কেন আক্রমণ সলমন রুশদির ওপর? আসল কারণ লুকিয়ে সেই 'ধর্মীয় ভাবাবেগে'

৭৫ বছর বয়সি বুকারজয়ী লেখক সলমন রুশদির জীবনে বিতর্ক এই প্রথম নয়। লেখকজীবনের শুরু থেকেই তাঁর দুঃসাহসী লেখনীর জন্য বারবার বিতর্ক ও আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছে তাঁকে।

নিজের দীর্ঘ লেখকজীবনে একাধিকবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। নিউ ইয়র্কের শতকা ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় ছুরিকাহত হয়ে ফের আরও একবার শিরোনামে বুকারজয়ী ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সলমন রুশদি।

অ্যাসোসিয়েট প্রেসের সংবাদ অনুযায়ী, রুশদি মঞ্চে বক্তৃতা দিতে শুরু করার পরেই এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি মঞ্চে উঠে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেন সলমন রুশদিকে। সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়েই ১০-১৫ বার রুশদির ঘাড়ে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়। ঘটনার অভিঘাতে আহত হয়ে মাটিতে পরে যান তিনি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নিউ ইয়র্ক পুলিশ আততায়ীকে গ্রেফতার করে এবং জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে গিয়ে রুশদিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭৫ বছর বয়সি বুকারজয়ী লেখক সলমন রুশদির জীবনে বিতর্ক এই প্রথম নয়। লেখকজীবনের শুরু থেকেই তাঁর দুঃসাহসী লেখনীর জন্য বারবার বিতর্ক ও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।

সলমন রুশদি: জীবন ও সাহিত্য
সলমন রুশদির জন্ম স্বাধীনতার ঠিক প্রাক মুহূর্তে। ১৯৪৭-এর ১৯ জুন ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাই প্রেসিডেন্সি তে জন্মগ্রহণ করেন সলমন রুশদি। '১৯৭৫ সালে গ্রিমাস' লেখার মধ্যে দিয়ে রুশদির সাহিত্যজীবনে হাতেখড়ি। ১৯৮১-তে লিখছেন তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা উপন্যাস, ভারতের পটভূমিকায় লেখা 'মিডনাইটস চিলড্রেন'। 'মিডনাইট'স চিলড্রেন' ভারতের স্বাধীনতা, দেশভাগ এর পটভূমিকায় লেখা একটি ম্যাজিক রিয়েল গদ্য। এই বইটির জন্যই বুকার পুরস্কার লাভ করেন রুশদি।   

আরও পড়ুন: জেসন রেকুলাকের ‘হিডেন পিকচার্স’: অসহ্য সাসপেন্স, সত্যসন্ধানী হরর-থ্রিলার

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনের অন্যতম বিতর্কিত উপন্যাস 'দি স্যাটানিক ভার্সেস'।  লেখক হিসেবে নিজের সব লেখায় রুশদি মৌলবাদের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ কোনও নতুন ঘটনা নয়। হাজার বিরোধিতা, প্রাণনাশের হুমকি ও রুশদির কলমকে স্তিমিত করতে পারেনি। নিজের লেখনীর সঙ্গে কখনোই আপোষ করেননি রুশদি। মৌলবাদীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে থেকেছেন তিনি। তবুও থামেনি তাঁর কলম। সেই সময়ও ছদ্মনামে লিখেছেন 'ইমাজিনারি হোমল্যান্ড',  'হারুন এন্ড দি সি অফ স্টোরিজ', 'দি মুরস লাস্ট সাই'-এর মতো বিখ্যাত সব লেখা। আত্মগোপনের পর প্রকাশ্যে এসে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেক বিখ্যাত উপন্যাস  ' দি গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট '। ২০০৭ সালে সাহিত্যে রুশদির অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ তাঁকে নাইট উপাধিতে সম্মানিত করেন।

রুশদি ও বিতর্ক
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত 'দি স্যাটানিক ভার্সেস' নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ইসলামিক দেশগুলির মধ্যে। এই বই লেখার অপরাধে ১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি  ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেইনি রুশদির নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। রুশদির মাথার দাম ধার্য হয় প্রায় ৩০ লক্ষ ডলার। ইসলামিক দেশগুলির উসকানিতে প্রায় সব দেশেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের আক্রমণের স্বীকার হন রুশদি।

রুশদির 'দি স্যাটানিক ভার্সেস' ইসলাম ধর্মগুরু মহম্মদের জীবন থেকে নেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মতে কোরানের বিভিন্ন পংক্তি এবং নবী মহম্মদের জীবনের কাহিনিকে বিকৃত করেছেন রুশদি। উপন্যাসে মহম্মদ কে কোনো কোনও জায়গায় মাহউনদ বলা হয়েছে যা ক্রুসেডের সময় মহম্মদ সম্পর্কে বলা হতো। ইসলাম মৌলবাদীরা এমনই বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে রুশদি কে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণ প্রসঙ্গে একবার রুশদি বলেছিলেন, "আমি যে সময়ে এই বইটা লিখি সেই সময়ে ইসলাম নিয়ে এইরকম মাতামাতি ছিল না। এখন মানুষ আগের থেকে ও অনেক বেশি বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছে।"

'দি স্যাটানিক ভার্সেস'-এর জন্য রুশদি প্রায় ১৩ বছর ছদ্মনামে কাটিয়েছেন। এর আগে নয়ের দশকেও এই বইয়ের জন্য ইতালির মিলান শহরে আক্রান্ত হয়েছেন রুশদি। এমনকী, জাপানি ভাষায় 'দি স্যাটানিক ভার্সেস' অনুবাদের জন্য টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুরি মেরে খুন করা হয় অনুবাদক হিতোসি ইগারাসিকে।

১৯৯৮ সালে ইরানে সরকার বদলের পর রুশদির ওপর থেকে মৃত্যুর 'ফতোয়া' প্রত্যাহার করা হয়। রুশদির ওপর আক্রমণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সময় পাশ্চাত্যে এক নতুন তর্কের উদ্ভব হয়। একদিকে পশ্চিমের দেশগুলো যখন ব্যক্তির স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার তুলে ধরছে বিশ্বের দরবারে ঠিক তখনই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ধর্মীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু এতসব বিতর্কের মাঝেও থামেনি রুশদির 'সাহসী কলম'। বারবারই যে কোনো মৌলবাদের বিরুদ্ধে নিজের লেখার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ জারি রেখেছেন তিনি।

More Articles