প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আশ্চর্য 'সোনালি ডিম'! যেসব সামুদ্রিক রহস্যের কুলকিনারা পায়নি বিজ্ঞান

Pacific Ocean Mystery: সমুদ্র আসলে এক আশ্চর্য। বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রের মাত্র ৫ শতাংশ জয় করতে পেরেছে মানুষ। বাকি ৯৫ শতাংশই অজানা, অচেনা। এই যে বিপুল ব্যাপক সমুদ্র, তার কিছুই জানা হয়নি মানুষের। তার অনেক কিছুই আজও অনাবিস্কৃত...

এই পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিসই থাকে, যার সেই অর্থে কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। অন্তত মোটা চোখে তো মেলেই না। আর সেই সমস্ত আশ্চর্যের ব্যাখ্যা খোঁজাটাই কাজ বিজ্ঞানের। বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে সেই অন্বেষণকেই দিশা দেখায় মানুষ। আর এ ভাবেই এগোয় সভ্যতা। এভাবেই মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে ওঠে। একটা আশ্চর্যের সমাধান হতে না হতে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় আরও এক আশ্চর্য, আর আশ্চর্য মানেই রহস্য। ঠিক যেমন করে প্রশান্ত মহাসাগরের বুক থেকে মিলল অদ্ভুত এক সোনার ডিম, যা বিজ্ঞানকে, বিজ্ঞানপ্রয়াসী মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিল নতুন এক জিজ্ঞাসার সামনে। প্রশান্ত সাগরের বুকে ওই সোনালি ডিম আসলে কী? নতুন প্রাণের সন্ধান, ভিনগ্রহীদের ফেলে যাওয়া জিনিস, না কি অন্য কিছু। ওই সোনালি ডিম নিয়ে আপাতত চর্চার শেষ নেই দুনিয়া জুড়ে। তবে 'এমন কত কি ঘটে যাহা তাহা'। বিশ্ব জুড়ে এমন কত কিছুই তো ঘটে, যার ব্যাখ্যা নেই হোরাশিও বা অন্য কারওর কাছে।

সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে এক ধরনের সোনালি ডিমের মতো বস্তু খুঁজে পেয়েছেন ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)-র একদল বিজ্ঞানী। আলাস্কা উপকূল থেকে অভিযান শুরু করেছিল বিজ্ঞানীদের ওই দলটি। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, আলাস্কা উপসাগরের গভীরতা সম্পর্কে খোঁজখবর করা। সামুদ্রিক কোরাল, স্পঞ্জ এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা এবম আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব সম্পর্কে কাজ করা। মোট ১৪ দিনের অভিযানে সমুদ্রের চার মাইল গভীরে পাড়ি দেওয়াই ছিল বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য। গত ৩০ অগস্ট আলাস্কার দক্ষিণ উপকূল থেকে প্রায় ৪০০ কিমি দূরে জলের গভীরে সোনালি রঙের একধরনের বস্তু দেখতে পান বিজ্ঞানীদের দলটি। প্রাথমিক ভাবে যা দেখতে একেবারে ডিমের মতো মন হয়েছিল বিজ্ঞানীদের। অভিযাত্রীরা জানান, মোটামুটি ১০ সেন্টিমিটার লম্বায় বস্তুটি, এবং ডিম্বাকার ওই বস্তুর গায়ে একটি মাত্র ছিদ্র দেখা গিয়েছে। বিজ্ঞানীদের কারওর কারওর মনে হয়েছে, এটি কোনও নতুন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী হতে পারে। যা এতদিন ধরে অনাবিস্কৃত ছিল। কেউ কেউ আবার ভাবছেন, কোনও প্রাণীর ডিমের খোলস। কেউ আবার মনে করছেন, আশ্চর্য এই বস্তু আসলে কোনও মৃত স্পঞ্জ। সব মিলিয়ে সমুদ্রের নীচে রহস্যময় সোনালি ডিম নিয়ে উঠে গিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন।

আরও পড়ুন: সমুদ্রের তলায় গচ্ছিত ১১১ বছরের ভয়ংকর ইতিহাস! অবাক করবে টাইটানিকের সেই বিরল ছবি

নোয়া-র এই গোটা অভিযানটিই সরাসরি প্রচার করা হয়। ফলে ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অন্যান্য বিজ্ঞানী ও অভিজ্ঞরা গোটা ব্যপারটাই অফিসে বসে খুঁটিয়ে দেখেছেন সমুদ্রের নিচের ওই রহস্যময় বস্তুটি কী, তা জানার জন্য ইতিমধ্যেই নানা পরীক্ষানিরিক্ষা করা হয়েছে। জিনিসটিকে ভালো করে বিশ্লেষণ করেও দেখা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের অনেকেরই দাবি, ওই 'সোনালি ডিম' আদৌ সোনালি নয়। অভিযাত্রীদের ডুবোজাহাজের আলো প্রতিফলিত হওয়ার জেরেই ওই বস্তুটিকে সোনালি রঙের বলে মনে হয়েছে খালি চোখে। বেশ কয়েকটি দিক থেকে তোলা বস্তুটির বিভিন্ন ছবি খুঁটিয়ে দেখে বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত, বস্তুর আসলে হলদে-বাদামি রঙের। ইতিমধ্যেই ওই আপাত সোনালি বস্তুটি সংগ্রহ করতে সফল হয়েছে বিজ্ঞানীদের ওই দলটি। পরীক্ষাগারে নিয়ে এসে সেটিকে আরও ভালো করে পরীক্ষা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

মোটামুটি পাঁচ মাসের এক অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পাড়ি দিয়েছে ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওই দলটি। ফলে গবেষণাগারে এনে সেটিকে পরীক্ষানিরিক্ষা করা ও তার ফল জানতে আরও বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে বিজ্ঞানীদের। অতল সমুদ্রে ওই রহস্য়ময় 'সোনালি ডিম' আসলে কী? কোথা থেকেই বা এল সেই আশ্চর্য বস্তু? তার হদিস পেতে, অপেক্ষা করতে হবে আমজনতাকেও। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পরে বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছে, ত্বকের টিস্যুর মতো কোনও পদার্থ দিয়েই তৈরি ওই আশ্চর্য বস্তু। যার জেরে জিনিসটি জীবিত কোনও কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এখনও পর্যন্ত বর্তমানে অস্তিত্ব রয়েছে এমন কোনও প্রাণীর সঙ্গে যোগ পাওয়া যায়নি এর। ফলে হতেই পারে, এই আশ্চর্য 'সোনালি ডিম' আসলে একেবারেই নতুন কোনও প্রজাতির প্রাণী। সেই সম্ভাবনাও একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিজ্ঞানী মহল।

তবে আগেই বলেছি, এই প্রথম নয়। এর আগেও বিশ্বজুড়ে এমন বহু আশ্চর্যজনক জিনিসের খোঁজ মিলেছে সমুদ্রে, বিজ্ঞানের ভাষায় যার ব্যাখ্যা মেলেনি। মারমেইড বা লক নেস দানবের কথা তো অনেকেই শুনেছি। নানা সিনেমাতেও আমরা দেখেছি সমুদ্রমানবীদের গল্প। কিন্তু সেসবের কি আদৌ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। বিজ্ঞান দাম দেয় এক এবং একমাত্র প্রমাণকেই। প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞান কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছয় না। কিন্তু মানুষের মন, তাঁর কল্পনা সে তো সুদূরপ্রসারী। সে ভাবতে, বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যার ব্যাখ্যা নেই। যেমন ধরুন, ইউএফও। এই যে অপরিচিত, অজানা সমস্ত উড়ন্ত জিনিসপত্রের কথা আমরা শুনি, তা কি সত্যিই এই গ্রহের। নাকি তার বাইরেও রয়েছে অন্য কোনও ভিনগ্রহ কিংবা ভিন-ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। বিশ্বাসে মেলায়ে বস্তু...

অতল সমুদ্রের সৌধ

যেমন ধরুন, ১৯৮৬ সালে সমুদ্রের অতলে একটি বায়ুমণ্ডলীয় সৌধ খুঁজে পান জাপানের এক স্থানীয় ডুবুরি। যার নাম 'ওনাগুনি' মনুমেন্ট। বেলেপাথরের তৈরি ওই মনুমেন্টটিতে রয়েছে নিপুণ সিঁড়ি, যা দেখে অনেক গবেষকেরাই মনে করেছিলেন, এই মনুমেন্ট আদতে মানুষের তৈরি। তবে বেলেপাথরের তৈরি স্থাপত্য অমন অতল জলের নিচে কীভাবে থাকতে পারে, তা আজও রহস্য, যার ব্যাখ্যা মেলেনি কোনও নির্মাণতত্ত্বের ভাষাতেই।

সমুদ্রে ইউএফও!

