ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস! কিছুই কি বদলাবে মণিপুরে?
Independence Day, Manipur: স্বাধীনতা দিবসের ৭৬তম বর্ষেও শান্তি ফেরার আশা নেই মণিপুরে। বরং কখন আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে অশান্তি, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার বিষয় পুলিশ-প্রশাসনের।
দেশ জুড়ে স্বাধীনতার যে অমৃত মহোৎসব শুরু হয়েছিল ৭৫ বছরের বর্ষপূর্তিতে, তার রেশ ছিয়াত্তরে এসেও একই রকম ভাবে ধরে রেখেছে মোদি সরকার। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ফের শুরু হয়ে গিয়েছে 'হর ঘর তিরঙা' পরিকল্পনার প্রচার। ইতিমধ্যেই বহু সরকারি বিভাগ অংশ নিয়েছে সেই 'হর ঘর তিরঙা' পরিকল্পনায়। বিজয়ওয়াড়ায় পোস্ট অফিসের কর্মীরা ১০০ ফুট দীর্ঘ জাতীয় পতাকা নিয়ে নামেন রাস্তায়। স্বাধীনতা দিবসে প্রতি ঘর উড়বে দেশের তিরঙা, কোন রক্ত, ঘাম, অশ্রু, জলের বিনিময়ে ব্রিটিশ শক্তির কঠিন নিগড় থেকে ছাড়া পেয়েছিল দেশ, তা স্মরণে রাখবে দেশবাসী, সে তো ভালো কথা। কিন্তু ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে কি একই রকম ছন্দে রয়েছে গোটা দেশ?
স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সমস্ত প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সাড়া। ১৫ অগস্ট সকাল হতে না হকে রাজপথে নামবে ভিড়। তাতে শামিল হবেন নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হবে দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতার উদযাপনের মধ্যে কেমন আছে মণিপুর। গত সাড়ে তিন মাস ধরে জাতিহিংসায় ছারখার যে ছোট্ট রাজ্যটি। সে-ও তো ভারতের বাইরে নয়।
গত সপ্তাহেও ফের অশান্তির আগুনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। কুকি ও মেইতেই- এই দুই সম্প্রদায়ের 'তুই না মুই'-এর চক্করে ছারখার হয়ে গিয়েছে রাজ্যটি। মারধর, ঘরে আগুন, খুন, রক্তপাতের সঙ্গে সীমা ছাড়িয়েছে মেয়েদের প্রতি অত্যাচার। প্রতিহিংসার ক্য়ানভাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নারীশরীর। যখনতখন বাড়ি থেকে হিঁচড়ে বের করে এনে মেয়েদের গণধর্ষণ করে আধমরা করে ফেলে রাখা হয়েছে যেখানে-সেখানে। রাজ্য সরকার, প্রশাসন নির্বিকার। সম্প্রতি কুকি সম্প্রদায়ের কয়েকজন নারীকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানোর অভিযোগ ওঠে মণিপুরে। সেই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওঠে নিন্দার ঝড়, বসে খাপ। নড়েচড়ে বসে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের হুড়কো খেয়ে তড়িঘড়ি বিবৃতি দিতে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদির আওয়াজ শুনে টনক নড়ে মণিপুরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারেরও। তড়িঘড়ি বিবৃতি দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংও। তার আর পর নেই! ওখানেই শেষ তৎপরতার। অতঃপর যেমন চলার তেমনই চলেছে। আবার রাজ্যে সীমা ছাড়িয়েছে হিংসা। হাসপাতালের মর্গে জমেছে অজ্ঞাতপরিচয় সব মৃতদেহের পাহাড়। যাদের মৃত্যু হয়েছে জাতিহিংসার আগুনে। সেসব লাশ শনাক্ত করার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই মণিপুরে। যে যেমন পেরেছে জিনিসপত্র জড়ো করে প্রাণভয়ে ছেড়েছে দেশ, জড়ো হয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যে। যারা পালাতে পারেননি তাঁরা কোনওক্রমে মাথা গুঁজেছেন অস্থায়ী শিবিরে। এরই মধ্যে গণকবরকে কেন্দ্র করে ফের অশান্তি দানা বাঁধে মণিপুরে। যেখানে ঢুকে পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীও। চলে গুলি।
