ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ

Shailendranath Ghosh: বন্ধুমহলে ‘মামা’ ডাকেই পরিচিত  শৈলেন্দ্রর কলেজ জীবন থেকেই বৈপ্লবিক কাজকর্ম শুরু হয়। এই সময়েই তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘাযতীনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন।

সালটা ১৯১৬। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ গ্রাস করেছে গোটা পৃথিবীকে। ভারতের ইতিহাসেও তখন এক অস্থির সময়। একটু ফিরে তাকালে দেখা যাবে ওই বছরই একদিকে যেমন মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে লখনউ চুক্তি হচ্ছে, অন্যদিকে গড়ে উঠছে হোমরুল আন্দোলন। আবার চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করছে। এই সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞান গবেষক তাঁর গবেষণার কাজে আমেরিকা যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন। এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু, বিধি বাম! বিদেশ যাত্রার কিছুদিন আগেই সরকার বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁর নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করে। গ্রেপ্তারি এড়াতে সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের এই সহগবেষক আত্মগোপন করলেন। গোয়েন্দা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কর্মচারীর ছদ্মবেশে খিদিরপুর ডক থেকে তিনি আমেরিকাগামী একটি জাহাজে চড়ে বসলেন। ১৯১৭-র জানুয়ারিতে তিনি পৌঁছলেন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। এই প্রবাস জীবনেও নতুন উদ্যমে তিনি শুরু করলেন স্বাধীনতা সংগ্রাম। বিংশ শতকের সূচনা লগ্নে আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য বিদেশের মাটিতেও যে সমস্ত বিপ্লবীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি তাঁদের মধ‍্যে অন্যতম। যদিও তাঁর কাজ ও সাহসের তুলনায় জনমানসে তাঁর পরিচিতি খুবই অল্প। বিজ্ঞানের ছাত্র ও সশস্ত্র বিপ্লববাদে বিশ্বাসী এই স্বল্প পরিচিত ব্যক্তির নাম শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ।

১৮৯২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁর জন্ম হয় বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে। অত্যন্ত মেধাবী এই শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁর বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা। কলেজে পড়াকালীন তিনি মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও শিশির কুমার মিত্রের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। মেসে থাকাকালীন বন্ধুমহলে ‘মামা’ ডাকেই পরিচিত  শৈলেন্দ্রর কলেজ জীবন থেকেই বৈপ্লবিক কাজকর্ম শুরু হয়। এই সময়েই তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘাযতীনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। যুগান্তর দলের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। ১৯১৫ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান শাখায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ।

আরও পড়ুন- হিন্দির বিরুদ্ধে, বাংলার পক্ষে রক্তঝরা আন্দোলন! যেভাবে জন্মেছিল পুরুলিয়া জেলা

শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের একটি স্থিরচত্র। ছবি সৌজন্যে- Digital District Repository Detail

ওই বছরই তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের অনুদানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএমসি ক্লাস চালু করার ব্যবস্থা করছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তারকনাথ পালিত প্রফেসর হিসেবে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র এবং রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর হিসেবে প্রফুল্ল চন্দ্র মিত্র আগেই নিযুক্ত হয়েছিলেন। খোঁজ শুরু হলো পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের। ভারতীয় পদার্থবিদ্যার জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র দেবেন্দ্রমোহন বসু (ডিএম বসু) অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন। তবে খুব শীঘ্রই তিনি গবেষণার জন্য জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে জার্মানির রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আর সেই কারণেই তাঁর দেশে ফেরা বেশ কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে গেলে পদার্থবিদ্যার জগতের আরেক নক্ষত্র সি ভি রমনকে নিযুক্ত করার কথা ভাবল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তিনি অন্য এক সরকারি কাজে যুক্ত থাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নিয়োগও সম্ভব হলো না। অবশেষে স্যার আশুতোষ ঝুঁকি নিলেন তথাকথিত নতুনদের নিয়োগ করার। সেই সূত্রে ডাক পড়ল সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা ও তাঁদের বন্ধু ‘মামা’-র। সত্যেন বসু দায়িত্ব পেলেন রিলেটিভিটি পড়ানোর, মেঘনাদ সাহা পেলেন কোয়ান্টাম ফিজিক্সের দায়িত্ব, আর ফিজিক্স ল্যাবরেটরি তৈরির কাজে নিযুক্ত হলেন শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ। কিন্তু, সে দায়িত্ব শৈলেন ঘোষ বেশি দিন পালন করতে পারেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার কারণে ১৯১৬ সালেই তাঁর গবেষণা ও অধ্যাপনার কাজে ছেদ পড়ল। ১৯১৭ সালে তিনি পৌঁছলেন আমেরিকায়। সেখানে তাঁর যোগাযোগ হল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অর্থাৎ এম এন রায়ের সঙ্গে। আর সেখানেই শুরু হলো জীবনে নতুন এক অধ্যায়। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে তাঁর সক্রিয়তা অন্য মাত্রা পেল।

