দেবীর কণ্ঠনালী থেকে বিষ্ণুর চরণ-চিহ্ন, বাংলার এই সতীপীঠে যেতেই হবে পুন্যার্থীকে
৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে ৫টি শক্তিপীঠ অবস্থান করছে বীরভূম জেলায়। শক্তিপীঠের বিচারে বীরভূমকে পূণ্যভূমি বলা হয়।
পতিনিন্দা সহ্য করতে না পারার ফলে সতী দেহত্যাগ করেন। ক্রুদ্ধ মহাদেব দুঃখে যোগানুষ্ঠান পণ্ড করে সতীর দেহ নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের দ্বারা সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে ভাগ করে দেন। এই ৫১টি দেহ খণ্ড যেসব স্থানে পতিত হয়েছিল, সেইসব স্থানে গড়ে উঠেছে এক-একটি পীঠস্থান বা শক্তিপীঠ। সতীর এই একান্নটি দেহ খণ্ড উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে ৫টি শক্তিপীঠ অবস্থান করছে বীরভূম জেলায়। শক্তিপীঠের বিচারে বীরভূমকে পূণ্যভূমি বলা হয়।
কঙ্কালীতলা
বোলপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এই পীঠস্থানটির অবস্থান। এখানে দেবী মায়ের অস্থি বা কঙ্কাল পড়েছিল, মতান্তরে কোমরের হাড় বা কাঁখাল। এই স্থানটির পূর্ব নাম ছিল কাঞ্চিদেশ, বর্তমানে কঙ্কালীতলা নামে পরিচিত। দেবী এখানে 'দেবগর্ভা' নামে পুজো পান। দেবীর কাঁখাল এখানে 'সতী কুণ্ড'-তে নিমজ্জিত রয়েছে এবং সঙ্গে পঞ্চশিব লিঙ্গ নিমজ্জিত রয়েছে সতীকুণ্ডের পবিত্র জলে।
বক্রেশ্বর
বীরভূমের সদর সিউড়ির ২৪ কিলোমিটার দূরে এই পীঠস্থানটির অবস্থান। এর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে 'পাপহরা' নদী। এখানে সতীর ত্রিনয়ন (মতান্তরে ভ্রু-র মধ্যাংশ) পতিত হয়। এখানকার আকর্ষণ হলো উষ্ণ প্রস্রবণ। ১১টি জলকুণ্ড এখানকার মন্দিরের পাশে পাশেই রয়েছে। এখানে পঞ্চ শিবের অবস্থান রয়েছে। দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী, অর্থাৎ দশভূজারূপে পুজো পান। দেবীর মূর্তিটি পিতলের। দেবী মাতার এই একই রূপ দেখা যায় বাংলাদেশের 'ঢাকেশ্বরী' মন্দিরের মূর্তিতে।
নন্দপুর
সাঁইথিয়া রেলস্টেশনের ঠিক পাশেই রয়েছে দেবী 'নন্দীকেশরী'-র মন্দির। এই অঞ্চলের পূর্বে নাম ছিল নন্দপুর। তবে এই নামকরণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এখানে সতীর কণ্ঠহাড় পড়েছিল। একটি সুবিশাল বটবৃক্ষের নিচে দেবী অবস্থান করছেন। দেবীমূর্তিটি এখানে কালো পাথরের তৈরি, কিন্তু প্রতিনিয়ত সিঁদুরে চর্চিত হবার ফলে দেবী মূর্তিটি লালবর্ণ ধারণ করেছে।
লাভপুর
বোলপুর থেকে লাভপুরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এই লাভপুরের খুব কাছেই রয়েছে দেবী 'ফুল্লরা'-র মন্দির। এখানে সতীর নিচের ঠোঁটের অংশ পড়েছিল। অসংখ্য তেঁতুল গাছের ছায়ায় চতুর্ভূজাকৃতি দেবী ফুল্লরা মন্দিরটি-তে নির্দিষ্ট কোনও বিগ্রহ নেই। কচ্ছপাকৃতি একটি শিলা খণ্ডে দেবীর রূপ দেওয়া হয়েছে। কথিত আছে, কোনও এক সময় এই মন্দিরের চূড়ায় সোনার কলস শোভা পেত, যদিও বর্তমানে তা দেখা যায় না।
নলহাটি
নলহাটি স্টেশন থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরেই দর্শন পাওয়া যাবে দেবী 'নলাটেশ্বরী'-র। এখানে সতীর কণ্ঠনালী পড়েছিল। সারা বছর নিত্যপুজো হলেও বছরের দু'বার এখানে বিশেষ পুজো দেওয়া হয়।
আজ দেবী 'শেফালিকা' বা নলহাটির 'নলাটেশ্বরী' সতীপীঠের অলৌকিক কাহিনি আলোচনা করব।সতীর খণ্ডিত দেহের 'কণ্ঠনালী' পড়েছিল বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, ঝাড়খণ্ডের কাছাকাছি নলহাটি-তে। প্রত্যহ নিত্যপুজো হলেও, এখানে বছরে দু'বার বিশেষ পুজো হয়। দুর্গাপুজায় এবং কালীপুজায়। এখানে দেবী মা 'শেফালিকা' নামে পরিচিতা। এখানকার ভৈরব হলো 'যোগীশ'। শাস্ত্রে দেবী কালিকা শেফালিকা হলেও স্থানীয় লোকজন দেবীকে ললাটেশ্বরী বলে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু প্রণাম মন্ত্রে 'নলাটেশ্বরী' উচ্চারিত হয়।
