ক্রিকেটের শেষ ঈশ্বর, আমজনতার শেষ ভরসা সচিনই?

Sachin Tendulkar: সচিনও বহুদিন ৯৯-এর গেরোয় আটকে ছিলেন। তারপর ১০০তম সেঞ্চুরি। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল দেশ।

একবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া আমার সচিন তেন্ডুলকরকে নিয়ে যেটুকু স্মৃতি আছে, তার মধ্যে বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে একটা আকুতি। সচিন যেন অল্প রানে আউট না হন। পরে বুঝেছি সেটা স্রেফ আমার না, ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশের গণ-আকুতি। সচিনকে স্টেইন সংহারে মত্ত হতে দেখেছি দক্ষিণ আফ্রিকার সবুজ পিচে, দেখেছি বিশ্বকাপে হেভিওয়েটদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশার চাপ সামলে সেঞ্চুরি, দেখেছি ওয়ানডে-তে ডবল সেঞ্চুরি করতে, দেখেছি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটা টেস্ট দ্বিশতক। তাও সচিন মানেই শৈশব-জোড়া আকুতি, ব্যাকুল এক প্রার্থনা। সচিন আউট হলে সমালোচনা যেন ওঁর নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমারই। এই প্রার্থনা আগের দুটো দশক জুড়ে ভারতবর্ষ করেছে। তবু মনে হয়, আমাদের প্রজন্মের যারা সচিনের ফ্যান হয়ে গেছিল, তাদের কাছে এই প্রার্থনা কতকটা অন্যরকম। সচিন তখন সফল হচ্ছেন কম, ব্যর্থ হচ্ছেন বেশি। সচিন তখন ভঙ্গুর, জরাগ্রস্ত। তাঁর সাফল্য চাইবার সাহস নেই আমাদের। আমরা চাইতাম শুধু যেন ব্যর্থতা না আসে। মেসিকে নিয়েও এই নৈমিত্তিক প্রার্থনায় বসেছি আমরা। কিন্তু মেসি কখনই এতখানি 'ভালনারেবল' হননি। এতখানি বিদ্ধ-জর্জরিত হননি। 

সচিনের উত্থানের সময়কার পটভূমি ঘাঁটলে বোঝা যাবে, শুধু কেরিয়ারের প্রান্তবেলায় নয়, আসমুদ্রহিমাচলের প্রার্থনা সচিনের সঙ্গে জুড়ে গেছিল তাঁর বয়ঃসন্ধি থেকেই। জীবনের প্রথম টেস্ট সিরিজে ওয়াকারের বলে যখন ১৬ বছরের একটা ছেলের নাক ফেটে গেল শিয়ালকোটের শীতে, গ্যালারিতে প্ল্যাকার্ড উঠল তাঁকে দুধের শিশু হিসেবে ঘোষণা করে, তখন থেকেই ভারতবর্ষ জানে এই অসীম সম্ভাবনাময় ছেলেটাকে আগলে রাখতে হবে। দলের স্বনামধন্য সিনিয়রদের থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা, এমনকী মিডিয়াও সচিনকে আগলাতে শুরু করল। তারপর সচিন একশোটা সেঞ্চুরি করেছেন। তিরিশ হাজার আন্তর্জাতিক রান করেছেন। দুঁদে সব বোলারদের ছাতু করে বলের সেলাই খুলে দিয়েছেন। এক এক সময়ে প্রায় ঐন্দ্রজালিক কীর্তি রচলেও, হেলমেটে তেরঙা সাঁটা সচিন যেহেতু সারা ভারতের ক্রিকেটপাগল ভক্তের যাবতীয় আশা ভরসার প্রতিভূ হয়ে প্রতি ম্যাচে মাঠে নামতেন, প্রত্যাশার চাপের মধ্যেও একাগ্র ফোকাস ধরে রাখবার জন্যই যেন তাঁর প্রয়োজন হতো আম-ভারতবাসীর প্রার্থনার। ভক্তরা প্রার্থনা করতও, কারণ সচিন ছিলেন ধরাছোঁয়ার মধ্যেই। যেন বাড়ির ঠাকুরঘরের প্রিয় মূর্তির মতোই, সচিনের দৈবীশক্তিতে কারও অবিশ্বাস ছিল না হয়তো, তবু প্রতিদিন সন্তানের মতো সেই মূর্তির যত্ন নেওয়ার যে ব্যক্তিগত পুজো, তা নিয়মিত করে যেতেন ভারতীয়রা। সচিন যখন ঈশ্বর, তখনও তিনি ভারতবাসীর একান্ত আপন, সেই অধিকারবোধের আওতায় আসতে তাঁকে মনুষ্যকোটিতে বিরাজ করতে হয়নি সবসময়।

