এই ঘাটেই সহমরণে যেতেন মহিলারা! কলকাতার বুকে আজও দগদগে ঘা সতীদাহ ঘাট!

Balaram Basu Ghat: খালি চোখে দেখে মনে হয়, খুব কাঁচা হাতে কোনও ধারালো জিনিস দিয়ে অযত্নে অক্ষরগুলি লেখা হয়েছে।

কলকাতা, ইতিহাসের এক ডাকনাম। সেই ইতিহাসের কিছু অধ্যায় যেমন গর্বের, ঠিক তেমনই মাঝে মাঝে চোখের সামনে উঠে আসে কিছু অন্ধকার অধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় রয়েছে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এই রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে চললে দক্ষিণ কলকাতার বুকে দেখা মেলে এক টুকরো পুরনো কলকাতার। গলি থেকে বাড়ি, নতুন কলকাতার জাঁকজমকের ঠ্যালা সামলে কিছুটা কুণ্ঠিতভাবেই কোনওক্রমে টিকে থাকার যেন এক মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে। পুরনো এবং নতুন কলকাতার জগাখিচুড়ি বাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে বলরাম বসু ঘাট রোড নামে একটি রাস্তা আদি গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে শেষ হয়। কালীঘাটের অনতিদূরে অবস্থিত এই ঘাটের নাম বলরাম বসু ঘাট। ঘাটটি আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ, আকারে ছোটো, কিছু অংশে যত্নের অভাব লক্ষ্যণীয়। যদিও ঘাটের শুরুর চাতাল পেরিয়ে যেতেই মাটিতে দেখা যায় বাঙালির অন্ধকার ইতিহাসের এক পাতা।

ঘাটের ছাদনি পেরিয়ে দু'টি সিড়ি নামার পরেই মাটিতে কয়েকটি প্রায় অস্পষ্ট বাংলা শব্দ লক্ষ্য করা যায়। খুব খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, মাটিতে লেখা রয়েছে সতীদাহ স্থান। ঘাটের মাটিতে সতীদাহ স্থান লেখার কারণ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। সেই বিভিন্ন মত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উঠে আসে একইসঙ্গে দুই মহিলার সহমরণ থেকে শুরু করে রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের অন্যতম ব্যর্থতা এবং আরও অনেক কিছুই। ঘাটের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষ এবং ঘাটে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষও এই স্মৃতিফলকের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নন।

যারা এই স্মৃতিফলকের অস্তিত্ব জানেন তাদের মত অনুসারে, এই ঘাটে সতীদাহ হয়েছিল বলেই ঘাটের সিঁড়িতে এই স্মৃতিফলক রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, যে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন এলাকায় সহমরণের মতো ঘটনা ঘটলেও এই ঘাটে সেই সম্পর্কে আলাদা করে স্মৃতিফলক তৈরির দরকার কেন পড়ল? প্রশ্নের একটু দায়সারা উত্তর হিসাবে বহু মানুষ বলেন, হয়তো যারা সহমরণে গিয়েছিলেন তাদের পরিবার স্মৃতি রক্ষার্থে এই ফলক নির্মাণ করেছিলেন। এই কারণ ছাড়া হয়তো ফলকটির কোনও বিশেষত্ব নেই। কিছু মানুষ যদিও বলেন, এই ঘাটে একইসঙ্গে দুই মহিলা সহমরণে গিয়েছিলেন কিন্তু বিস্তারিত তথ্যের অভাবে তাও ঠিক নিশ্চিত করে বলা যায় না। সত্যতা যাচাই না করেই অনেকেই নিজের মতো কাহিনিও গড়ে নেন। যার ফলে বাস্তবের এক বিকৃত রূপ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এই ফলকটিও সেই চক্র থেকে মুক্তি পায়নি। ইতিহাস ঘাঁটলে আরেকটা তথ্য উঠে আসে যে, এই ঘাটে সম্ভবত বাংলার সর্বপ্রথম সহমরণের আয়োজন হয়েছিল। তাই ঘাটে এই ফলকটি লেখা রয়েছে। এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। ফলকটি দেখে তার বয়সের অনুমান করলে বোঝা যায়, ফলক নির্মাণের আনুমানিক সময়ের বহু পূর্বেই বাওয়ালি মণ্ডল বাড়ির মুক্তকেশী মণ্ডল সহমরণে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- নির্লিপ্ত মুখে চিতায় ঝাঁপ, বাংলার শেষ সতীদাহের ঘটনা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবে

বহু মানুষ ফলকটির সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দিহান হয়েছেন। তার কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, ফলকটি আমাদের পরিচিত আর পাঁচটা ফলকের মতো দেখতেও না। খালি চোখে দেখে মনে হয়, খুব কাঁচা হাতে কোনও ধারালো জিনিস দিয়ে অযত্নে অক্ষরগুলি লেখা হয়েছে। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় সতীদাহ অথবা সহমরণের নিদর্শন স্বরূপ বিভিন্ন চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এই ঘাটে সেইরকম কিছুই চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। শ্বেত পাথরের ফলক, অশ্বারোহীর খোদাই করা ছবি, চাঁদ, সূর্য এবং মহিলার কনুই থেকে হাতের আঙুল অবধি খোদাই করা কোনও প্রতিকৃতি ঘাটে নেই। তাই বহু মানুষ মনে করেন, বাংলার অন্য জায়গার মতোই এই ঘাটে সতীদাহ হয়েছিল এবং সেই সময়ের নিরিখে এটি খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। যদিও ঘাটের অপর পাড়ের আশেপাশের এলাকায় থাকা বিভিন্ন মন্দিরে একইভাবে বিভিন্ন খোদাই করা ফলক পাওয়া গিয়েছে। এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, হয়তো এই এলাকায় সেই সময়ে এই রীতিতে স্মৃতিফলকে খোদাই করা হতো। মানুষ যেহেতু নিজের অন্ধকার অতীতকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় এবং এই ঘাট কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘাট হওয়ার স্বপক্ষে সাধারণত প্রমাণ পাওয়া যায় না তাই এই ফলক এবং তার সঙ্গে জড়িত ইতিহাস সম্পর্কে আপামর জনসাধারণের খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া পাতা থেকে উঠে আসে একটা অজানা গল্প।

