দেশের সব মেট্রো স্টেশনকে বলে বলে গোল দেবে শিয়ালদহ মেট্রো, কী কী ব্যবস্থা অন্দরে

২০২২ সালের ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির হাতে উদ্বোধন হলো শিয়ালদহ মেট্রোর। ১৪ জুলাই থেকে মেট্রো পরিষেবা শুরু হবে। ন্যূনতম ভাড়া ধার্য হয়েছে দশ টাকা।

 

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর শুরুটা বাম আমলেই। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন সেসময়। নতুন মেট্রোর কাজ শুরু হবে। আদতে মেট্রোপলিটানকে কেটেছেঁটে মেট্রো। মেট্রো শহরের মধ্যেই ছোটাছুটি করে যে বিশেষ ট্রেন, তাই মেট্রো রেল। ট্রাফিকহীন পথে অতি দ্রুত ছুটে লক্ষ্যে পৌঁছনোর এই ব্যবস্থাকে বলে এমআরটি, মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট। খুব নতুন ব্যাপার না। র‍্যাপিড ট্রানজিটের ইতিহাস প্রায় দেড় শতাব্দী পুরনো। ১৯৬৩-তে লন্ডনে প্রথম চালু হয়, তখন অবশ্য স্টিম ইঞ্জিন। ধীরে ধীরে তিন দশক কাটিয়ে সেই ট্রেন সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত হলো। সেঁধোল সম্পূর্ণ মাটির তলায়। এরপরে গোটা বিশ্বের সমস্ত মেট্রোপলিটন শহরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে র‍্যাপিড ট্রানজিট এসেছে। প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। দিল্লি শহরকে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ জালে ঘিরে ফেলেছে মেট্রো। কত ধরনের রঙ তার। শুধু দিল্লি নয়, ভারতের প্রতিটি মেট্রো শহরেই রয়েছে এই সুবিধা।

দেশের সবথেকে পুরনো মেট্রো কোনটি? কলকাতা মেট্রো। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৯১৯ নাগাদ। বাস্তবায়িত হল '৮৪ সালে। সেই মেট্রোরই পরবর্তী ধাপ হিসেবে দেখা যেতে পারে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোকে। বিশেষত সল্টলেক–রাজারহাট অঞ্চল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পরিণত হয়েছে, তাতে এই সিদ্ধান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয় ২০১৪ সালের মধ্যে গঙ্গার এপার-ওপার যুক্তকারী এই মেট্রো পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে। পরিকল্পনামাফিক পূর্ব প্রান্তের স্টেশন সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, পশ্চিম প্রান্তের স্টেশন হাওড়া ময়দান। শিয়ালদহ স্টেশনের সঙ্গে কলকাতা মেট্রোর যোগাযোগ ঘটানোর জন্যই শিয়ালদহ স্টেশনের পরিকল্পনা।

কিন্তু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অত দ্রুত হয়নি। যদিও শহরে মেট্রো পরিষেবা বেড়েছে। কিন্তু শিয়ালদহ উদ্বোধন হতে আরও আট বছর সময় লেগে গেল প্রায়। জমি-জটও একটা প্রধান কারণ। ২০২০ সালে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা উদ্বোধন করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে তখন ছ'টি স্টেশনে যাত্রী পরিষেবা দেওয়া হচ্ছিল। সেই বছরই ৪ অক্টোবর ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ফুলবাগান স্টেশন পর্যন্ত পরিষেবা চালু হয়। তারপরে দীর্ঘ কাঠখড় পুড়িয়ে ফের ২০২২ সালের ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির হাতে উদ্বোধন হলো শিয়ালদহ মেট্রোর। ১৪ জুলাই থেকে মেট্রো পরিষেবা শুরু হবে। ন্যূনতম ভাড়া ধার্য হয়েছে দশ টাকা। যেহেতু পুবে বা পশ্চিমের সবথেকে কাছের স্টেশন দুই কিলোমিটারেরও বেশি, তাই পাঁচ টাকার টোকেন থাকছে না এই স্টেশনে।