আরও পড়ুন- পাকিস্তানের হয়ে একটি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন সচিন!

ঈশ্বর হয়ে ওঠা অবশ্য সচিনের একক কীর্তি হতে পারে না। আর সব কিছুর মতোই তা পারিপার্শ্বিকের উপর একান্ত নির্ভরশীল ছিল। উদারীকরণ-উত্তর ভারতবর্ষের যখন একটা হিরোর দরকার ছিল, তখনই উঠে এসেছিলেন সচিন। অর্থনৈতিক উদারীকরণে স্বপ্ন দেখা সহজ হয়েছিল মধ্যবিত্তের। যে মধ্যবিত্ত এতদিন গাড়ি বলতে বুঝত লম্বা অপেক্ষার পর কিনতে পারা অ্যাম্বাসাডর, বা জানত বিলিতি জুতো স্রেফ বড়লোকদের শৌখিনতা- সেই মধ্যবিত্তের সামনে হঠাৎ করে খুলে গেছিল নতুনত্বের দরজা। সমস্ত সম্ভাবনা হঠাৎই রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছিল। ভারত এই সময়ে ছেঁড়া কাঁথা থেকে কোটিপতির স্বপ্ন দেখেনি, মেতেছিল হরিপদ কেরানি থেকে কেতাদুরস্ত অফিসার পোস্টের বাস্তব-ঘেঁষা উচ্চাকাঙ্খায়।

সচিন মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান। বাবা রাশভারি অধ্যাপক। সচিনের পড়াশোনায় অমনোযোগ দেখে বাবা অসন্তুষ্ট বলে তাঁকে বেশ ভয় পান সচিন। ছোট একটা বাড়িতে দিনগুজরান। বাবা, বয়সে খানিকটা বড় দাদা আর ক্রিকেটগুরু একরোখা আচরেকরকে সমঝে চলতে হয় সচিনকে। এরই মধ্যে বোর্ড পরীক্ষার ফল বেরোয়। সারা ভারত টিভিতে দেখে টেনেটুনে করা মাঝারি ফলাফল। সচিনের গলা মিহি। নম্র, বিগলিত, লাজুক হাবভাব। জনসমক্ষে বেশ অপ্রস্তুত। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটও নয়। মুখচোখে শৈশবমাখা সারল্য। সবদিক থেকেই মধ্যবিত্ত সমাজের বেশ নিবিড়ভাবে আপন করে নেবার মতো মুখ সচিন। শুধু ক্রিকেট মাঠে সে অতিমানব হয়ে যায়। তাঁর উপর যেন ভর করে সারা ভারতের প্রার্থনালব্ধ শক্তি। কারও তোয়াক্কা নেই সেখানে। কিন্তু অহংকারের আস্ফালনও নেই, রয়েছে কেবল অটল আত্মবিশ্বাস। বিতর্কে জড়ান না সচিন, মাঠে হোক কিংবা মাঠের বাইরে। রাজনীতি নিয়ে মতামত দেন না। কুৎসা করেন না সর্বসমক্ষে। ছাপোষা পারিবারিক জীবনে আড়ম্বরের দেখনদারি নেই। বাড়াবাড়িরকম ধর্মপ্রাণ না হলেও বেশ ধর্মভীরু, আর পাঁচজন মুম্বইকরের মতোই প্রায়ই গণেশমন্দিরে পুজো দিতে যান। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যত উপরেই ওঠা যাক না কেন, সযত্নে লালিত মূল্যবোধের সঙ্গে সচিনের আপোষ নেই একটুও। নব্বইয়ের দশক এবং শূন্যদশকের শুরুর দিকে উদীয়মান ভারতবর্ষের বেছে নেওয়া মশালবাহক সচিনেরই তো হওয়ার কথা তাই।

