প্রমাণিত নয় একটিও অভিযোগ, কেন চার বছরেরও বেশি জেলবন্দি শার্জিল?
Sharjeel Imam Spent Four Years in Jail: কত গবেষণা করতে পারত শার্জিল। এখনও পিএইচডি শেষ হয়নি। অথচ এতটুকু ভাঙ্গেনি সে। হাসে আর মাকে বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, মা।'
২৮ জানুয়ারি, ২০২৪। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি স্নাতক, গবেষক শার্জিল ইমামের কারাদণ্ডের চার বছর পূর্ণ হল। ভারত জুড়ে 'সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট' ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সময় প্রকাশ্যে কিছু বক্তব্য রাখেন শার্জিল। সেই বক্তব্যের জেরে আসাম, অরুণাচল, মণিপুর, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ─পাঁচটি রাজ্যের পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করেন। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। মামলা হয় ইউএপিএ ধারাতেও। অভিযোগ আনা হয়, দিল্লির সাম্প্রদায়িক হানাহানির নেপথ্যে ভূমিকা ছিল শার্জিলের। অথচ চার বছর কেটে গেল, একটি অভিযোগও প্রমাণ করা গেল না। মোট আটটি মামলা রুজু হয়েছিল শার্জিলের বিরুদ্ধে। পাঁচটিতে জামিন পেয়েছেন শার্জিল। একটি মামলায় তাঁকে গ্রেফতারই করা হয়নি। কেবলমাত্র ইউএপিএ ধারায়, 'ভবিষ্যতে'র সদাসতর্ক প্রহরীরা এখনও তাঁকে আটকে রেখেছে। রামরাজ্যের এমনই মহিমা!
চার বছরে দিল্লির বিভিন্ন আদালতে অসংখ্য বার জামিনের আবেদন করেছেন শার্জিল। অভিযোগ, সে'সব আবেদন এখনও খতিয়ে দেখাই হয়নি। ইউএপিএ ধারায় সেকশন ১৩ অনুযায়ী কারাদণ্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৭ বছর। তার অর্ধেকেরও বেশি সময় বিনা দোষে জেল খেটেছেন শার্জিল। এই মর্মে ২০২৩ সালে একটি আবেদনে অবিলম্বে জামিনের দাবিও করেন তিনি। অভিযোগ, আদালত ভ্রূক্ষেপ করেনি। 'দ্য ওয়্যার'কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর ছোট ভাই মুজাম্মিল বলেন, “জীবনের চার চারটে বছর নষ্ট হল। এই সময়টা বাইরে থাকলে আরও কত পড়াশোনা করতে পারত, কত গবেষণা করতে পারত শার্জিল। এখনও পিএইচডি শেষ হয়নি। অথচ এতটুকু ভাঙ্গেনি সে। হাসে আর মাকে বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, মা।' যে কোনও রাজনৈতিক বন্দির পরিবারে স্থিরতা বলে কিছু থাকে না। ভারসাম্য হারিয়ে আমার মা এবং আমার জীবন যেন থমকে গিয়েছে।”
চার বছরে দিল্লি উচ্চ আদালতে জমা পড়েছে শার্জিলের ৪৬টি জামিনের আবেদন। ফেব্রুয়ারিতে আবার নতুন করে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হানাহানি ষড়যন্ত্র মামলায় জামিনের আবেদনের শুনানি হতে চলেছে। ফেব্রুয়ারিতেই দিল্লির আরেক আদালতে বক্তব্যের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রথম মামলার শুনানিও শুরু হবে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অপেক্ষায় কাটাচ্ছেন ইমামের পরিবার পরিজনেরা। রামরাজ্যে সুবিচার পাবেন তাঁরা?
আরও পড়ুন: বিচারের আগেই মিডিয়া যে ভাবে ‘অপরাধী’ বানিয়েছে উমর খলিদকে
ইমামের উকিল আহমেদ ইব্রাহিম জানান, ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি গ্রেফতার হন শার্জিল। তার কয়েক দিন আগেই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএএ-এনআরসি বিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন শার্জিল। বলেছিলেন, এই জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটাই উপায়। আসাম নিজেকে ভারতের যাবতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার থেকে বিছিন্ন করুক। ১৬ জানুয়ারির এই বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয় ২৫ জানুয়ারি। আর ২৬ জানুয়ারির মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি রাজ্যের পুলিশ এফআইআর দাখিল করে। তার দু'দিনের মাথায় গ্রেফতার হন শার্জিল। দিল্লি এফআইআরের ভিত্তিতে তিনি নিজেই আইনি-পরামর্শদাতার সঙ্গে দিল্লি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কয়েকমাস পরে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে উমর খলিদের সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয় শার্জিলকেও। ২০১৯ সালে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সংঘটিত দু'টি হিংসাত্মক ঘটনার মামলাতেও অভিযুক্ত হন শার্জিল। অথচ আজ পর্যন্ত একটি অভিযোগও সত্য প্রমাণ হল না। পাঁচটিতে জামিন, একটির ভিত্তিতে গ্রেফতার করাই হয়নি। রামরাজ্যে শাসকের অস্ত্র কেবল ইউএপিএ!
ইব্রাহিম আরও জানান, সেকশন ৪৩৬এ-এর অধীন জামিনের আবেদনটি চার মাসের উপর অমীমাংসিত। নানা কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে ফয়সালা। বিচারপতি অমিতাভ রাউতের বদলি হয়ে গিয়েছে। তিনি শেষ শুনানিতে জানিয়ে ছিলেন, নতুন বিচারপতি এসে আবার গোড়া থেকে সবটা শুনবেন। সাত বছর সর্বোচ্চ মেয়াদের অর্ধেকেরও বেশি জেলে কাটাচ্ছেন শার্জিল। অথচ বিধিবদ্ধ জামিনটুকুও জুটছে না তাঁর। "এখন নতুন বিচারপতির সামনে আবার শুরু থেকে সমস্ত মামলাটির শুনানি হবে। তারপরে রায় দেবেন তিনি।"─বলেন ইব্রাহিম। দিল্লির আইনজীবী সরিম নাভেদের বক্তব্য, "দুই বছরের উপর জামিন আবেদনের ফয়সালা হচ্ছে না─এ আইনব্যবস্থার কলঙ্ক। যদি মনে করেন, এই ব্যাক্তি জামিনের যোগ্য নন, আবেদন খারিজ করে দিন! কিন্তু দু'বছরের উপর ঝুলিয়ে রাখবেন না!”
উমর খলিদের মতো সামাজিক সমর্থন পাননি শার্জিল। তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেননি কোনও আন্দোলনকর্মীরাও। কোনও প্রচারমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমের চর্চায় নেই তিনি। ক্ষণিক উত্তেজনার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এখন ট্রেন্ড। শাসকই ঠিক করেন কে হবে তাঁর বিরোধিতার প্রধান মুখ। অথচ এই রামরাজ্যেরই এক অন্ধকার জেলের কোণে নিজেকে আইনি-বিদ্যায় পারদর্শী করে চলেছেন শার্জিল ইমাম। যে'সব মানুষ চট করে আইনি সুবিধা পান না, বিচার পান না, তাঁদের লড়াই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। নিজের লড়াইও নিজেই লড়তে চান শার্জিল। ইব্রাহিম বলছেন, ‘হর উরুজ কা জওয়াল দেখনা হোতা হ্যায়"। সমস্ত উত্থানের পতন থাকেই। বিনা বিচারে আরও কতদিন তাঁকে শাস্তি দিতে চায় শাসক─শার্জিলও দেখতে চান।