বিশ্বে ৩২ টি দেশেই বৈধ, কেন সমকামী মানুষদের বিবাহের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদির সরকার?
Same Sex Marriage: নেদারল্যান্ডস ২০০০ সালে প্রথম দেশ হিসেবে সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেয়। এশিয়ায়, তাইওয়ান প্রথম দেশ যারা ২০১৯ সালে এই ধরনের বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সমকামীদের বিয়ের অধিকার! দেশের শহুরে উচ্চবিত্ত অভিজাতদের ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতে সমকামী বিবাহের স্বীকৃতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে সাংবিধানিক বেঞ্চের শুনানির এক দিন আগে ঠিক এমনই মতামত জানিয়েছে কেন্দ্র। দেশের শীর্ষ আদালতকে এইসব সমকামে বিবাহের আবেদন খারিজ করার আহ্বান জানিয়ে কেন্দ্র বলেছে, সমস্যাগুলি দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চিন্তা ও বুদ্ধির উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউল, বিচারপতি পি এস নরসিমা, বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি এস নরসিংহের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৮ এপ্রিল পিটিশনগুলির শুনানি করবে বলে নির্ধারিত ছিল। উল্লেখ্য, আদালতে সমকামী বিবাহের আইনি স্বীকৃতির দাবিতে ১৫টি পিটিশন জব্দ করা হয়েছে।
একটি নতুন আবেদন জমা দিয়ে, কেন্দ্র জানিয়েছে আদালতের কাছে যে যে আবেদনগুলি এসেছে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার উদ্দেশ্যে, তা আদতে শহুরে অভিজাত উচ্চবিত্তদের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। সমলিঙ্গের বিবাহের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের কোনও সিদ্ধান্তের অর্থ হবে আইনের একটি সম্পূর্ণ শাখার ভার্চুয়াল বিচারিক পুনর্লিখন। আদালতকে অবশ্যই এই ধরনের সর্বজনীন আদেশ জারি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ হলো উপযুক্ত আইনসভা। অর্থাৎ আইনের গতি পরিবর্তনের সেরা বিচারক হচ্ছে আইনসভাই, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই।
“এটি সংবিধানের অধীনে অনুমোদিত একমাত্র সাংবিধানিক পদ্ধতি যা আইনের অধীনে অনুমোদন সহ কোনও সামাজিক-আইনি সম্পর্ককে একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। উপযুক্ত আইনসভাই একমাত্র সাংবিধানিক অঙ্গ যা উপরে উল্লেখিত বিবেচনার বিষয়ে সচেতন। আবেদনকারীরা জাতির সমগ্র জনসংখ্যার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না,” মনে করেছে কেন্দ্র।
আরও পড়ুন- ধূমধাম করে প্রথম সমকামী পুরুষের বিয়ে, কলকাতা সাবালক হল?
কেন্দ্রের দাবি, সমলিঙ্গে বিবাহের অধিকার বিষয়টি দেশের সব মানুষের ভাবনার অংশ নয়, না তো দেশের কোনও সমস্যা, না তো দেশের বৃহৎ অংশের দাবি। দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষই কেবল সমকাম, সমপ্রেমে বিবাহের মতো বিষয় নিয়ে ভাবিত। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে এই নিয়ে আবেদন দাখিল করাও অর্থহীন। এইসব 'ঝামেলা' সামলানোর ক্ষমতা যথেষ্ট রয়েছে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরই।
কেন্দ্রের মতে, বিবাহের প্রতিষ্ঠানটি একটি সামাজিক ধারণা এবং উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামাজিক 'পবিত্রতা' সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক আইন এবং রীতিনীতিও জুড়ে রয়েছে। বিবাহ সামাজিক-আইনি প্রতিষ্ঠান তখনই হয়ে ওঠে যখন সেখানে সামাজিক নৈতিকতা, সাধারণ মূল্যবোধ, ধর্ম, বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা এবং আনুগত্য জুড়ে থাকে।
গত ১৩ মার্চ, ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ দেশে সমকামী বিবাহের আইনি স্বীকৃতি দাবি করা একাধিক পিটিশন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠান। ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেছিলেন, সমকামী বিবাহের স্বীকৃতি দত্তক নেওয়ার মতো একটি আইনের উপর প্রভাব ফেলবে। দেশের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় তখন জানান, কোনও সমকামী দম্পতির দত্তক নেওয়া শিশুটিও যে সমকামী হবে তা তো নয়।