কেউ কেউ বলতে পারেন, শাহরুখ নন কেন। সহজ উত্তর- শাহরুখ রুপোলি পর্দার নায়ক। সেলুলয়েডের ফিল্মের মধ্যে তিনি রূপকথা ঘটান। যতই 'বয় নেক্সট ডোর' হাবভাব থাকুক, সবাই জানে রক্তমাংসের কেউ নন সেই চরিত্র, সে যতই উদ্দীপক হোক শাহরুখের জীবনের বাস্তব কাহিনি। তাছাড়া এই যুগ ভারতের টেলিভিশনে স্পোর্টস চ্যানলের ব্যাপক বিস্তৃতি দেখছে। বিশেষত ক্রিকেট ম্যাচের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বাড়ছে হুহু করে। একদা শীতের তেরছা রোদে ফ্লানেল পরে খেলার জেন্টলম্যানস গেমের প্রকৃত আধুনিকীকরণ হচ্ছে এই দশকেই। ২৪×৭ গণমাধ্যম গমগমে রেখে ক্রিকেটের ইন্ডাস্ট্রি বিপণনের আসমান স্পর্শ করছে। তারই পোস্টারবয় সচিন। দিকে দিকে গড়ে উঠছে কোচিংসেন্টার। "ইঞ্জিনিয়ারিং তো করতেই হবে, কিন্তু পাশাপাশি একটু ক্রিকেট খেললে ক্ষতি কী, যদি আমাদের সন্তান সচিনের মতো হয়ে যায়?"- এই ভেবেই কচিকাঁচাদের নিয়ে বাপ মা'রা ছুটেছেন সেসব কোচিংসেন্টারে।

গাভাস্করের সময়কার ভারত অন্যরকম। সেখানে সর্বক্ষণের এই হামলে পড়া বাজার নেই। নেই টিভি পর্দায় অষ্টপ্রহর তাঁকে দেখে তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি মুখস্থ করার সম্ভাবনা। গাভাস্করের 'ক্যারিশ্মা' অনেক গম্ভীর। তাঁকে হতে হয়েছে স্বপ্নভঙ্গ ঝেড়ে ওঠার চেষ্টায় রত এক প্রজন্মের আদর্শবাদী বড়দা। তাঁর প্রতি সম্ভ্রম রয়েছে। তিনি ভরসা জোগাচ্ছেন জীবনের ব্যর্থতার মধ্যে। সচিন সেখানে নতুন ভারতের আশাজাগানিয়া কিশোর। উচ্ছ্বল আনন্দে বারবার দেখিয়ে যাচ্ছেন, চাইলে কত কী করে ফেলা যায় এই নতুন সময়ে। তবে গাভাস্কর আর সচিনের মিল একটা জায়গায়। দুই মারাঠির নোঙর গাঁথা আছে নাছোড় পরিশ্রমের প্রত্যয়ে। এখানে কোনও শর্টকাট নেই। জন্মগত প্রতিভা যদি থেকেও থাকে, শুধু সেটার উপর ভর দিয়ে চলবার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নেই। পরিশ্রমী দু'জনকেই কাছে টেনে নিয়েছিল ভারতবর্ষ। সচিনকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে অনেকখানি উজ্জ্বল চোখের স্বপ্ন ছিল। 'সব ঠিক হয়ে যাবে'র শুশ্রূষার থেকে 'আমরা সব পারি'র উড়ানটাই গাভাস্কর থেকে সচিনকে ঘিরে মধ্যবিত্ত ভারতবাসীর যাত্রাপথ।

আরও পড়ুন- রঙিলা আইপিএল এবং ভারতীয় ক্রিকেটের বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ

