স্বপ্নাদেশে দেবী বন্ধ করেছিলেন নরবলি! আজও ভক্তদের ঠিকানা বাংলার এই শক্তিপীঠ
এই সতীপীঠটি বর্ধমান থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে মঙ্গলকোট ব্লকের নিকট 'ক্ষীরগ্রামে' অবস্থিত। এই গ্রামে ক্ষীরদিঘি নামে একটি বড় জলাশয় রয়েছে।
দক্ষরাজের যজ্ঞানুষ্ঠান পণ্ড করার পর দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিভুবন ধ্বংসকারী তাণ্ডবনৃত্য শুরু হলে, সৃষ্টিকে ধ্বংসর হাত থেকে রক্ষা করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীমায়ের দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দিলেন। সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে যেখানে যেখানে পতিত হলো, সেই স্থানে গড়ে উঠল একটি করে সতীপীঠ তথা শক্তিপীঠ। বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে দেবীর দক্ষিণ পদাঙ্গুষ্ঠ পতিত হয়েছিল এবং এই স্থানে গড়ে উঠেছে একটি সতীপীঠ। রাঢ়বাংলার বর্ধমান ও বীরভূম জেলার মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে ন'টি শক্তিপীঠ। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার অনতি দূরে মঙ্গলকোটের কুয়ারপুর গ্রামের 'মা যোগাদ্যা' এমনই একটি শক্তিপীঠ।
ক্ষীরগ্রামে ভৈরবঃ ক্ষীরখন্ডকঃ।
যুগাদ্যা সা মহামায়া দক্ষাঙ্গুষ্ঠ পদো মম।
'অন্নদামঙ্গল' কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বলেছেন,
ক্ষীরগ্রামে ডানি পা'র অঙ্গুষ্ঠ বৈভব।
যুগ্যাদা দেবী সেথা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব।
অর্থাৎ, সতীমায়ের দক্ষিণ পদের আঙুল এখানে পতিত হয়েছে এবং দেবী যোগাদ্যা ও ভৈরব ক্ষীরখণ্ডক এখানে বসবাস করছেন।
আরও পড়ুন: চুরি হয়েছিল অষ্টধাতুর বিগ্রহ! বর্ধমানের এই শক্তিপীঠের প্রতি পরতে জড়িয়ে পৌরাণিক কাহিনি
এই সতীপীঠটি বর্ধমান থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে মঙ্গলকোট ব্লকের নিকট 'ক্ষীরগ্রামে' অবস্থিত। এই গ্রামে ক্ষীরদিঘি নামে একটি বড় জলাশয় রয়েছে। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে এই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে দেবী সতীর দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পতিত হয়েছে। দেবী যোগাদ্যা মায়ের স্থায়ী বাসস্থান এই জলাশয়ের নিচে। বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবীকে জল থেকে তুলে এনে মূল মন্দিরে ভক্তদের সামনে রাখা হয় চারদিনের জন্য। এই সময় মাত্র দু'দিন সকলের অধিকার থাকে দেবীকে স্পর্শ করে পুজো দেওয়ার। এই উপলক্ষে সারাদিনব্যাপী মায়ের পূজা-আরাধনা চলে ও সুবিশাল একটি মেলা বসে। এই উৎসবকে 'শাঁখা উৎসব'-ও বলা হয়।
জনশ্রুতি অনুসারে যোগাদ্যা মায়ের এই দিঘির ঘাটে বসে শাঁখা পরার একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। গ্রামের বধূরা এই দিন শাঁখা পরেন। পুজোশেষে ভোরবেলা আবার দেবীকে ক্ষীরদিঘির জলে ডুবিয়ে রেখে আসা হয়। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময় বিশেষ বিশেষ দিনে জল থেকে তুলে এনে মন্দিরে স্থাপন করে পূজার্চনা করা হয়, কিন্তু ভক্তগণ মায়ের দর্শন পান না।শুধুমাত্র বৈশাখী সংক্রান্তিতে দেবী মাতার দর্শন করা যায়।
বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান। কিন্তু এরপর কোনওভাবে মূর্তিটি হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়বার মহারাজার নির্দেশেই দাঁইহাটের নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে প্রথম মূর্তিটির অনুকরণে আরেকটি দশভূজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়। রীতি অনুযায়ী এই মূর্তিটিকেও আগের মতো ক্ষীরদিঘির জলে ডুবিয়ে রাখা হতো। হঠাৎ এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটে, ক্ষীরদিঘির সংস্কারের সময় হঠাৎ নতুন মূর্তিটির সঙ্গেই উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিও। এরপর মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে সম্পূর্ণ একটি আলাদা মন্দির তৈরি করেন গ্রামের মানুষ। সেই নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিরে পাওয়া দেবী মূর্তিটি।
এর ফলে বর্তমানে গ্রামে গেলেই দেবী দর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু সংক্রান্তিতে নিয়মানুযায়ী নতুন মূর্তিটিকে জল থেকে তুলে এনে দেবীর আরাধনা করা হয়। কিছু ঐতিহাসিক দাবি করেছেন, এই গ্রামে পূর্বে কিছু পণ্ডিত বিদ্যাচর্চা করতেন এবং বেশ কিছু চতুষ্পাঠীও ছিল, তার সাক্ষী বহু প্রাচীন পুঁথি। গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী জানিয়েছেন, এই প্রাচীন পুঁথিগুলির মধ্যে ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনার পুঁথি পাওয়া গেছে। তাঁর মতে, কবি কৃত্তিবাস সবার আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন।কবির মতে, মহীরাবণ বধের পর তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পাতালপুরী থেকে পৃথিবীতে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন স্বয়ং রামচন্দ্র। সুতরাং, পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে এই যোগাদ্যা মায়ের দশভূজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামচন্দ্র।
কথিত আছে, মহীরাবণ তাঁর আরাধ্যা দেবী এই ভদ্রকালী যোগাদ্যার সম্মুখে নরবলি দিতেন। শ্রীরামচন্দ্র যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করবার পর হরিদত্ত নামে জনৈক জমিদারকে দেবী স্বপ্নে দর্শন দেন এবং আদেশ করেন, নরবলি দিয়ে নিত্যপুজো করার জন্য। রাজা প্রথমে সাতদিন নিজের সাত পুত্রকে বলি দিলেন, তারপর প্রত্যেক গৃহে একজন করে বলি প্রদত্ত হতে লাগল। এইরকমভাবে পুজো চলতে থাকলে, একদিন এক পূজারীর ঘরে নরবলির পালা এল। পুজোর আগের দিন রাতে সপরিবারে সেই পূজারী ব্রাহ্মণ গ্রাম ছেড়ে পালাতে গেলেন। পথিমধ্যে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে সকলে একটি গাছের নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমন্ত অবস্থায় ব্রাহ্মণ স্বপ্নে দেখলেন লাঠি হাতে এক বৃদ্ধা তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, এই রাতে তাঁরা গাছের নিচে শুয়ে আছেন কেন! পূজারী তখন বললেন, "এই ক্ষীরগ্রামে এক রাক্ষসী এসেছে মা, তাঁকে প্রত্যহ নরবলি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হয়। রাত পোহালেই আমার ছেলের পালা। তাই ছেলের প্রদান বাঁচাতে আমরা গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছি।" এই কথা শুনে দেবী খুব কষ্ট পেলেন, তিনি ব্রাহ্মণকে বললেন, যার ভয়ে পালাচ্ছিস, আমিই সেই যোগাদ্যা। তুই ঘরে ফিরে যা,আজ থেকে নরবলি চিরতরে বন্ধ। সেই দিন থেকেই বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
এই সতীপীঠের ভৈরব হলেন 'ক্ষীরখণ্ডক'। যোগাদ্যার মন্দির থেকে অনতিদূরে একটি টিলার ওপর ভৈরব 'ক্ষীরখণ্ডক' শিবের মন্দির। এই গ্রামেরই এক প্রান্তে ধামাসদিঘি, পুরাণে আছে ওই দিঘির ঘাটে বসে যুবতীর বেশে 'উমা' শাঁখা পরেছিলেন, সেই থেকে শাঁখা উৎসবকে কেন্দ্র করে ভক্তের ঢল নামে, এবং ওই দিন যোগাদ্যা শাঁখা পরেন। দেবী মূর্তিটি কালো কষ্টিপাথরের তৈরি। দেবী এখানে দশভূজা ও মহিষাসুরমর্দিনী-রূপে বিরাজিতা। বৈশাখ সংক্রান্তিতে মায়ের পুজো ছাড়া, দুর্গাপুজো খুব ধুমধাম-সহকারে পালিত হয় এখানে।