হৃদরোগের চিকিৎসায় দিশা দেখাবে পালং শাকের পাতা! আশ্চর্য আবিষ্কারে তোলপাড় বিশ্ব

ত্রি-মাত্রিক মুদ্রণের মাধ্যমে ২০২১ সালেই ইজ়রায়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষকরা বানিয়েছিলেন রক্ত-জালিকা। এবং সেই রক্ত-জালিকা কেবল বানাননি তাঁরা, তার মধ্য দিয়ে রক্ত-প্রবাহ যে হচ্ছে, তা-ও হাতে-নাতে দেখিয়েছিলেন।

ত্রি-মাত্রিক মুদ্রণ প্রযুক্তি (বা থ্রি-ডি প্রিন্টিং টেকনোলজি) বিগত কয়েক বছরেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। সেই প্রযুক্তিতে মানবদেহের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মুদ্রণ করে, তা আবার প্রতিস্থাপনও করা হচ্ছে রোগীর দেহে। বেশ কিছু বছর আগে এক ব্যক্তি নাকি ত্রি-মাত্রিক মুদ্রণ যন্ত্রে বার্গার বানিয়েছিলেন, এবং তা খেয়েওছিলেন।

ত্রি-মাত্রিক মুদ্রণের মাধ্যমে ২০২১ সালেই ইজ়রায়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষকরা বানিয়েছিলেন রক্ত-জালিকা। এবং সেই রক্ত-জালিকা কেবল বানাননি তাঁরা, তার মধ্য দিয়ে রক্ত-প্রবাহ যে হচ্ছে, তা-ও হাতে-নাতে দেখিয়েছিলেন।

কিন্তু আরও কয়েকবছর আগে যদি পিছিয়ে যাই আমরা- বেশি না, এই পাঁচ বছর মতো- তাহলে দেখতে পাব ত্রি-মাত্রিক মুদ্রণের প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নতি করলেও, এই প্রযুক্তির সাহায্যে রক্ত-জালক নির্মাণ যথেষ্ট কঠিন একটি বিষয় ছিল। বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে থাকা শিরা-ধমনি বানানো ছিল আরওই একটি কঠিন বিষয়। কিন্তু প্রকৃতি তো সব সম্পদই দিয়েছে হাতের কাছে। সেই সম্পদ খুঁজে, প্রয়োজনমতো একটু অদলবদল করে নেওয়ামাত্র।

আরও পড়ুন: ভ্যাকসিনেও আটকাবে না! কোভিডের চোখরাঙানি ফের ফেরাবে অতিমারীর কালো দিন?

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ২০১৭ সালে ওরসেস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন-ম্যাডিসন, এবং আরকানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা পালং-শাকের পাতা থেকেই বানিয়ে ফেললেন হৃদপিন্ডের কলা-কোশ। বানালেন হৃদপিন্ডের মধ্যে দিয়ে বেয়ে চলা রক্তজালিকাও, পালং-শাক থেকেই। গবেষণাটি ওই সালেই এলসিভিয়ার বায়োমেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমেই পালং-শাকের পাতার কোশগুলিকে সরিয়ে ফেলা হয়, যাকে বলে ডিসেলুলারাইজে়শন। কিন্তু পাতার নিজস্ব শির-উপশিরাগুলিকে রেখে দেওয়া হয়। ডি-সেলুলারাইজে়শনের মাধ্যমে কোশ থেকে ক্লোরোফিল, নিউক্লিয়াস, প্রোটিন, ডিএনএ-কে সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু পড়ে থাকে পাতার মূল স্ক্যাফোল্ড বা কাঠামোটি, যার মূল উপাদান হিসেবে পেকটিন এবং লিগনিন পড়ে থাকে ডি-সেলুলারাইজে়শনের পরেও। পেকটিন এবং লিগনিন উদ্ভিদ কোশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদ্ভিদের শিরা-উপশিরা গঠনের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান লিগনিন।

তারপর পাতার এই প্রাথমিক কাঠামো বা স্ক্যাফোল্ডের ওপর ল্যাবরেটরিতে হৃদপিন্ডের কোশগুলিকে গজিয়ে তোলেন গবেষকরা। পাতার কাঠামোর ওপর প্রথমে ফাইব্রোনেকটিনের আবরণ দেওয়া হয়, যাতে কোশগুলি সহজে এসে আটকে যেতে পারে স্ক্যাফোল্ড বরাবর।

হৃদপিন্ডের কোশ নতুন করে গজিয়ে তোলার পর্যায়টিকে বলে রি-সেলুরারাইজেশন বা নতুন করে কোশ গজিয়ে তোলা। এই পর্যায়ে ব্যবহার করা হয় এন্ডোথেলিয়াল কোশ। এই এন্ডোথেলিয়াল কোশগুলি যে কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর শিরা ও ধমনির ভেতরের দিকের (ফাঁপা দিকের) কোশীয় আস্তরণ হিসেবে থাকে।

