"বিশ্বাস করুন, আমি জিহাদি নই!" হিজাব ছুঁড়ে এখন বাঁচার রাস্তা খুঁজছেন আইসিস জঙ্গির বউ শামিমা
Shamima Begum BBB Podcast ISIS Terrorist wife : বন্দিদের জীবন্ত অবস্থায় মাথা কাটার সেই ভয়াবহ ভিডিও দেখে রাতে ঘুম হয়নি অনেকের। সেই আইসিসেরই সদস্যা ছিলেন এই মেয়েটি!
“হ্যাঁ, আমি চলে গিয়েছিলাম সিরিয়ায়। দুই বান্ধবীর সঙ্গেই চলে গিয়েছিলাম সেখানে। ভেবেছিলাম আর কখনও ইংল্যান্ডে ফিরব না। জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিসে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর সেই জায়গায় নেই আমি। আমি আইসিস গোষ্ঠীর মতো নই। এখন সেখান থেকে সরে এসেছি। কোনওমতে বেঁচে আছি, বাঁচার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, আমি খারাপ মানুষ নই। জঙ্গি নই। আমি এখন বাঁচতে চাই…”
মাইকের সামনে রীতিমতো কাতর আবেদন করছিল মেয়েটি। নাকে নথ, তামাটে চামড়া, মাথায় একরাশ বাদামি খোলা চুল। এক ঝলক দেখলে মনে হবে, চোখমুখ থেকে এখনও শৈশব যায়নি এই মেয়ের। যেন ঠিক পাশের বাড়ির মধ্যবিত্ত বোনটি। কিন্তু অতীত? বারবার সেই ঢেউই ফিরে আসে মেয়েটির মনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ, তারপর জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিসে যোগদান। সেই আইসিস, যাদের হত্যালীলার বর্ণনা শুনে এখনও শিউরে ওঠে মানুষ। বন্দিদের জীবন্ত অবস্থায় ছোট ছুরি দিয়ে মাথা কাটার সেই ভয়াবহ ভিডিও দেখে রাতে ঘুম হয়নি অনেকের। সেই আইসিসেরই সদস্যা ছিলেন এই মেয়েটি! এমন তকমা সারাজীবনের মতো জুড়ে গেল শামিমা বেগমের সঙ্গে।
সম্প্রতি বিবিসি-র একটি সাক্ষাৎকারের জন্য সামনে এসেছিলেন শামিমা বেগম। এখন তিনি ২৩ বছরের তরতাজা যুবতী। বর্তমানে সিরিয়া-ইরাক সীমান্তের একটি শরণার্থী শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন শামিমা। পরিবার নেই, পরিজন নেই; নিজের দেশ বলেও কিচ্ছু নেই। কিন্তু একটা সময় সবটাই ছিল। পূর্ব ইংল্যান্ডে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন শামিমা। বিলেতে থাকলেও জন্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের। কিন্তু ইংল্যান্ডেই চলছিল জীবন। পড়াশোনায় একেবারে খারাপ ছিলেন না শামিমা। মা-বাবার স্বপ্ন, মেয়ে বড় হয়ে অনেক নাম করবে। পূর্ব ইংল্যান্ডের বেথাল গ্রিন অ্যাকাডেমিতে চলছিল পড়াশোনা। বন্ধুবান্ধব, পরিবার, পড়াশোনা – সবই ছিল ঠিকঠাক। শামিমার নামও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু যেভাবে হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেভাবে হল না। বদলে যা হল…
২০১৫ সাল। শামিমা বেগমের বয়স তখন ১৫। নিতান্তই এক কিশোরী। হঠাৎই নিজের দুই বান্ধবী কাদিজা সুলতানা এবং আমিরা আবাসের সঙ্গে তিনি চলে গেলেন লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে। শামিমা নিজের ব্যাগে ভর্তি করে নিয়েছিলেন পছন্দের চকোলেট। কে জানে, আর খেতে পারবেন কিনা! সেখান থেকে বিমানে করে তিনজনেই সোজা উড়ে যান তুরস্কে। তারপর চুপিসাড়ে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন সিরিয়ায়। এটা সেই সময়ের কথা, যখন গোটা বিশ্ব আইসিস জঙ্গিদের কার্যকলাপ দেখছে। শামিমা সহ তিন কিশোরী সোজা গিয়ে যোগ দিলেন সেই আইসিসেই!
বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনই সব কথা বলেছেন ‘জিহাদি বউ’ শামিমা বেগম। আইসিসে যোগ দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ে দেওয়া হয় এক ডাচ আইসিস জঙ্গির সঙ্গে। ধর্মান্তরিত হয়ে জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগদান করেছিল সে। শামিমার পরনে উঠে আসে হিজাব, বোরখা। বিয়ের পরপরই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন শামিমা। একবার নয়, তিনবার সন্তানের জন্ম দেন তিনি। হ্যাঁ, কিশোরী বয়সেই মা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সন্তানরা কেউই আর বেঁচে নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি, অপুষ্টি ইত্যাদি কারণে তিন সন্তানই মারা যায়। ২০১৯-এ আইসিসের পতনের পর শামিমা চলে আসেন সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে। তারপরই তাঁর গল্প গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
কেন আইসিসে গিয়েছিলেন শামিমা? এই প্রশ্নের আজও কোনও উত্তর নেই। আজও এই বিষয়ে চুপ তিনি। তবে শামিমা বারবার বলেছেন, নিজের ইচ্ছায় আইসিসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সাহায্য করেছিল ওই দুই বান্ধবীও। তারা অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই। পাশাপাশি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরাও সাহায্য করেছিল। তাহলে কি ইংল্যান্ডে থাকতেই আইসিস জঙ্গিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন শামিমা? বিমানের টিকিট, টাকা কোথায় পেলেন? তিনি তো তখন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরী ছিলেন! উত্তর আজও নেই…
তবে এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে ফিরতে চাইছেন শামিমা। ২৩ বছরের তরুণীর বক্তব্য, “আমি এখন নিজেকে ঘৃণা করি। গোটা বিশ্ব আমার ওপর রেগে আছে। রেগে থাকার কারণ আছেও। কিন্তু আমি এখন অন্য মানুষ। যারা ওইভাবে মানুষ মারতে পারে, তাদের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। তাই ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। এখন সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে চাই। আইসিসের ঘৃণ্য কাজগুলো নিয়ে আরও জানাতে চাই।”
কিন্তু সত্যিই কি উপায় আছে? আইসিসে যোগদানের প্রসঙ্গ শুনে ব্রিটিশ প্রশাসন শামিমার নাগরিকত্ব খারিজ করে দিয়েছে। এখন বারংবার আবেদন করলেও তারা ফেরাতে চাইছে না। আইনি লড়াই চলছে। শামিমার মায়ের দেশ বাংলাদেশও তাঁকে নিতে চায় না। দুটি ক্ষেত্রে কারণ একটাই – আইসিস। শামিমা সত্যিই ফিরতে চাইছেন, নাকি এর পেছনে জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনও পরিকল্পনা আছে? তাঁর জঙ্গি স্বামী কি এখনও বেঁচে? যোগাযোগ আছে কোনও? এখনও এনিয়ে অন্ধকারে ব্রিটিশ প্রশাসন। শামিমা কেন আইসিসে যোগ দিয়েছিলেন, তারও কোনও উত্তর মেলেনি।
কিন্তু শামিমা এখনও স্বপ্ন দেখছেন। হাল ছাড়েননি তিনি। হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। জিন্স, জামা পরেই স্বচ্ছন্দ তিনি। বারবার একটাই উক্রি, বিশ্বাস করুন আমায়। সত্যি কথা বলছি। আমি আর জিহাদি বউ নই। আমি জঙ্গি নই। কিন্তু দোলাচল? সেটা তো কেউ থামাতে পারছে না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভিত্তি তো তৈরি করে দিয়েছে ওই নামটাই – আইসিস জঙ্গির বউ!