এই পর্যায়ে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বোঝার জন্য তৎকালীন বেশ কিছু রাজনৈতিক ঘটনা এবং তার প্রেক্ষাপট খেয়াল রাখতে হবে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। ভারতবর্ষের বুকে এই সময় ব্রিটিশ বিরোধী মূল শক্তি অর্থাৎ কংগ্রেস ভারতের ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দাবি করে আবেদন-নিবেদন মূলক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালাতে থাকে। কংগ্রেসের এই নরমপন্থী মনোভাবের বিপরীতে একদল স্বাধীনতা সংগ্রামী বেছে নিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। জন্ম নিল বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের। যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির মতো আরও অনেক সশস্ত্র বিপ্লবী দল গড়ে উঠতে থাকল বাংলা, পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে। এ তো গেল আমাদের দেশর কথা। প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও এই ঘটনার প্রভাব অতি দ্রুত গতিতে সঞ্চারিত হল। আমেরিকায় আত্মগোপনকারী বেশ কিছু ভারতীয় বিপ্লবী মিলিত হয়ে লালা হরদয়ালের নেতৃত্বে তৈরি করলেন গদর পার্টি (১৯১৩)। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটিশ বিরোধী শক্তি জার্মানির সহায়তা নিয়ে সেই দেশেই বসবাসকারী একদল ভারতীয় বিপ্লবী তৈরি করলেন বার্লিন কমিটি (১৯১৫), যার পরবর্তী নাম ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটি। এর মাঝেই আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোয় জার্মান কনসুলেট অফিসার আর্থার জিমারম্যানের সহায়তায় সর্বভারতীয় বিপ্লব প্রচেষ্টার জন্য ভারতীয় সেনা ছাউনিগুলিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় একেই ‘হিন্দু-জার্মান কন্সপিরেসি’ নামে ডাকা হয়।

এমতাবস্থায়, ১৯১৭-র এপ্রিল মাসে আমেরিকা ব্রিটেনের পক্ষ নিয়ে সরাসরি বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করল। স্বভাবতই, জার্মানির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল। পাশাপাশি, ব্রিটিশদের চাপে আমেরিকাতেও ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত প্রবাসী ভারতীয়দের ধরপাকড় শুরু হল। আমেরিকায় মাত্র কয়েকমাস কাটিয়েই শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। এবার আশ্রয় নিলেন মেক্সিকোতে। এখানেও সঙ্গী হিসেবে পেলেন বিপ্লবী এম এন রায়কে। তবে ১৯১৭-র নভেম্বর মাসে তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। তারক নাথ দাস, ভগবান সিং, অ্যাগনেস স্মেডলি (প্রকৃত নাম অ্যাগনেস ব্রুনডিন) প্রমুখের সঙ্গে শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষও ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক কাজকর্মে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রথম সারির সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। আমেরিকাতে শৈলেন ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীরা একটি অস্থায়ী ভারত সরকার গড়ে তোলার চেষ্টায় বিভিন্ন কূটনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে থাকেন। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাঁরা ভারতের বন্ধু রাষ্ট্রগুলি বা বলা ভালো ব্রিটিশবিরোধী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতেও তৎপর হন।