আফস্পা-র দৌলতে এর আগেও বহু রক্ত দেখেছে মণিপুর। সেই আফস্পা তুলে নেওয়ার জন্য কম আর্জি, কম আবেদন বিগত কয়েক দশক ধরে হয়ে আসেনি মণিপুরে। তবে গত কয়েক বছরে একটু শিথিল হয়েছিল সেই আইন। তবে সেই স্বস্তি ভাঙল জাতিহিংসার আঁচ। বারবার রাজা বদল, রাষ্ট্রপতি শাসন- কোনও কিছুই পরিস্থিতি বদল করতে পারেনি মণিপুরে। অন্ধকার কাটেনি। আর সেই অন্ধকার ছড়িয়ে রইল দেশের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসেও মণিপুরে।
প্রতিবছরই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশের প্রতিটি কোণা মুড়ে ফেলা হয় নিরাপত্তায়। বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এই দিনটিকেই নিশানা করে নাশকতার জন্য। এ বছরও সেই আশঙ্কা ওড়ানো যায়নি। অশান্তিতে জীর্ণ মণিপুরকে নিশানা করে আঘাত হানতে পারে জঙ্গিরা, এমন সম্ভাবনা আঁচ করে মণিপুরের পাঁচ জেলাতে চলে ব্যাপক তল্লাশি। ইতিমধ্যেই উদ্ধার হয়েছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গুলিবারুদ ও বিস্ফোরক। প্রশাসনের কাছে খবর আছে, মণিপুরে স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে অশান্তির ছক রয়েছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের। তাই আগে থেকেই কোমর বেঁধেছে পুলিশ-প্রশাসন।
নিজেদের সরকারি টুইটার হ্যান্ডেলে সে কথা জানিয়েছে মণিপুর পুলিশ। ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, থৌবল, বিষ্ণুপুর, চুরাচাঁদপুর-সহ একাধিক জেলায় এক সপ্তাহ জুড়ে লাগাতার তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের যৌথবাহিনী। দিন কয়েক আগে পর্যন্ত অশান্তি আতুড়ঘর ছিল এই চুরাচাঁদপুর ও বিষ্ণুপুর। সেখান থেকেই এবার উদ্ধার হল বিপুল অস্ত্রশস্ত্র। দিন কয়েক আগেই বিষ্ণুপুরের নারানসেনার দ্বিতীয় আইআরবি থেকে তিনশোটিরও বেশি অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করেছিল বিক্ষোভকারীরা। সাম্প্রতিক তল্লাশিতে উদ্ধার হওয়া এই অস্ত্র লুঠ করা অস্ত্রেরই অংশ কিনা, তা এখনও জানান যায়নি। এদিকে প্রায় প্রতিদিনই স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সমস্ত অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দিচ্ছে মণিপুরের সশস্ত্র জঙ্গীসংগঠন করকম কো-অর্ডিনেশন কমিটি। ওইদিন রাত একটা থেকে বিকেল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘটও ডেকেছে তারা। হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, জলসরবরাহ, দমকল, সংবাদমাধ্যমের মতো জরুরি পরিষেবা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে সমস্ত রাজ্য স্তব্ধ করে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে জঙ্গি সংগঠনটির তরফে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্বাভাবিক ভাবেই একগুচ্ছ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশের। যাতে যোগ দেওয়ার কথা বিভিন্ন স্কুল কলেজের পড়ুয়াদেরও। সেই অনুষ্ঠানে কি বাধ সাধবে বিক্ষোভের আঁচ? প্রশ্নটা ঘুরছেই প্রশাসনের মাথায়।