দায়ের হওয়া একটি পিটিশনে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪-এর একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে, যেখানে একজন ব্যক্তির যৌন অভিমুখতার কারণে তাঁর সঙ্গে বৈষম্য করা হবে না। বিশেষ বিবাহ আইনে, যে দম্পতিরা ব্যক্তিগত আইনের অধীনে বিয়ে করতে পারেন না তাঁদের একটি বিশেষ জায়গা দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয়, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিমূলক সমকামী যৌনতা অপরাধ নয়। তবে তাতে এও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল যে রায়টিকে বিবাহের অধিকার সহ কোনও অধিকার প্রদানের মাপকাঠি ভাবলে তা ভুল। সুতরাং, সমকামী দম্পতিদের বর্তমানে ভারতে বৈধভাবে বিয়ে করার অধিকার নেই। পিটিশনগুলির মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের রায়টি একজন সমকামী ব্যক্তির পরিবার এবং জীবনসঙ্গী পছন্দ করার অধিকারকেও সমর্থন করেছে৷ আরেকটি পিটিশন ২০১৪ সালের NALSA বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া এক মামলার রায়ের উল্লেখ করেছে যেখানে শীর্ষ আদালত জানায় যে, নন-বাইনারি ব্যক্তিরা সংবিধানের অধীনে সুরক্ষিত এবং যারা জৈবিকভাবে পুরুষ বা মহিলা তাদের মধ্যেই মৌলিক অধিকার যেমন সাম্য, বৈষম্যহীনতা, জীবন, স্বাধীনতার বিষয়গুলি সীমাবদ্ধ থাকবে না।
আরও পড়ুন- সমাজের চোখে ‘অস্বাভাবিক’, যে অভিমান আজীবন বয়ে বেড়ালেন ঋতুপর্ণ
শীর্ষ আদালতে দাখিল করা একটি হলফনামায় কেন্দ্র সরকার সমকামী বিবাহের বিরোধিতা করে। কেন্দ্র জানায়, ২০১৮ সালের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে সমকামী ব্যক্তিদের মধ্যে যৌন মিলন অপরাধ নয়। তা বলে সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে জীবন ও মর্যাদার মৌলিক অধিকারের অংশ হিসাবে সমকামী বিবাহকে কখনই গ্রহণ করেনি।
কেন্দ্র জোর দিয়ে বলেছে, ভারতীয় পরিবারের ধারণাটি একজন জৈবিক পুরুষ এবং জৈবিক মহিলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে যাতে ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মে গভীরভাবে জড়িত। দেশের সমগ্র আইনী নীতি পরিবর্তন করা তাই সম্ভব হবে না। “বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পবিত্রতার ধারণা সংযুক্ত রয়েছে এবং দেশের প্রধান অংশে এটি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, একটি পবিত্র মিলন এবং একটি সংস্কার হিসাবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে, একজন জৈবিক পুরুষ এবং একজন জৈবিক মহিলার মধ্যে বিবাহের সম্পর্কের বিধিবদ্ধ স্বীকৃতি সত্ত্বেও, বিবাহ অপরিহার্যভাবে বহু পুরনো প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক নীতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে,” হলফনামাতে জানায় কেন্দ্র সরকার।
কেন্দ্র জানিয়েছিল, সমকামী ব্যক্তিদের একসঙ্গে বাস করা প্রথাগত স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানদের ভারতীয় পারিবারিক ধারণার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কেন্দ্র স্পষ্টভাবেই জানায়, ভারতীয় সাংবিধানিক আইনের কোনও ভিত্তি ছাড়া পশ্চিমি সিদ্ধান্ত এই প্রসঙ্গে আমদানি করা যাবে না। সম্ভবত সরকারের এই অনীহা সমকামী বিবাহ বিষয়ে জনমত থেকেই উদ্ভূত। ২০১৯ সালের ১৩ মে থেকে ২ অক্টোবরের মধ্যে ৩৪টি দেশে পিউ রিসার্চ সেন্টার দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায়, ভারতের উত্তরদাতাদের মাত্র ৩৭ শতাংশ বলেছেন যে সমকামিতা বিষয়টি সমাজের গ্রহণ করা উচিত। ওই একই বছর, ইন্ডিয়া টুডে'র মুড অব দ্য নেশন পোলেও দেখা যায় ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা সমকামী বিবাহের বিরোধী ছিলেন।
বর্তমানে বিশ্বের ৩২টি দেশ সমকামী বিয়েকে বৈধ ঘোষণা করেছে, কেউ কেউ আইনের মাধ্যমে আবার কেউ কেউ বিচারিক ঘোষণার মাধ্যমে। এই দেশগুলি হলো আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, ডেনমার্ক, ইকুয়েডর, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উরুগুয়ে। নেদারল্যান্ডস ২০০০ সালে প্রথম দেশ হিসেবে সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেয়। এশিয়ায়, তাইওয়ান প্রথম দেশ যারা ২০১৯ সালে এই ধরনের বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছে।