মথুরা থেকে দিল্লি, আগের জন্মের কথা হুবহু বলতে পারতেন এই জাতিস্মর

এই বিশ্বে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা বহুবার বিজ্ঞানকেই প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তেমনই একটি বিষয় হল মানুষের ‘পুনর্জন্ম’। মৃত্যুর পরেও কি মানুষের কোন অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থেকে যায়? ‘আত্মা অবিনশ্বর’- এই কথাটিই কি তাহলে সঠিক? এইসব প্রশ্নের উত্তর যুগ যুগ ধরে মানুষকে ভাবিয়েছে আর মানুষ যত এই বিষয় নিয়ে ভেবেছে, ততই এই প্রশ্ন আরও বেশি করে গুরুত্ব অর্জন করেছে। পুনর্জন্ম প্রসঙ্গে, ‘আটলান্টার ইয়ার্কস ন্যাশনাল প্রাইমেট রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠানের গবেষক ডায়াস এবং কেরি রেসলার বলেছিলেন, আদতে এসব কিছুর অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ভিতরে থাকা স্মৃতিগুলো বংশগতভাবে অন্য মানুষে প্রবাহিত হয়ে থাকে। সেভাবেই একজন মানুষ জন্ম থেকেই অন্য কারোর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে মনে করতে পারে। যাকে বলা হয়ে থাকে গতজন্মের স্মৃতি।   

  ১৯০২ সালের ১৮ জানুয়ারি, দিল্লী থেকে ২৯ কিমি দূরে মথুরায় লুগদি দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে লুগদি দেবীর বিবাহ হয় তাঁর এলাকার এক ব্যাপারী কেদারনাথ চৌবের সঙ্গে। তাঁর মথুরায় একটি কাপরের দোকান ছিল। ছোটবেলা থেকেই লুগদি দেবী ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং খুব অল্প বয়সেই তাঁর বেশকিছু তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণ করা হয়ে গিয়েছিল। সিজারের মাধ্যমে লুগদি দেবীর প্রথম সন্তান জন্মলাভ করে কিন্তু এই জটিল অস্ত্রপাচারও সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে অক্ষম হয়েছিল। পূর্বের তিক্ত এবং করুণ অভিজ্ঞতা কেদারনাথের মনে এক গভীর দাগ কেটেছিল বলেই তিনি  দ্বিতীয়বার প্রসবকালীন সময়ে স্ত্রী লুগদিকে নিয়ে সরাসরি আগ্রার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। এইবার সদ্যজাত পুত্রসন্তান প্রাণে বাঁচলেও, জন্মদানের নয়দিন পরে ১৯২৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর লুগদি দেবী ইহলোক ত্যাগ করেন।  

 লুগদি দেবীর মৃত্যুর ১ বছর ১০ দিন পরে,  ১৯২৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর দিল্লির চিরাওয়ালা নামক একটি ছোট্ট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন শান্তি দেবী। ছোট থেকেই ধীর-স্থির স্বভাবের শান্তি খুব বেশি কথা বলতেন না। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই তিনি স্নেহে-আদরে দিন গুজরান করতেন। তাঁর জীবনের পরিবর্তন ঘটে চার বছর বয়স থেকে, যখন তিনি পুরোদমে কথা বলতে শুরু করেন। মাত্র চার বছর বয়সে যখন শান্তি দেবীর মুখে বুলি ফোটে, তখন থেকেই তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্বামী এবং পুত্রসন্তানের কথা বলতে থাকেন এবং আরও বলেন যে, দিল্লির এই বাড়ি তাঁর নিজের বাড়ি নয়, তিনি আসলে মথুরার বাসিন্দা। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর মথুরায় কাপড়ের দোকান রয়েছে এবং তিনি নিজেকে ‘চৌবানি’ (চৌবের স্ত্রী) বলেও দাবি করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই ছোট্ট বাচ্চার এ এক খামখেয়ালিপনা ভেবে, তাঁর কথায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু শান্তি দেবী বেশ কয়েকবার একই কথা এবং তাঁর স্বামীর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করলে অবশেষে পরিবারের লোকেরা এই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। আট-নয় বছর অবধি শান্তি দেবী কখন তাঁর স্বামীর নাম উল্লেখ করেননি, পরিবর্তে তিনি স্বামীর চেহারার উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর স্বামী গৌরবর্ণ, তাঁর বাম গালে একটি আচিল আছে, তিনি চশমা ব্যবহার করেন এবং দ্বারকাধীশ মন্দিরের সামনেই তাঁর স্বামীর দোকান।

এছাড়াও শান্তি দেবী তাঁদের পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে তাঁর সিজারের বিস্তৃত বিবরণ দেন যা শুনে চিকিৎসকও অবাক হয়ে যান। ক্রমেই রহস্য এক জটিল আকার নেয়। এর মধ্যেই তিনি অনেকবার তাঁকে মথুরায় নিয়ে যাবার কথা বলেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তাঁর স্বামীকে দেখামাত্রই চিনে নেবেন। অবশেষে, দিল্লির রামজাস হাইস্কুল’র শিক্ষক বাবু বিশানচাঁদ শান্তি দেবীর স্বামীর নাম জানতে সক্ষম হন এবং তাঁকে কথা দেন, মথুরায় যদি সত্যি এমন কোন ব্যাক্তি থেকে থাকেন তবে তিনি শান্তি দে্বীকে অবশ্যই মথুরায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন। এরপরে তিনি কেদারনাথ চৌবেকে শান্তি দেবীর সমস্ত বিবৃতির বিবরণ দিয়ে একটি চিঠি লেখেন এবং কেদারনাথ চৌবেও চিঠির উত্তরে সমানভাবে সাড়া দেন এবং ১৯৩৫ সালে কেদারনাথ দিল্লী আসেন তাঁর তৎকালীন সহধর্মিনী, পুত্র এবং এক খুড়তুতো দাদাকে সঙ্গে নিয়ে।

শান্তি দেবীকে যাচাই করার জন্য কেদারনাথ, নিজের খুড়তুতো দাদাকে তিনি নিজের নামে পরিচয় দেন। কিন্তু শান্তি দেবী সেই মূহুর্তেই নিজের স্বামীকে চিনতে সক্ষম হন। এরপর অতিথিদের জন্য খাবার প্রস্তুত করার সময় এলে তিনি তাঁর স্বামীর পছন্দের খাবারের নামও নির্ভুল বলেন। শান্তি তাঁর আগের জন্মের পুত্র নবনীতকে দেখে কান্নায় ভেঙে পরে এবং নিজের সমস্ত খেলনাও দান করে দেয়। রাতের খাবারের পর তিনি স্বামী কেদারনাথকে পুনরায় বিবাহ করার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। কারণ কেদারনাথ তাঁর কাছে কোন একসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি আর কোন বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হবেন না। শান্তি দেবীর সঙ্গে কেদারনাথ একান্তে খানিকক্ষণ কথা বলার পর নিজেই স্বীকার করেছিলেন, শান্তি দেবীই আসলে তাঁর মৃত স্ত্রী লুগদি দেবী।   

 ইতিমধ্যেই এই খবর সারা দেশে আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং ক্রমেই এর সীমারেখা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটি স্পর্শ করে। স্বয়ং গান্ধীজি এই ঘটনার কথা জানার পরে শান্তি দেবীর সঙ্গে দেখা করেন এবং এই ঘটনার সঠিক মূল্যায়নের কারণে ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।  ১৯৩৫ সালের ২৪শে নভেম্বর এই কমিটির সঙ্গে শান্তি দেবী রেলপথে পাড়ি দেন মথুরায়। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী,

  1. “as the train approached Mathura, she became flushed with joy and remarked that by the time they reached Mathura the doors of the temple of Dwarkadhish would be closed. Her exact language was, ‘Mandir ke pat band ho jayenge’, so typically used in Mathura”  
  2. “ the first incident which attracted our attention on reaching Mathura happened on the platform itself. The girl was in L.Deshbandhu’s arms. He had hardly gone 15 paces when an older man, wearing a typical Mathura dress,whom she had never met before, came in front her, mixed in small crowd, and paused for a while. She was asked whether she could recognize him. His presence reacted so quickly to her that she at once came down from Mr. Gupta’s lap and touched the stranger’s feet with deep veneration and stood aside.on inquiring, she whispered in L. Deshbandhu’s ear that the person was her ‘jeth’( older brother of her husband). All this was so spontaneous and natural that it felt everybody stunned with surprise. The man was Babu Ram Chaubey, who was really the elder brother of Kedernath.”

 

এরপর শান্তি দেবী নিজের শ্বশুরবাড়ির পথের নির্দেশ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন এবং পথের চারিধারে কী কী পরিবর্তন হয়েছিল তাও সঠিকভাবেই বলেন। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে তিনি নিজের বাবা-মা’কে চিনতে সক্ষম হন এবং পুরনো আত্মীয়দের দেখে কান্নায় ভেঙে পরেন। শান্তি দেবী এরপরে মথুরার নানানস্থানে যান এবং সব জায়গার সঠিক বিবরণও দিয়েছিলেন। শান্তি দেবীর এই ঘটনা ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের বাইরেও বহুল চর্চিত হয়ে থাকে, অসংখ্য গবেষক এই বিষয়ে কাজ করেছিলেন। অনেকে বিষটিকে সম্পুর্ণ ভ্রান্ত বলেও দাবি করেছিলেন।  তিনি পরবর্তীতে কখনও বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হননি, তিনি দিল্লিতে শান্ত, আধ্যাত্মিক এক জীবনযাপন করতেন। অবশেষে ১৯৮৭ সালে মাত্র ৬১ বছর বয়সে তিনি মারা যান, এভাবেই তাঁর দ্বিতীয় জন্মেরও সমাপ্তি ঘটে।

More Articles