আরও পড়ুন: দেবীর আগমন গজে, গমন নৌকোয় || মহালয়া থেকে ভাইফোঁটা- এ-বছর কবে কী

পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো লাইনে এটি অষ্টম মেট্রো স্টেশন। ফুলবাগান এবং শিয়ালদহ স্টেশনদু'টি নির্মাণে মোট ১২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ভেতরের ঝকঝকে ভাব চোখ টানে। স্টেশনে থাকছে ১২টি সিঁড়ি, ১৬টি এসক‍্যালেটর, ২৯টি টিকিট কাউন্টার। বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য থাকছে বিশেষ লিফট। ট্রেন থেকে নেমেই যাত্রীরা যাতে মেট্রো স্টেশনে চলে আসতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মেট্রো স্টেশন চত্বর থেকেই কাটা যাবে লোকাল ট্রেনের টিকিটও। এছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ মেনে এই স্টেশনে থাকছে শৌচালয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ মনে করছে, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হতে চলেছে শিয়ালদা।

প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার যাত্রী শিয়ালদা মেট্রো স্টেশন চালু হওয়ার সুবিধে পাবে বলেই মনে করছে কর্তৃপক্ষ। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দারা সরাসরি উপকৃত হবেন। খুব সহজেই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, শিয়ালদহ বি আর সিং কলেজে যাতায়াত করতে পারবেন যাত্রীরা। শিয়ালদহ প্রধান ও দক্ষিণ শাখার যাত্রীরা এই স্টেশন থেকে সল্টলেক সেক্টর-৫-এর আইটি হাব, আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনাস, বইমেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছে যেতে পারবেন।

কুড়ি মিনিটের এই দূষণহীন রুটে সল্টলেক ও নিউটাউন এলাকার বাসিন্দারাও উপকৃত হবেন। সল্টলেক থেকে প্রেসিডেন্সি এবং কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছনোও আরও সহজ হয়ে গেল ছাত্রদের জন্য। সেক্টর-৫ থেকে শিয়ালদহ-র দূরত্ব ৯.২ কিমি। কলকাতার বুকে এই রাস্তা অতিক্রম করতে প্রচুর সময় লাগে। মূলত ট্রাফিক জ্যামের জন্য। তার ওপর জায়গায় জায়গায় রাস্তার বহর সরু। মেট্রোতে এই পথ যেতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট।

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর এই অষ্টম স্টেশনটি মাটি থেকে ১৬.৫ মিটার নিচে, অর্থাৎ প্রায় ৫৪ ফুট। মূল স্টেশনে থাকছে তিনটি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু আপাতত একটি লাইন এবং তার দু'পাশের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যাবে। শিয়ালদহ মেট্রোর প্রবেশপথ দু'টি। একটি শিয়ালদহ কোর্টের দিকে, আরেকটি পূর্ব রেলের শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা-লাগোয়া। শিয়ালদহ মেইন এবং উত্তর শাখার যাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকছে। একটি সাবওয়ে করা হচ্ছে। তার নির্মাণকাজ এখনও চলছে। সবথেকে বড় আকর্ষণ, প্ল‍্যাটফর্মে থাকছে স্বচ্ছ কাচের স্ক্রিন ডোর। ট্রেন প্ল‍্যাটফর্মে না ঢোকা পর্যন্ত সেই দরজা খুলবে না।

গোটা স্টেশনে মোট ৫৩টি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, রয়েছে পাঁচটি লিফটও। প্ল‍্যাটফর্মে ঢোকা-বেরনোর জন্য ২৩টি স্বয়ংক্রিয় গেট রয়েছে। যাত্রীদের সুবিধের জন্যে স্বয়ংক্রিয় স্মার্ট কার্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। স্মার্ট কার্ড রিচার্জের জন্য পাঁচটি মেশিন বসানো হয়েছে, এছাড়া বৈদ্যুতিক ডিসপ্লে বোর্ড এবং ট্রেনের সময়জ্ঞাপক বোর্ডও থাকছে। দৃষ্টিহীন যাত্রীদের জন্য প্ল্যাটফর্মে বিশেষ টাইলস্‌ থাকছে। শিয়ালদহ থেকে সেক্টর-৫ পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। সোম থেকে শনি সারাদিনে চলবে মোট একশোটি ট্রেন। সকাল ও সন্ধের ব্যস্ত সময়ে ১৫ মিনিট অন্তর, এবং অন্য সময়ে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন চলবে। সেক্টর-৫ থেকে প্রথম ট্রেন সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে। শিয়ালদহ থেকে প্রথম ট্রেন সকাল ৭টায়। আর রাতের শেষ ট্রেন সেক্টর-৫ থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটে, এবং শিয়ালদহ থেকে রাত সাড়ে ন'টায়।

 

More Articles