১০ বছরের ঘাসফুল দুর্গে ভাঙন! সাগরদিঘিতে কোন মন্ত্রে তৃণমূলকে হারাল বাম-কংগ্রেস জোট?
Sagardighi Bypoll Election 2023 : পরিবর্তনের হাওয়া ঘুরে গেল একেবারে? বিজেপি নয়, বাম-কংগ্রেসকেই কি বেছে নিচ্ছে মানুষ?
কী বলা যাবে একে? পরিবর্তনের পাল্টা পরিবর্তন, নাকি প্রত্যাবর্তন? পঞ্চায়েত ভোটের আগেই রীতিমতো চর্চায় উঠে এল সাগরদিঘি বিধানসভা উপনির্বাচনের লড়াই। আর সেখানেই বিগত কয়েক বছরের ছবিটা বদলে গেল। এক দশক ধরে এই সাগরদিঘিই ছিল তৃণমূলের ঘাঁটি। উপনির্বাচনের ফলাফল বলছে, সেখানেই ‘হাত’ গলিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস (Byron Biswas) বিপুল ভোটে জিতলেন সাগরদিঘিতে। ফলাফল সামনে আসার অনেক আগে থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যায় সমর্থকদের মধ্যে। লাল আর সবুজ আবিরে অকাল দোলযাত্রায় মেতে ওঠে সাগরদিঘি।
২০১১ থেকে ২০২১ সাল – এই ১০ বছর ধরে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি এলাকায় দুর্গ ধরে রেখেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সুব্রত সাহা। তিনবারের বিধায়ক এবং মন্ত্রী সুব্রত অধীর চৌধুরীর গড়ে থাবা বসিয়েছেন, তার পুরস্কারও দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যু ফের ছবিটা বদলে দেয়। পূর্বনির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী, ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিধানসভা উপনির্বাচন আয়োজিত হয় এই কেন্দ্রে। মোট ২৪৬টি বুথের মধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে গণ্ডগোলের খবরও আসে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যদিকে বিজেপির দিক থেকে ছিলেন দিলীপ সাহা।
আরও পড়ুন : ২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা
তবে নজর ছিল বায়রন বিশ্বাসের দিকে। এই উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস দু’পক্ষই ঠিক করেছিল, জোট বেঁধেই লড়াইটা করবে। সেখানেই নির্বাচনে দাঁড়ান কংগ্রেস নেতা বায়রন। অধীর চৌধুরীর প্রথম থেকেই বক্তব্য ছিল, এবার আর তৃণমূল হুল ফোটাতে পারবে না। তাতে আমল দেয়নি তৃণমূল। বিজেপিও তেড়েফুঁড়ে নেমেছিল। সাগরদিঘিতে পা পড়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীর মতো হেভিওয়েটদের। নির্বাচনের আগে বায়রন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগও ওঠে। বিজেপি আঁতাতের অভিযোগও তোলে তৃণমূল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই উপনির্বাচনই যে অ্যাসিড টেস্ট, সেটা ঠারে ঠারে বোঝা যাচ্ছিল।
ফের একবার জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল তৃণমূল। কিন্তু বৃহস্পতিবার, ভোট গণনা শুরু হওয়ার পরই ছবিটা এক মুহূর্তে বদলে যায়। একেবারে প্রথম রাউন্ড থেকেই এগিয়ে যান বাম-কংগ্রেস জোটের বায়রন বিশ্বাস। যত বেলা গড়াতে থাকে, দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ব্যবধানও বাড়তে থাকে। শেষমেশ দুপুরেই ছবিটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রায় ২৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে জিতে যান বায়রন বিশ্বাস। এই ফলের জেরে এবারের বিধানসভায় বিধায়কদের খাতা খুলল কংগ্রেস। ব্যাপকভাবে প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকেই কংগ্রেস জিতেছে, এমনটাই জানা গিয়েছে।
কিন্তু কেন এমন ফলাফল? ২০১১-র পরিবর্তনের ঝড়ের পর কেটে গিয়েছে ১২ বছর। শেষ বিধানসভা নির্বাচনেই বিপুল ভোটে জিতে দুর্গ দখলে রেখেছিল তৃণমূল। দু’বছর যেতে না যেতেই পরিবর্তনের হাওয়া ঘুরে গেল একেবারে? বিজেপি নয়, বাম-কংগ্রেসকেই কি বেছে নিচ্ছে মানুষ?