ঠিক‍ স্তন্যপায়ীর শিরা ও ধমনির ভেতরদিকে যেভাবে সাজানো থাকে এন্ডোথেলিয়াল কোশ, পাতাটির রয়ে যাওয়া শিরা-উপশিরার ভেতরদিকের অংশে, সেই শিরা-উপশিরার কাঠামোকে ভিত্তি করে সারে-সারে গজিয়ে তোলা হলো এন্ডোথেলিয়াল সেল। ঠিক যেমন খড়ের কাঠামোকে ভিত্তি করে, তার ওপর মাটি চাপিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিমা।

অন্যদিকে পাতার বাইরে দিকে কার্ডিওমায়োসাইটসকোশ গজিয়ে তোলা হলো কৃত্রিমভাবে। কার্ডিওমায়োসাইটস কোশ হৃদপিন্ডে সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে, হৃদযন্ত্রকে সচল রাখে। এবং হৃদপিন্ডকে 'পাম্পিং'-এর মাধ্যমে, সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে সাহায্য করে। এই কার্ডিওমায়োসাইট্স কোশ সম্পূর্ণভাবে বেড়ে উঠে, হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক কাজ শুরু করার মতো অবস্থায় পৌঁছতে মোট একুশ দিন সময় নিয়েছিল। এই গবেষণায় কার্ডিওমায়োসাইটস কোশ তৈরি করা হয়েছিল মেসেনকাইমাল স্টেম সেল এবং হিউম্যান প্লিউরিপোটেন্ট স্টেম সেল থেকে।

মেসেনকাইমাল স্টেম সেল বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন ধরণের সেল বা কোশের জন্ম দিতে পারে। মেসেনকাইমাল স্টেম সেল বিভাজিত হলে কেবল হৃদপিন্ডের কোশই নয়, এখান থেকে বিভিন্ন শ্বেত রক্তকণিকা, চোখের কর্নিয়া, ত্বক, পেশি, যকৃতের কোশ, হাড়ের কোশ, কার্টিলেজের কোশ, ফুসফুসের ট্র্যাকিয়ার কোশ, এমনকী, নার্ভ-কোশেরও জন্ম দিতে পারে।

মেসেনকাইমাল স্টেম সেলকে বিভিন্ন কোশ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হলো আম্বিলিক্যাল কর্ড (বা নাভিরজ্জু,গর্ভে থাকাকালীন শিশুকে মায়ের শরীরের সাথে সংযুক্ত রাখে যা), এন্ডোমেট্রিয়ার পলিপস, ঋতুস্রাবের রক্ত, ফ্যাটের কোশ।

অন্যদিকে হিউম্যান প্লিউরিপোটেন্ট সেল নিজে থেকে বিভাজিত হতে পারে (সেলফ-রেপ্লিকেটিং) এবং যে কোনও স্টেম সেলের মতোই বিভিন্ন ধরনের কোশে নিজেকে পরিণত করতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম নার্ভ কোশ, হৃদ-পেশি এবং রক্ত কণিকা। হিউম্যান প্লিউরিপোটেন্ট স্টেম সেল পাওয়া যায় মানবভ্রূণে। আর সেই কারণেই এই স্টেম সেলকে হিউম্যান এম্ব্রায়োনিক স্টেম সেলও বলা হয়।

মেসেনকাইমাল স্টেম সেল এবং হিউম্যান প্লিউরিপোটেন্ট স্টেম সেল থেকে কার্ডিওমায়োসাইটস কোশগুলি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে পাতার স্ক্যাফোল্ডের বাইরের দিকে পুঞ্জীভূত হতে সময় লেগেছিল তিনদিন। পাঁচ দিনের মাথায় কোশগুলি নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে শুরু করে, ঠিক যেমনটা হওয়া দরকার একটি স্বাভাবিক, সচল হৃদপিন্ডে।

দশদিনের মাথায় সংকোচন ও প্রসারণের হার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়।

গবেষকরা সেই সময় আশা করেছিলেন, এই আবিষ্কার পরবর্তীতে হৃদরোগীদের চিকিৎসার কাজে বহুলভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সত্যি-ই দিশা দেখানোর মতো ছিল এই আবিষ্কার।

যদিও উদ্ভিদে উপস্থিত সেলুলোজ় এর আগেও চিকিৎসার কাজে ব্যবহার হয়েছে, তবে গবেষকদের মতে এই আবিষ্কার সাড়া জাগানো। তবে এর আগেও ডি-সেলুলারাইজ়ড আপেলের টুকরোর ওপর স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোশ আটকে, পরবর্তীতে সেই কোশগুলির পুনর্বিভাজন এবং বিস্তার ঘটানো হয়েছিল কৃত্রিমভাবে। 

 

More Articles