যখন সচিনের কেরিয়ারের সূর্য খানিক অস্তগামী, তখনও তাঁর উপর বিনিয়োগ করা ছিল সাংঘাতিক সুরক্ষিত। কারণ সচিনের ব্র্যান্ডভ্যালু তাঁর সাফল্যের অঙ্ককে পেরিয়ে গিয়েছিল। সচিন লার্জার দ্যান লাইফ নন বরং সচিন হেরো হলেই তাঁকে নিয়ে মানুষের একাত্মতা বাড়ে। আইটি-বুমের শেষে যখন ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি স্খলিত হওয়ার চিহ্ন দেখাচ্ছে, তখন ঈষৎশঙ্কিত মধ্যবিত্ত, পঁয়ত্রিশ ছুঁইছুঁই সচিনকে দেখে ভাবছে, এই লোকটার রোজ সেঞ্চুরি করার কথা তো নয়, এমন দু' চারটে ইনিংস তো যেতেই পারে। ভারতবর্ষ সেই আশা জাগানিয়া কিশোরের সফল কেরিয়ারকে যেমন মাথায় তুলে রেখেছে, তেমনই মধ্যবয়সে আসা খেলোয়াড়ের সঙ্কটকেও যত্ন করে আগলে রেখেছে। সচিনের ভাবমূর্তির সবচেয়ে আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে মানুষ এবং ক্রিকেট ঈশ্বরের সাবলীল সহবাস। মানুষ সচিন আর ঈশ্বর সচিন অভেদ্য এবং প্রায় সবসময়ই একীভূত। সেখানেই এই অগাধ প্রত্যাশা আর অনাবিল প্রশ্রয়ের সহজ সহাবস্থান।

উদারীকরণ-উত্তর কিন্তু প্রাক-সমাজমাধ্যম যুগের দুটো দশকজুড়ে শাসন করেছেন সচিন। ট্রোলিং আর চটজলদি মতামত তৈরির যুগে সচিনকে গণধিক্কারের শিকার হতে হয়নি সেভাবে। অন্তর্জাল সংস্কৃতির রমরমা সচিনকে সেভাবে সইতে হয়নি বলেই বোধহয় জনগণের কাছে সচিন ক্রিকেট ঈশ্বর থাকতে পেরেছেন, লহমায় ঈশ্বরের ব্যর্থতার লাথিঝাঁটা সহ্য করতে হয়নি।

ব্যাট তুলে রাখার পর সচিন মেন্টর হয়েছেন আইপিএল দলের। টিভি শোতেও টুকটাক তাঁকে দেখা গেছে। আত্মজীবনী বের করেছেন। তাঁর জীবন ঘিরে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক প্রগতি হ্রাসমান হয়েছে, সুপারপাওয়ার হওয়ার স্বপ্নে ভাটা পড়েছে। মোটের ওপর আশাবাদী একটা সময় ফুরিয়ে গিয়েছে স্বপ্নদের অপূর্ণ রেখেই। শঙ্কিত, সন্দিগ্ধ আজকের ভারত খুঁজছে অনেক বেশি আগ্রাসী একজন সুপারহিরোকে। বিশাল এক সামাজিক 'ঘটনা' হিসেবে সচিন শতাব্দীর প্রায় একপাদ জুড়ে রইলেও, তিনি চোখের আড়াল হতেই হারিয়ে ফেলেছেন প্রাসঙ্গিকতা। পড়ে আছে রেকর্ডবই। সেখানে সংখ্যার হিসেবে নিশ্চিতভাবে লেখা আছে ব্যাটসম্যান সচিনের অলঙ্ঘনীয় সব কীর্তির কথা। সচিন-সাম্রাজ্যের ঈর্ষণীয় ঐতিহ্য হিসেবে পরিসংখ্যানগত মাহাত্ম্য টিকে গেছে, টিকে থাকবেও। ১০০ একটা অদ্ভুত সংখ্যা। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান নিজের শেষ ইনিংসে শূন্য করায় তাঁর গড় আটকে গেছিল ৯৯.৯৪-এর গেরোয়। সচিনও বহুদিন ৯৯-এর গেরোয় আটকে ছিলেন। তারপর ১০০তম সেঞ্চুরি। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল দেশ। ইনিংস মোটেই দুর্ধর্ষ ছিল না। ভারত ম্যাচ হেরেছিল। আমি খুশি হয়েছিলাম। ১০ বছর বয়সি এক শিশুর প্রার্থনা সফল হয়েছিল। সচিন একটা আস্ত দেশের কোটি কোটি প্রার্থনা দিয়ে গড়া ম্যাজিকই তো।

More Articles