আরও পড়ুন : নজরে পঞ্চায়েত নির্বাচন, নরম হিন্দুত্বে সায় তৃণমূলেরও! বুঝিয়ে দিল কালী বিতর্ক
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূলের এই হারের পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ। প্রথমত, খড়দহের মতো কেন্দ্রে উপনির্বাচনেও সেখানকার প্রয়াত বিধায়কের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়েছিল দল। সেইসঙ্গে প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় নিজেও ছিলেন যথেষ্ট হেভিওয়েট, সেইসঙ্গে দুঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সাগরদিঘির ক্ষেত্রে এর কোনওটাই ছিল না। প্রয়াত সুব্রত সাহার সেন্টিমেন্টকে সেভাবে কাজে লাগাতে পারেনি দল। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? সেটাই মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল।
সেইসঙ্গে রয়েছে সাম্প্রতিক বেশকিছু ঘটনা। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি, তৃণমূলের নেতাদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, গরু পাচার মামলা – এসব তো আছেই। পাশাপাশি রয়েছে সিপিএমের তরুণ নেতা আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনাও। আনিসের বাবা নিজে ভোটের প্রচারে সাগরদিঘিতে এসেছিলেন। এছাড়াও ঠিক ভোটের আগে আগে আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকিকে গ্রেফতার করাটাও বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনইতিন বিশ্লেষকরা। কারণ, সাগরদিঘি মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। সেই ভোটগুলির অধিকাংশই এবার বায়রন পেয়েছেন।
আরও পড়ুন : কুকথাই অস্ত্র! পঞ্চায়েত ভোটের আগে শুভেন্দুকে এভাবেই বিপাকে ফেলবে তৃণমূলের হোয়াটস্যাপ?
উল্লেখ্য, এবছরই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার আগে সাগরদিঘির এই উপনির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলির কাছে শক্তিপরীক্ষার জায়গা ছিল। বিজেপি সাগরদিঘির একাংশের ভোট পেলেও, রাজ্যের মাটিতে দাঁত ফোটাতে যে এখনও অনেকটাই পথ পেরোতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। দেশজুড়ে মোদি ক্যারিশমা চললেও, বাংলার রাজনীতি যে সেই রাস্তায় চলে না, সেটা আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল। সেইসঙ্গে কপালে ভাঁজ আরও বাড়ল তৃণমূলের। এমনিতেই অনুব্রত মণ্ডল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতারা জেলের ঘানি টানছেন। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক ঘা খাচ্ছে শাসকদল। কোটি কোটি টাকাও উদ্ধার হচ্ছে, সেইসঙ্গে আসছে অর্পিতা-হৈমন্তীদের কাণ্ডকারখানা। এসবই যে ইস্যু হতে চলেছে পরবর্তীতে, সেটা প্রকারান্তরে বুঝতে পারছে ঘাসফুল শিবির।
আর বাম-কংগ্রেস? সাগরদিঘির এই জয়ের পর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল তাদের। তাহলে কি পঞ্চায়েত ভোটেও জোটই ভরসা? জোট করেই লড়বে কাস্তে-হাতুড়ি আর হাত? কংগ্রেসের অবশ্য দাবি, জোটই পারবে তৃণমূলকে হারাতে। সাগরদিঘিই তার প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি ও ভোটের অঙ্ক ভবিষ্যতে ঠিক কী ছবি দেখায়, সেদিকেই এখন নজর সবার।