যদিও গত চার-পাঁচ দিন ধরে আশ্চর্য রকম ভাবে শান্তি পরিস্থিতি বজায় রয়েছে মণিপুরে। আর সেই বিষয়টাই ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। হিংসাদীর্ণ এলাকাগুলিতে শেষমুহূর্তে বড় কিছু ঘটনোর পরিকল্পনা রয়েছে কিনা মণিপুরের জঙ্গিসংগঠনগুলির, সে বিষয়টাও উদ্বেগের বিষয় পুলিশের কাছে। সেই কারণেই বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। তারই মধ্যে চলছে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি।
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান, তার মহড়া সেসব নিয়ে যতটা তৎপর প্রশাসন, মণিপুরে চলতে থাকা হিংসা পরিস্থিতি ঠেকাতে তেমন কোনও পদক্ষেপ, তেমন কোনও তৎপরতাই দেখায়নি প্রশাসন। স্বাভাবিক ভাবেই এ ব্যাপারটি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছেই সাধারণ মানুষের মনে। শুধু মণিপুর নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই উঠে এসেছে প্রতিবাদের স্বর। মণিপুরে মেয়েদের উপরে হয়ে আসা অত্যাচারের বিরুদ্ধে সারারাতব্যাপি প্রতিবাদ কর্মসূচি রয়েছে কোচির একটি নারী সংগঠনের। সংবাদমাধ্যম হয়ে গোটা দেশের কাছে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে মণিপুরের অবস্থা। সেখানে মেয়েদের উপরে যে ভাবে নৃশংস প্রতিহিংসা, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে গোটা দেশের একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। ১৪ অগস্ট সোমবার বিকেল পাঁচটা থেকে ১৫ অগস্ট রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে, যার নেতৃত্ব দেবেন মণিপুরের মেয়ে ইরম শর্মিলা চানু স্বয়ং। সেখানে অংশ নেবেন ১০১ জন নারী। থাকছেন বেশ কয়েকজন কংগ্রেস নেতানেত্রীও। থাকছেন বামনেত্রী কে কে শৈলজাও ছাড়া কেরলের বেশ কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তিত্বও। রাস্তায় প্য়ারেজ দিয়ে শুরু হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মোমবাতি মিছিল দিয়ে শেষ হবে ওই ব়্যালি।
সব মিলিয়ে স্বাধীনতা দিবসের ৭৬তম বর্ষেও শান্তি ফেরার আশা নেই মণিপুরে। বরং কখন আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে অশান্তি, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার বিষয় পুলিশ-প্রশাসনের। এই স্বাধীনতা দিবস, যার হাত ধরেই একদিন গণতান্ত্রিক দেশে মুক্ত শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ভারতবাসী, দেশ পেয়েছিল তাঁর নিজস্ব সংবিধান, সেই সংবিধান বলে গণতান্ত্রিক সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারত। সেই সংবিধান বলে, জাতি, ধর্ম বা এই ধরনের কোনও কিছুর মাধ্যমেই বৈষম্য করা আইনত অপরাধ, সেই দেশ কি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম থাকতে পেরেছে এই ৭৬ বছরে। তা যে পারেনি, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় মণিপুর। সেই জন্যই আজও দলিত, নীচু জাত বলে মানুষ মারে মানুষকে। বাড়ির মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে এনে ক্ষমতার প্রকাশ দেখায়, গণধর্ষণ করে। সেই জন্যেই গোমাংস রাখার অপরাধে পিটিয়ে মারা হয় আখলাখদের। এই ছিয়াত্তর বছরে খাতায়-কলমে দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু স্বাধীনতা আসেনি। এই ১৫ অগস্টেও প্রতি ঘর সেজে উঠবে গেরুয়া-সাদা-সবুজে, রাজ্যে রাজ্যে পালিত হবে আজাদির অমৃত মহোৎসব, বাদ যাবে না মণিপুরও। তার পর, রাত কাটতে না কাটতেই দেশ ডুবে যাবে জাতিগত, ধর্মগত, বর্ণগত বিদ্বেষের পাঁকে, যেমনটা ডুবেছিল এত এত দিন-মাস-বছর ধরে।