মায়ের অঙ্গশিলা উদ্ধারের সময় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। যার সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীমায়ের দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছিল, সেই গোবিন্দের চরণচিহ্নিত একটি শিলাখণ্ড এখানে পাওয়া যায়। আর কোনও সতীপীঠে এই ঘটনা ঘটেনি। ভগবান নারায়ণের চরণচিহ্নিত সেই শিলাখণ্ডটি এখানে পূজিত হন দেবী মাতার সঙ্গে। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে দেবীর বাৎসরিক পুজা অনুষ্ঠিত হয়।
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী জানা যায়, সতীর কণ্ঠনালী উদ্ধার করেছিলেন স্বয়ং কামদেব। জনশ্রুতি আছে, কয়েকহাজার বছর আগে স্বয়ং কামদেব মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তিনি মায়ের কাছে আদেশ পান, ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে মায়ের কণ্ঠনালী পড়ে আছে। কামদেব যেন মায়ের অঙ্গশিলা সেখান থেকে উদ্ধার করেন। কথিত আছে, এখানে পাথরের টিলাতে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসের সময় কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। এখানে সীতার চুল আঁচড়ানোর দাগ ও কড়ি খেলার গর্ত আছে। শোনা যায়, আনুমানিক পাঁচশো বছর আগে পাইকপাড়া গ্রামের এক ব্যবসায়ী রামচরণ শর্মাকে মা আদেশ দেন খোলা আকাশের নিচে তিনি পড়ে আছেন। তাঁকে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। একটি গাছের নিচে মায়ের দেহাংশটি পড়েছিল, সেখানে মন্দির স্থাপিত হয়। কোনও এক সময় জায়গাটি ঘন জঙ্গলে ও জীবজন্তুদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, সূর্যের আলো এখানে পৌঁছত না। এখানে কিছু গর্তের সন্ধান পাওয়া যায়, অনেকের বিশ্বাস এই গর্তগুলি আসলে সুড়ঙ্গ। মন্দিরে যাওয়ার গোপন রাস্তা। এখানে মাতৃমূর্তি প্রস্তরীভূত (পাথরের তৈরি)। প্রত্যেকদিন দেবীকে স্নান করিয়ে মঙ্গলারতি করার পূর্বে দেবীর পাথরের অঙ্গ ভক্তদের দর্শন করানো হয়। মা ত্রিনয়নী,তাঁর জিহ্বাটি সোনার। শিবরাত্রিতে দেবীর মন্দির ও ভৈরব শিবের মন্দিরে হলুদ সুতো দিয়ে বাঁধা হয় এবং দেবীমাতা ও ভৈরব শিবের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়।
মূল মন্দিরটি নির্মাণ করান নাটোরের রানি ভবানী। মুর্শিদাবাদের নসিবপুরে দেবী সিংহের পত্নী রানি সূর্য কুমারীর নামে ছিল দেবোত্তর সম্পত্তি। মন্দিরের উত্তর দিকে আছে পঞ্চমুন্ডির আসন। ১২৯৬ সালে জনৈক স্বামী কুশলানন্দ ব্রহ্মচারী কাশী থেকে প্রথম তারাপীঠ আসেন এবং সেখান থেকে নলহাটি এসে পঞ্চমুন্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। মন্দিরের উত্তরে সেই সিংহাসন আজও বর্তমান।
অতীতের নলহাটি আর কালিন্দিপুর গ্রাম নিয়ে আজকের নলহাটি শহর। সনাতন ভারতের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে যুক্ত নলাটেশ্বরী মন্দির। শক্তিপীঠের কথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট জনশ্রুতি, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পশ্চাদপট। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের পর প্রস্তরবিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়। রাত আটটা পর্যন্ত মন্দিরের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। নলাটেশ্বরীর পুজোর প্রধান উপকরণ চাঁছি ও পেঁড়ার সন্দেশ। সারাদিন মাতৃনামে মুখর থাকে নলাটেশ্বরী মন্দির।