সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলের বার্তা: সংখ্যালঘুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক নন
Sagardighi By Election West Bengal Politics : শুধু তৃণমূল বিরোধী ভোট নয়, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সমর্থকদের ভোটও কংগ্রেস প্রার্থীর বাক্সে এসেছে।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে শাসক তৃণমূলের পরাজয় ও কংগ্রেস-বামফ্রন্টের জয়কে অনেকেই অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন। তৃণমূলের দিক থেকে সংখ্যালঘুরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন - এমনই বার্তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে।
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি বিধানসভা কেন্দ্রে তিনবার জেতার পরেও ২০২৩-এর উপনির্বাচনে শাসক দলের এই পরাজয়ে সংকেত অবশ্যই রয়েছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সাগরদিঘি কেন্দ্রে, সেই দলই দুই বছরের মাথায় পাচ্ছে ৩৫ শতাংশ ভোট। আর কংগ্রেস-বামেরা ১৯ শতাংশ থেকে ভোট বাড়িয়ে পেয়েছে ৪৭ শতাংশ। বিজেপির ভোটও কমেছে ১০ শতাংশের মতো। শুধু তৃণমূল বিরোধী ভোট নয়, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সমর্থকদের ভোটও কংগ্রেস প্রার্থীর বাক্সে এসেছে।
একটি উপনির্বাচনের ফল দেখেই রাজ্যের রাজনীতির সার্বিক চালচিত্র এঁকে ফেলাও বোধহয় অতি সরলীকরণ হবে। কিন্তু সংকেতগুলি একেবারেই উপেক্ষা করা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব হবে না। বিজেপির ভয়ে যে সংখ্যালঘুরা ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের সমর্থন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে সঁপে দিয়েছিলেন, সেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটাররা তৃণমূলে আস্থা রাখতে পারলেন না কেন? কেন তাঁরা বাম-কংগ্রেসদের জোট প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসের উপর ভরসা রাখলেন?
আরও পড়ুন : মোদির সংকটে ‘পাশে আছি’! দেশকে ভালোবাসার নতুন পাঠ শেখাচ্ছেন রাহুল গান্ধী
২০২১-এ ভয় তো শুধু সংখ্যালঘুরা পাননি, ভয় রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসও পেয়েছিল। তাই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরে বা তার আগে থেকেই রামনবমী দিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে চেপে বসে। তারপরে বিজেপিকে নিয়ে বেজায় ভয়ে ছিল শাসকদল তৃণমূল। ধীরে ধীরে 'হিজাব-হোর্ডিং' সরে গিয়ে ফেসবুক ও টুইটারের পাতা 'মন্দির-দেবতা-দর্শনের' ছবিতে ভরে গেছে। হালে বারাণসীর আদলে গঙ্গারতিও শুরু হয়ে গেছে রাজ্যে।
মেরুকরণের রাজনীতিতে ভয় পেয়ে শাসকদলের নেতৃত্ব যখন ইমেজ-বদলের খেলায় নেমেছে, তখন ধরেই নেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুরা 'দুধেল গাই' হিসেবেই আছে এবং থাকবে। দক্ষিণ কলকাতার 'ধর্মনিরপেক্ষ' নেতা-ই এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। দাপটে থাকবেন শীর্ষ স্তরে। দরকার হলে দলের মুখ হয়ে যাবেন। বাকি সংখ্যালঘু নেতারা নিজেদের জেলায় জেলায় বা এলাকায় প্রতিপত্তিটুকু বজায় রাখতে পারলেই হবে। শীর্ষ নেতৃত্বে তাঁদের আর দরকার নেই। শুধু ভোটবাক্সে ভোটটি এনে ফেলার কাজটি করলেই হবে।