২০১১ সালে বাল্টিক সাগরের অতল থেকে একটি ইউএফও খুঁজে পান ডুবুরিরা। যার সঙ্গে সাযুজ্য ছিল আসলে হলিউডি একটি সিনেমায় দেখানো ইউএফও। কেউ কেউ অবশ্য বলেছিলেন, ওসব ইউএফও বা ভিনগ্রহীদের কিছু মোটেই নয়, সেটা আসলে সমুদ্রের অতলে সমাধি হয়ে যাও শহরের ধ্বংসাবশেষ। কেউ কেউ আবার বলেছেন হিমবাহ থেকে তৈরি হওয়া অংশ সেটি। সব মিলিয়ে আদতে যে কী সেই বস্তু, সেই রহস্যের কিনারা হয়নি আজও।

রহস্যময় 'ব্লুপ'

এখানেই শেষ নয়। বাকি আছে আরও। ১৯৯৭ সালে সমুদ্রের গভীর থেকে আশ্চর্য এক শব্দের হদিস পান নোয়া-র বিজ্ঞানীরা। যাকে তাঁরা 'ব্লুপ' বলে চিহ্নিত করেন। সেই শব্দ ছিল যেমন চড়া, তেমনই ভয়ঙ্কর। কেউ বলেছিলেন, জলের নিচে নৌবাহিনীর সামুদ্রিক অনুশীলনের শব্দ, কেউ বলেছিলেন কোনও সামুদ্রিক প্রাণীর গর্জন। কেউ আবার বলেছিলেন, হিমবাহ ভেঙে যাওয়ার শব্দ। তবে আসলে যে তা কী ছিল, তা আজও রহস্য।

প্রেমের নকশা

২০১১ সালে দক্ষিণ জাপান সাগরে একটি অদ্ভুত স্থাপত্য মিলেছিল জলের তলায়, যা দেখে ভিনগ্রহীদের কাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন অনেকেই। প্রায় ১৬ বছর তা ছিল এক আশ্চর্য। হবে নাই বা কেন, ঝিনুক ও কোরালের অংশ দিয়ে সাজানো ৬ মিটার জায়গা জুড়ে আশ্চর্য এক স্থাপত্য। যা দেখে শিল্পীর কাজ বলেই মনে হবে। পরে জানা যায়, সেটা সামুদ্রিক একটি পাফ ফিশের কাজ। যার সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পাখনার ব্যবহার করে বালি, ঝিনুক এই সব দিয়ে সমুদ্রের ভিতর ওই বিশেষ নকশা তৈরি করে। পাফ ফিশের এমন শিল্পকর্ম সেদিনও আশ্চর্য ছিল, আশ্চর্য আজও।

দৈবফাঁদ নাকি দৈত্যের জঠর

যেমন যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য। মিয়ামি, বারমুডা ও পুয়ের্তো রিকার মধ্যে ৫০০,০০০ বর্গ মাইল এলাকায় কেন বারবার হারিয়ে যায় জাহাজ কিংবা বিমান, কোন দৈত্যের জঠরে ঢুকে যায় সেসব যার আর হদিস মেলে না, তা বছরের পর বছর ধরে রহস্য। পরে অবশ্য জানা গিয়েছে, দৈব বা দানব, কোনও শক্তিই নয়। ওই অংশটির আবহাওয়া বারবার পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের জলস্তরও বারবার ওঠানামা করে। তার জন্যই দিকনির্ণয়ে জটিলতার মুখে পড়েন বিমান বা জাহাজের চালকেরা। দীর্ঘসময় ধরে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কোনও ব্যাখ্যা ছিল না গবেষকদের কাছে।

সমুদ্র আসলে এক আশ্চর্য। বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেন, বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রের মাত্র ৫ শতাংশ জয় করতে পেরেছে মানুষ। ওই অংশটুকই জানা হয়েছে। বাকি ৯৫ শতাংশই অজানা, অচেনা। ফলে সমুদ্রের মানচিত্রও আসলে অসম্পূর্ণ। আর সেই হিসেবে এই যে বিপুল ব্যাপক সমুদ্র, তার কিছুই জানা হয়নি মানুষের। তার সমস্ত প্রাণী, জীবকেও জানা হয়নি তার আজও। এর আগে ৪৭ মিটার লম্বা জেলিফিশের সন্ধান পেয়েছিলেন অস্ট্র্রেলিয়ার গবেষকেরা। মিলছে জিনি ডগফিশ নামে নতুন ধরনের হাঙরের সন্ধান। এমন অনেক কিছুই আসলে অনাবিস্কৃত রয়ে গিয়েছে অতল সমুদ্রের গহিনে।

আরও পড়ুন: পৃথিবীর কেন্দ্র ঘিরে রয়েছে প্রাচীন মহাসমুদ্র! যে আবিষ্কার ঘিরে শোরগোল গোটা বিশ্বজুড়ে

আলাস্কা উপসাগর থেকে পাওয়া এই সোনার ডিমও হয়তো তেমনই কিছু। যা আবিষ্কার হওয়া বাকি! রূপকথার হাঁস পাড়ত সোনার ডিম। যে ডিমের 'অতি লোভে'ই একদিন তাঁতি নষ্ট হয়েছিল গরিব কৃষকেরা। এখন সামুদ্রিক সোনার ডিম কোথায় নিয়ে যায় মার্কিন এই সমুদ্র গবেষণা সংস্থাকে, সেটাই এখন দেখার।

 

 

More Articles