১৮১৭ সালের শেষ দিকে জনৈক নীলু কবিরাজ দেহত্যাগ করলে তার দুই যুবতী স্ত্রী সহমরণের সংকল্প করেছিলেন। সেই সময়ে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ বন্ধের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ সরকার সমাজের মাথাদের না চটিয়ে নিদান দিল, কোনও মহিলা সহমরণে যেতে চাইলে তাদের স্বেচ্ছায় অনুমতি নিতে হবে। নীলু কবিরাজের তেইশ এবং সতেরো বছর বয়সী দুই স্ত্রী সেই অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাজা রামমোহন রায়ের কানে এই খবর পৌঁছনো মাত্র তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে যত দ্রুত সম্ভব কালীঘাটের কাছেই সেই ঘাটে ছুটে গেলেন। তাঁর উপস্থিতি ঘাটে আগত বহু মানুষের মধ্যে বিরক্তি এবং ভয়ের প্রকাশ ঘটালেও সে সবের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই তিনি যুবতীদের বহুভাবে বুঝিয়ে সহমরণ থেকে বিরত করতে চাইলেন। প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, যুবতীদের জোর করে আগুনে প্রবেশ করানো যাবে না। তাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। তিনি ভেবেছিলেন যুক্তি তর্ক গ্রহণ করার অবস্থায় ওই মেয়েরা না থাকলেও আগুনের লেলিহান শিখা হয়তো তাদের মনে ভয়ের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম হবে।

আরও পড়ুন- কেমন হতো বিদ্যাসাগরবিহীন বাংলা, কী হতো রামমোহনের জন্মই না হলে?

বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাজা রামমোহন শুধু যে ব্যর্থ হলেন তাই না, বরং দ্বিতীয় যুবতী চিতায় প্রবেশ করার পূর্বে রামমোহনের উদ্দেশ্যে শ্লেষমিশ্রিত সাবধানবাণী হিসাবে জানান, রামমোহন যদি হিন্দু মহিলাদের কর্তব্যের প্রতি বাধা দিতে থাকেন তাহলে তিনি হিন্দু মহিলাদের অভিশাপ পাবেন। সম্ভবত বলরাম বসু ঘাটের স্মৃতিফলক এই ঘটনার নিদর্শন হিসাবে থেকে গিয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির ১৮১৮ সালের প্রবন্ধ এবং অলোক সরকারের লেখা শ্মশান সংক্রান্ত বইটিতে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও রামমোহন আসলে কোন বিষয়ে বেশি দুঃখিত হয়েছিলেন সেই বিষয়ে যেন সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য তিনি যে আন্দোলন করছিলেন সেই সময়ে, তাঁর চোখের সামনে দুই মহিলার সহমরণে অংশ নেওয়া নাকি যাদের উদ্ধার করতে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছেন তাদের অজ্ঞতা তাঁকে বেশি ব্যথিত করেছিল, উত্তর মেলে না।

মহিলাদের সহমরণে যাওয়ার আগে যে ভাঙের মতো মাদক দেওয়া হতো সেই তথ্য বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। তবুও বলা যেতে পারে, নির্দ্বিধায় আগুনে প্রবেশের পিছনে শুধুমাত্র মাদকের অবদান ছিল না। তার সঙ্গে যোগ হতো শাস্ত্রের ভুল অনুবাদ, অজ্ঞতা এবং একইসঙ্গে নিজেকে মানুষের ঊর্ধ্বে অনুভব করার প্রবণতা। সহমরণে যাওয়ার পূর্বে মানুষের তার কাছে বাণী শুনতে আসা, তার ছড়িয়ে দেওয়া জিনিস প্রসাদের মতো গ্রহণ করার জন্য ছোটাছুটি এবং মৃত্যুর পরে স্বর্গ যাত্রার মতো প্রস্তাব অন্দরমহলে থাকা মানুষগুলোর কাছে পুণ্য অর্জনের রাস্তা বলেই মনে হতো। হিন্দু শাস্ত্রে যে শ্লোকের মাধ্যমে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীকে সংসার রক্ষার দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে, সেই শ্লোকের ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ভুল অনুবাদের ফলে সেই শ্লোক দীর্ঘ সময় ধরেই সতীদাহের সমর্থনে ব্যবহার করা হয়েছে। অজ্ঞতা, সঠিক তথ্যের অনুসন্ধানে অনীহা, ভীতির ফলে চলতে থাকা এক ভয়ঙ্কর রীতির অবসান ঘটলেও মানুষের মধ্যে আজও সঠিক তথ্য যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতা জাগেনি আজও। বলরাম বসু ঘাটের ফলক মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে সেই অন্ধকারই যেন দেখিয়ে দেয় আবারও।

 

 

তথ্য ঋণ : শ্মশান মিথ, পুরাণ, ইতিহাস (অলোক সরকার )

More Articles