চামুন্ডার মূর্তি যেন জীবন্ত, শিহরণ আর ভক্তি মিলেমিশে থাকে এই সতীপীঠে

দন্তুরা চামুন্ডার মূর্তিটি অদ্ভুত ধরনের দেখতে। কঙ্কালসার চেহারায় ফুটে উঠেছে বুকের পাঁজর। কান দু'টি শরীরের তুলনায় অনেক বড়। বিস্ফারিত গোলাকার দু'টি চোখ, আঁচড়ানো চুল পিঠের ওপর পড়েছে।

পূর্ব বর্ধমানের নিরোল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে দক্ষিণ ডিহি গ্রামে অবস্থিত 'অট্টহাস শক্তিপীঠ'‌। এর উত্তরে বয়ে চলেছে ঈশানী নদী, তার কিছুটা দূরেই শ্মশান। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পিঠস্থান। কোনও এক অজানা কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা রাতের বেলায় এড়িয়ে চলেন অট্টহাস মন্দির। নানা অলৌকিক ঘটনা জড়িয়ে আছে এই অট্টহাস মন্দিরকে ঘিরে। দন্তুরা চামুন্ডার মূর্তি,দর্শনে খুবই ভয়াবহ। যদিও বর্তমানে দন্তুরা চামুন্ডার মূর্তিটি 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ'-এর সংগ্রহশালায় রয়েছে, তবু রাতের বেলা অট্টহাস মন্দিরে আসতে গা-ছমছম করে। এখানে দেবী 'ফুল্লরা' ও ভৈরব 'বিশ্বেস'। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে সতীর অধর, অর্থাৎ ঠোঁটের নিম্নাংশ এই স্থানে পড়েছিল। তাই দেবী এখানে 'অধরেশ্বরী' নামে পূজিতা হন। এখানে রয়েছে দেবীর একটি প্রাচীন শিলামূর্তি, মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি খোয়া গেছে।

একটি গহন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত এই অট্টহাস মন্দির, হয়তো সেই কারণেই অন্যান্য সতীপীঠের মতো অট্টহাসের পরিচিতি নেই বললেই চলে। প্রাচীন এই অট্টহাস মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু কাহিনি এবং ইতিহাস। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সঠিকভাবে বলা যায় না, কিন্তু ১৭৪২ সালে এই মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। মায়ের প্রধান শিলাটি ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে চলে গেছে। পুরনো কিছু নথি এবং কিছু আঁকা থেকে এই বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। অট্টহাস মন্দিরের সংলগ্ন মা 'রটন্তি' কালীর মন্দির। কথিত আছে, এই রটন্তি কালীর মন্দিরে ডাকাতরা পুজো করে নরবলি দিয়ে, সেই মুণ্ডটি মন্দিরের সামনে ঝুলিয়ে রেখে ডাকাতি করতে বের হতো। এখনও পুরনো প্রথা মেনে এখনও মায়ের পূজোয় 'ছাগবলি' দেওয়া হয়। এখানে আছে 'পঞ্চমুন্ডি'-র আসন। মন্দিরে সারা বছরই ভক্তের আনাগোনা লেগে থাকে, প্রতি অমাবস্যায় প্রচুর লোকসমাগম হয়। এছাড়া দীপান্বিতা কালীপুজোয় এখানে ভক্তের ঢল নামে।

 

এটি শক্তিপীঠ হলেও এখানকার প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো। দোলযাত্রা উৎসবের সূচনা হয় চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই সতীপীঠে মেলে দেবীর আধ্যাত্মিক পরশ। যুগ যুগ ধরে সাধক-রা এখানে এসেছেন এবং পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে দশমহাবিদ্যা তন্ত্রসাধনা করেছেন। জনশ্রুতি আছে, মহামায়ার লীলা প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা, যদিও সাধকরা কখনওই কিছু ব্যক্ত করেননি কারও কাছে। তাই অট্টহাস মন্দির এখনও রহস্যঘেরা। রটনা, ভক্তিভরে পুজো দিলে এবং একমনে মাকে ডাকলে সতীমায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

আরও পড়ুন: দেবীর কণ্ঠনালী থেকে বিষ্ণুর চরণ-চিহ্ন, বাংলার এই সতীপীঠে যেতেই হবে পুন্যার্থীকে

সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামের নিরোলে একটি জঙ্গলের মধ্যে‌ সতীর অধর অর্থাৎ ঠোঁটের নিম্নাংশ পতিত হলো। অট্টহাস মন্দিরে একটি প্রাচীন শিলামূর্তি আছে, যার পাথরের ওপর খোদাই করা আছে সাপের চিহ্ন। অষ্টধাতুর মহিষমর্দিনী মূর্তিটি চুরি যাওয়ার আগে থেকেই এই প্রস্তরমূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই মূর্তিটির পাশে 'দন্তুরা চামুন্ডা'-র একটি ছবি রেখে পুজো করা হয়। এই ছবিটিই হলো অট্টহাসের আদিমূর্তি। মা দন্তুরা চামুণ্ডার মূর্তি। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ'-এর সংগ্রহশালায় সেই মূর্তিটি রেখে আসা হয়। ইতিহাসবিদ তথা লেখক ড‌. কালীচরণ দাস এবং প্রবীর আচার্য এর কারণ অনুসন্ধান করে বলেছিলেন, অট্টহাসে দেবীর মূল মূর্তিটি দেবীর অষ্টচামুন্ডার অন্যতম 'দন্তুরা চামুন্ডা'। এই মূর্তি ভারতে সচরাচর দেখা যায় না। এই মূর্তিটির বয়স প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরেরও বেশি। ১৯১৫-'১৬ সাল নাগাদ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় বর্ধমান জেলার অট্টহাসে এসেছিলেন। তিনি মূর্তিটিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালায় রাখার প্রস্তাব করেন। ঐতিহাসিক কালীচরণ দাস ও প্রবীর আচার্য উদ্যোগী হয়ে এই তথ্যটি সামনে আনেন। নিশুতি রাতে এই মূর্তিটি দেখলে রীতিমতো ভয় লাগে।

দন্তুরা চামুন্ডার মূর্তিটি অদ্ভুত ধরনের দেখতে। কঙ্কালসার চেহারায় ফুটে উঠেছে বুকের পাঁজর। কান দু'টি শরীরের তুলনায় অনেক বড়। বিস্ফারিত গোলাকার দু'টি চোখ, আঁচড়ানো চুল পিঠের ওপর পড়েছে। মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছে কুকুরের মতো দু'টি সুতীক্ষ্ণ দাঁত। চোখে-মুখে হিংস্রতার ছাপ পরিস্ফুট। বাঁহাতটি মাটিতে ভর দিয়ে, ডানহাত হাঁটুতে রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসে আছেন দেবী মা। বেশিক্ষণ এই মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। যেন মনে হয়, মূর্তিটি জীবন্ত। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে আসে। হয়তো এই কারণেই কেতুগ্রামের অট্টহাসে আজও প্রকাশ্যে আনা হয় না দেবীর আসল রূপ। প্রচারের অন্তরালে থেকে গেলেন অট্টহাসের প্রকৃত দেবী মায়ের মূর্তি, 'দন্তুরা চামুন্ডা'।

 

 

More Articles