কিন্তু সেই রাজনীতির অঙ্ক যখন গুলিয়ে যায়, তখনই সাগরদিঘি হয়। পিছিয়ে পড়া সমস্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিয়ে উন্নয়নের রাজনীতি করতে গিয়েই নওশাদ সিদ্দিকি শাসক দলের অঙ্ক গুলিয়ে দেন। সদ্য বিজেপি ত্যাগী নেতা বাবুল সুপ্রিয়কে বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে প্রার্থী করতে গেলেও সেই অঙ্ক গুলিয়ে যায় (দক্ষিণ কলকাতা হওয়ায় নেহাত সেখানে শাসক দলের সংগঠন মৌলিকভাবেই শক্তপোক্ত ছিল, তাই ব্যবধান কমলেও জিতে যান বাবুল)।
সাগরদিঘির ফলাফল বলছে, শাসকের প্রতি আস্থা না রেখে ভোটাররা কংগ্রেস ও বামেদের প্রতি আস্থা রেখেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ-দুর্নীতি থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের উপর নিজেদের একচেটিয়া অধিকার রয়েছে বলে যে আত্মসন্তুষ্টি শাসকদলকে গ্রাস করেছে - তার সবটার ফল হাতেনাতে মিলেছে। কিন্তু এতে কংগ্রেস ও বামেদের এখনই উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই। এটি যেমন শাসকদলের জন্য অশনি সংকেত, তেমনই বিরোধী দলগুলির জন্য দায়িত্ববান হওয়ার সংকেতও বটে।
আরও পড়ুন : ১০ বছরের ঘাসফুল দুর্গে ভাঙন! সাগরদিঘিতে কোন মন্ত্রে তৃণমূলকে হারাল বাম-কংগ্রেস জোট?
সময়ের বদল হচ্ছে। শুধুই ভয়ের কারণে, নিরাপত্তার খাতিরে একটি দলকেই সংখ্যালঘুরা একাধারে ভোট দিয়ে যাবে, সেটা ভাবার দিন চলে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের শুধুমাত্র ভোটবাক্স ভাবার দিনও শেষ হবে। উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে একজনও সংখ্যালঘু বিধায়ক ছাড়া বিজেপি রাজত্ব করে চলেছে। সে রাজ্যেরই রামপুরের মতো সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খানের গড়ে বিজেপি প্রার্থী উপনির্বাচনে জয়ী হচ্ছেন।
ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির সঙ্গে কাদের কী অশুভ আঁতাত তা নিয়ে তদন্ত চলছে। চলুক। সত্যি-মিথ্যে তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু নওশাদের রাজনীতির পথে সব রাজনৈতিক দল সামিল হোক। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক উন্নয়নে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরুর সঙ্গে এক সারিতে নিয়ে আসার রাজনীতি হোক।
মনে রাখতে হবে, সেই ২০০১ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন, রাজ্যের মাদ্রাসাগুলি মুসলমান মৌলবাদীদের আখড়া হয়ে যাচ্ছে। তখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে বুদ্ধবাবুর খুব ঘনিষ্ঠতা। সেটা অবশ্য প্রশাসনিক কারণে। কিন্তু তখন থেকেই বামেদের প্রতি অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হতে শুরু করেছিল সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে। তারপর এক দশকে সাচার কমিটির রিপোর্ট এসেছে। রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যে সংখ্যালঘু ও তফসিলি জাতির মানুষেরা কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। শিল্পের জন্য তাদের জমিতে হাত পড়েছে। এই ঘটনা পরম্পরা বর্তমান শাসকদলকে সরকার পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। এটি ঘটতে লেগেছে প্রায় ১০টি বছর।
কাজেই সাগরদিঘি অশনি সংকেত দিয়ে গেলেও, সেই সংকেতকে শাসক ও বিরোধী দলগুলি কে কেমন করে কাজে লাগায় তা দেখতে হবে। এই সংকেতকে বিরোধী দলগুলির অশুভ আঁতাত বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। আবার পুরনো রাজনীতির পথে গিয়ে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক দখল করে রাখার ভাবনা নিয়ে রাজনীতি করলেও চলবে না। পশ্চিমবঙ্গে আরও দায়িত্বশীল রাজনীতি হোক, শাসক-বিরোধী দু'পক্ষের তরফেই।