ম্যাচের সিরিজ চলছিল। সিরিজের তিন নম্বর ম্যাচে ভারত পাকিস্তান মুখোমুখি হয়। তখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। ম্যাচ ওপেনিং করেছিলেন তেণ্ডুলকর এবং নভজ্যোত সিং সিধু। আর অপরদিকে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন ওয়াকার ইউনুস, সাকলিন মুস্তাক এবং অন্যান্যেরা। গোটা ভারতীয় দল যখন পাকিস্তানের স্পিনার ও পেস বোলারদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না, একা নিজের গড় রক্ষা করে চলেছিলেন সচিন। ১১১ বলে ১০০ রান করেছিলেন সেবার। নটা বাউন্ডারি এবং একটা ওভার বাউন্ডারিও ছিল তার মধ্যে। যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, সাকলিন মুস্তাকের স্পিন সামলান, ওয়াকার ইউনুসের পেস বল সামলান এবং ভারতের স্কোর আট উইকেটে ২২৬ রান অবধি টেনে নিয়ে যান একাই। যদিও সে ম্যাচে জেতেনি ভারত।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তুলকালাম ফর্মে দেখা গিয়েছে সচিনকে। ৯১ সালে শারজা কাপে বাহান্নতে নট আউট ছিলেন, সিডনি কাপে চুয়ান্নতে নট আউট (১৯৯২), ৯৬ সালেই শারজা কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, ১১৮ রান, আরেকটি প্রায় সেঞ্চুরি হতে হতেও রয়ে যায় ৮৯ রানে, আউট হননি তিনি। ৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে করেছিলেন ৯৫ রান, ২০০৫-এ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ১২৩, শেষ সেঞ্চুরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে।
ক্রিকেটের বহু রেকর্ড ভেঙেছেন এবং গড়েছেন সচিন। যে রেকর্ডের ধারে কাছেও কেউ আসতে পারেনি। সে কারণেই ক্রিকেট জগতের বেতাজ বাদশা লিটল মাস্টার। দুই দশক ধরে অবিরাম ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কিংবদন্তী। এখন তাঁর অবসরবেলা। সর্বমোট ৩৪৩৫৭ রান অর্জিত তাঁর ঝুলিতে। রয়েছে ১০০ খানা সেঞ্চুরিও।