এই ১৯১৭ সালেই জার শাসিত রাশিয়ায় ঘটে যায় এক যুগান্তকারী ঘটনা যা নভেম্বর বিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত। রাশিয়ায় জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে বামপন্থী বলশেভিক পার্টি। এই বিপ্লবের দৃষ্টিভঙ্গি সারা পৃথিবী জুড়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি করছিল তার প্রভাব ভারতীয় বিপ্লবীদের মননেও পড়েছিল। শৈলেন্দ্রনাথ যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আমেরিকায় বিপ্লবের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন সেই সময় তাঁর পরিচয় হয় আমেরিকায় থাকা বলশেভিক এজেন্ট ব্লুমা ক্রসের (Bluma Kraus) সঙ্গে। ব্লুমা ক্রসের সহায়তায় তিনি রাশিয়ার মস্কো শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে সম্ভবত মস্কোয় যাবার পথেই নিউইয়র্ক থেকে আমেরিকান পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। এ সময় সারা আমেরিকা জুড়ে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের ওপর পুলিশি নজরদারি ব্যবস্থা কড়া হয়ে ওঠে। একের পর এক বিপ্লবীদের জেলবন্দি করা হয়। পুলিশি দমন-পীড়নের মুখে আমেরিকার মাটিতে বিপ্লবী কার্যকলাপ আপাতভাবে স্তব্ধ হয়ে আসে। ১৯১৯-এ বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে জেলবন্দি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের একে একে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পান শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষও।

আরও পড়ুন- রাজ্যের ঘাড়ে ৬ লক্ষ কোটির ঋণ! বাম আমলের ঋণ কীভাবে তিলে তিলে বাড়ল এ জামানায়

জেল জীবনের যন্ত্রণাও শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের রাজনৈতিক চেতনাকে দমাতে পারেনি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমেরিকাতেই তিনি শুরু করেন তৃতীয় পর্যায়ের বৈপ্লবিক কাজকর্ম। অ্যাগনেস স্মেডলি ও তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় দ্য ফ্রেন্ডস অব ফ্রিডম ফর ইন্ডিয়া (The Friends of Freedom for India)। ১৯২০-র প্রথমার্ধেই তাঁদের এই উদ্যোগ সুসংগঠিত হয়। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকা ও পুস্তিকা প্রকাশ করে স্বাধীন ভারত গঠনের দাবি জানাতে থাকেন। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অর্থ সাহায্যের আবেদন করেন যাতে স্বাধীন ভারত গড়ার লড়াই আরও জোরদার হয়। এর পরের প্রায় দেড় দশকের ইতিহাস অনেকটাই আবছা।

(The Friends of Freedom for India সংগঠন কর্তৃক ১৯১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্যামফ্লেটের ছবি। ছবি সৌজন্য- South Asian Digital Archive)

১৯৩৬-এ শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ ফিরে আসছেন ভারতে। কলকাতা পৌরসংস্থার এডুকেশন অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হলেও অল্পসময়ের মধ্যেই সে চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। শুরু করেন অধ্যাপনার কাজ। কিছু সময়ের জন্য ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতাত্তোর সময়ে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনারের ডেপুটি সেক্রেটারি হন তিনি। তবে, তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কয়েকটি তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে লন্ডনেই মারা যান তিনি। আবার অন্য তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতা শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শৈলেন্দ্র। অধুনা বিস্মৃত এই বিপ্লবী ও বিজ্ঞানীর জীবন তথা কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের আরও অনেক তথ্য জানার এবং রহস্য উন্মোচনের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। প্রয়োজন, জরুরি উদ্যমের।

More Articles