কালীর মূর্তি নেই, বীজমন্ত্রে পূজিত হন দেবী || বর্ধমানের এই শক্তিপীঠে পড়েছিল সতীর বাম বাহু

এই পীঠ সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। যেমন গভীর রাত্রে এখানে নূপুরের রিনিরিনি ধ্বনি শোনা যায়।এলোচুলে কেউ ঘুরে বেড়ায়, এমনকী, হাসির ধ্বনিও অনেকে শুনেছে‌।

সতীর দেহত্যাগের কাহিনি এবং দক্ষরাজার যজ্ঞ পণ্ড হওয়ার ঘটনা সকলেরই জানা। পিতৃগৃহে পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতীমাতা যজ্ঞগৃহেই দেহত্যাগ করেন।এরপর সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেবের তাণ্ডবনৃত্যর ফলে ত্রিভুবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীমায়ের দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত করে দেন। এই ৫১টি খণ্ড যে সকল স্থানে পড়েছিল, সেই সেই স্থানে গড়ে ওঠে এক একটি সতীপীঠ তথা শক্তিপীঠ, তা হয়ে ওঠে পবিত্র পূণ্যভুমি ও তীর্থক্ষেত্র।

বর্ধমান জেলায় ৪টি সতীপীঠ আছে। সেগুলি হলো, ক্ষীরগ্রাম, বহুলা, অট্টহাস এবং উজানি। বহুলা সতীপীঠ সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করা যাক।

পীঠনির্ণয় তন্ত্রমতে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল বহুলায়।পূর্বে কেতুগ্রামকে বেহুলা বা বাহুলা নামে ডাকা হতো।পরবর্তীকালে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে গ্রামের নাম হয় কেতুগ্রাম। রাজা চন্দ্রকেতু কার্তিক ও গণেশ-সহ বহুলা মাতার পাথরের মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্ধমানের কেতুগ্রামে অজয় নদীর তীরে মাতাবহুলা বা বহুলা মন্দিরটি অবস্থিত। কেতুগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বহুলা মাতা। এখানে মাতা 'বহুলাক্ষী' দেবী ও ভৈরব 'ভীরুক'। পীঠনির্ণয় তন্ত্রে এই শক্তিপীঠকে দ্বাদশ শক্তিপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যগ্রন্থে এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে 'বহুলা চণ্ডিকা' বলা হয়েছে।প্রাণতোষণী তন্ত্রে এই পীঠ ও এখানকার ভৈরব সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু জ্ঞানার্ণব তন্ত্র, কুব্জিকা তন্ত্রে এই পীঠ ও এখানকার ভৈরবের উল্লেখ নেই। অন্যান্য সতীপীঠের মতো এই মন্দিরের সঙ্গে ভৈরব অবস্থান করেন না। গ্রামের অন্যদিকে অজয় নদীর তীরে শ্মশানে 'মরাঘাট মহাপীঠ' নামে একটি মন্দিরে ভৈরব ভীরুক অবস্থান করেন।

আরও পড়ুন: চামুন্ডার মূর্তি যেন জীবন্ত, শিহরণ আর ভক্তি মিলেমিশে থাকে এই সতীপীঠে

পীঠনির্ণয় তন্ত্র মতে- 'বহুলায়ং বাম বাহুবর্হুলাখ্যা এ দেবতা ভীরুকো দেবতাস্ত্রত্র সর্বসিদ্ধি প্রদায়কঃ।'

Bahula

ভারতচন্দ্র 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন- "বহুলায় বাম বাহু ফেলিল কেশব।বেহুলা চন্ডিকা তাহে ভীরুক ভৈরব।।" 'শিবচরিত' গ্রন্থে উল্লেখ আছে, এই কেতুগ্রামেরই 'রণখণ্ড' নামে একটি স্থানে সতীর 'ডান কনুই' পতিত হয়েছিল। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন 'বহুলাক্ষী' ও ভৈরব 'মহাকাল'। কিন্তু এই নিয়ে অনেক মতান্তর আছে। এখানে দেবী চতুর্ভুজা, পদ্মের ওপর বিরাজমানা, একহস্তে ধরে আছেন কঙ্ক (চিরুনি), অন্য হস্তে ধারণ করে আছেন দর্পণ, বাকি দুই হস্তে 'বর ও অভয় মুদ্রা'। কিন্তু দেবীর এই রূপ দর্শন করা যায় না, কারণ দেবীমূর্তি সম্পূর্ণভাবে সুন্দর করে কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়। শুধুমাত্র মুখ ছাড়া অন্য কোনও অঙ্গ দর্শন করা যায় না। গবেষকদের মতে, দেবীর নাম এখানে 'ললিতা'। দেবী মাতা এখানে যুগ্মভাবে দুর্গা ও কালী- এই দুই রূপেই পুজো পেয়ে থাকেন। দেবী মাতার দক্ষিণ দিকে অষ্টভূজ গণেশের মূর্তি বিরাজ করছে (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সারা ভারতে এই অষ্টভূজাকৃতি গণেশের মন্দির আছে মোট চারটি), দেবীর বামদিকে বিরাজ করছেন কার্তিক। বহুকাল আগে 'রাও' পদাধিকারীরা এই মন্দিরের সেবাইতের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এখনও 'রায়' (রাও থেকে রায়) বংশের বংশধররাই দেবী মাতার সেবাইতের কাজ করে আসছেন। এখানে একটি পবিত্র কুণ্ড বা পুকুর বর্তমান। এর জলে ডুব দিলে সর্বরোগ সেরে যায় বলে জনশ্রুতি আছে।

সারা বছর দেবীর নিত্যপুজো হয়। প্রত্যহ দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। অত্যন্ত শান্ত এবং নিরিবিলি পরিবেশ, মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে এই মন্দিরে এলে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো ছাড়াও শিবরাত্রি ও গাজনের সময় ধুমধাম হয় এবং মেলা বসে। গাজনের সময় বুড়ো 'শিব'-কে নাটমন্দিরে আনা হয়।

Bahula

এই পীঠ সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। যেমন গভীর রাত্রে এখানে নূপুরের রিনিরিনি ধ্বনি শোনা যায়।এলোচুলে কেউ ঘুরে বেড়ায়, এমনকী, হাসির ধ্বনিও অনেকে শুনেছে। যদিও এই সকল জনশ্রুতি শুনলে গা ছমছম করে, কিন্তু তবুও মাতৃমন্দিরে প্রবেশ করলে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। যুগ যুগ ধরে এই যুগ্মপীঠে বহু তন্ত্রসাধক মূর্তিবিহীন কালীকে 'কালিকাপুরাণ'-এ বর্ণিত বীজমন্ত্রের দ্বারা পুজো করেন। সহস্রাধিক বৎসর ধরে এই যুগ্মপীঠে মা কালী এবং মা দুর্গা এই দুই রূপেই পূজিতা হন জাগ্রত দেবী মা বাহুলা (বহুলাক্ষীমাতা)।

 

More Articles