শাহজাহানকে হারিয়ে জিতে গেল তৃণমূল? লোকসভায় আসন বাড়বে শাসকের?
Sheikh Shahjahan Arrest : তৃণমূলের ক্ষমতা ব্যবহার করেই কিন্তু সন্দেশখালিতে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল শাহজাহান। বিষয়টি তৃণমূলের উচ্চস্তরের কেউ জানতেন না এ হতেই পারে না।
শেখ শাহজাহানকে কি আশ্রয় দিচ্ছে তৃণমূল? টানা প্রায় দু'মাস ধরে উত্তাল সন্দেশখালি আর শাহজাহানকে ধরতে পুলিশের কোনও তাড়া না দেখে প্রশ্ন উঠেছিল স্বাভাবিকভাবেই। ৫৫ দিন পর, টানা ক'দিন ধরে নানাভাবে ইঙ্গিত দেওয়ার পর অবশেষে শাহজাহান গ্রেফতার হয়েছে। বিজেপি বলছে, বিজেপির আন্দোলনের চাপে, চরম বিরোধিতা ও পুলিশ প্রশাসনের উপর ক্রমে চাপ বাড়ানোর ফলেই শাহজাহান লকআপে। কিন্তু কে না জানে, শাহজাহানকে গ্রেফতার করার ঘটনায় লাভের গুড় ঘরে তুলবে এক এবং একমাত্র তৃণমূলই। রাজ্যজুড়ে সন্দেশখালি সরগরম পর্ব যেভাবে চলেছে মাসখানেক ধরে তার কোনও প্রভাবই কি লোকসভা ভোটে পড়বে না?
সন্দেশখালি থেকে দূরে বসে যারা এই ঘটনা দেখছেন, রোজ সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিভিশনে সন্দেশখালিতে শাহজাহান গোষ্ঠীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহিলাদের জোট বাঁধা দেখছেন তাঁদের কাছে এই ঘটনার অভিঘাত অন্যরকম। সন্দেশখালি থেকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ যা যা সামনে এসেছে, শাসকদলের ক্ষমতা পেয়ে একজন সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা স্থানীয় নেতা এলাকায় দখল বজায় রাখতে কী কী করতে পারেন তার খতিয়ান মানুষের মনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্ম দিয়েইছে। ভোটের বোতামে চাপ দিতে গিয়ে সন্দেশখালি মনে পড়বেই।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মহিলাদের মাঠে নেমে লড়াই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বেশি ভোটার মহিলারাই। মহিলাদের কল্যাণে একের পর এক প্রকল্প এনেছেন মমতা। এমনকী ভোটের বাজারে মহিলাদের ভোট ধরে রাখা নিশ্চিত করতে রাজ্য বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে মাসিক ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করার ঘোষণাও করেছেন নেত্রী। অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে মহিলাদের উপর তারই দলের স্থানীয় নেতার লোকজন অত্যাচার চালাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেস জানেও না তা কীভাবে হয়? কেনই বা কোনও ব্যবস্থা নিতে এত অনীহা দেখিয়েছে তৃণমূল? মুখ্যমন্ত্রীই যেখানে পুলিশমন্ত্রী, সেখানে কেন পুলিশকে তেমন কড়া নির্দেশও দেওয়া হলো না শাহজাহানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে?
আরও পড়ুন- লকআপে সন্দেশখালির ত্রাস! কীভাবে গ্রেফতার হলো শেখ শাহজাহান?
কিন্তু মোক্ষম অস্ত্রটি নিক্ষেপ করে ফেলেছে তৃণমূল। শাহজাহানকে বৃহস্পতিবার রাজ্য পুলিশ মিনাখাঁ থেকে গ্রেফতার করেছে। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে শাহজাহানকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। গত সোমবার কলকাতা হাইকোর্ট জানায়, শাহজাহানকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না এমন কোনও স্থগিতাদেশ দেওয়াই হয়নি। রাজ্য পুলিশকে কোনও বাধা দেওয়া হয়নি। ইডির মামলায় সিট গঠনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি জানান, সিবিআই, ইডি এবং রাজ্য পুলিশ যে কেউই শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারে। তারপরেই তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন, সাত দিনের মধ্যে গ্রেফতার হবেন শাহজাহান। এই ঘোষণার ঠিক চার দিনের মাথায় লকআপে শেখ শাহজাহান, সন্দেশখালির 'বেতাজ বাদশা', সন্দেশখালির 'ত্রাস'।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, গ্রেফতার হলেও সন্দেশখালির ঘটনা লোকসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবেই এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই কাজ করবে এই জনরোষ। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে ইতিমধ্যেই। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মতো মন্ত্রীরা ছাড়াও একাধিক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। সেই ঘটনাগুলি ক্ষোভ জমিয়ে রেখেইছিল মানুষের মনে। কিন্তু সন্দেশখালির মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সন্দেশখালির জেরে আসন কমবে তৃণমূলের, মনে করছেন অনেকেই।
আরও পড়ুন- শাহজাহান কোথায়? ‘ওঁরাই’ সবটা জানেন!
শাসকদল তৃণমূলও এই বিষয়টি আঁচ করেই বিরোধীদের জবাব দিতে বেশি তৎপরতা দেখাল কি? তৃণমূল বুঝেছিল বিরোধী, বিশেষ করে বিজেপি সন্দেশখালির ঘটনাকে ভোটে বড় ইস্যু হিসাবে তুলে ধরার পথে এগোচ্ছে। রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সন্দেশখালি বড় ঘটনা হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। উত্তর ২৪ পরগণার দুই মন্ত্রী সুজিত বসু ও পার্থ ভৌমিক তাই সন্দেশখালি গিয়েছেন বারেবারে। মমমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য একবারও যাননি। যে জায়গা দিয়ে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে দিত শাহজাহানরা বলে গ্রামের মানুষরা অভিযোগ করেছিলেন, সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক সেই নদীমুখ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ড্যামেজ কন্ট্রোলে কোনও গাফিলতি করতে চায়নি তৃণমূল।
এই ড্যামেজ কন্ট্রোলের ফল কি মিলবে লোকসভা ভোটে? শাহজাহানকে গ্রেফতার করে তৃণমূল প্রমাণ করতে চেয়েছে যেখানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে রেয়াত করা হয়নি সেখানে শাহজাহানদের মতো স্থানীয় নেতার মাথা থেকে হাত তুলে নিতে সময় নেয় না তৃণমূল। কিন্তু মানুষ এও দেখেছে, তৃণমূলের ক্ষমতা ব্যবহার করেই কিন্তু সন্দেশখালিতে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল শাহজাহান। বিষয়টি তৃণমূলের উচ্চস্তরের কেউ জানতেন না এ হতেই পারে না। বেগতিক হতে, লাগাম কমতে থাকাতেই শাহজাহানের বলি হলো। না হলে এমনটাই চলত। শাসকদল আশ্রিত এমন লক্ষ লক্ষ শাহজাহান রয়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তে। তাই মহিলা ভোট ধরা হোক, সংখ্যালঘু ভোট ধরা হোক, সন্দেশখালির কাঁটা তৃণমূল উগরে ফেলতে পারবে না। কতগুলি আসন হারাবে তৃণমূল? না কি আবারও 'সততার প্রতীক' ইমেজটিকে সামনে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হয়ে উঠবেন বাংলার 'মুখ', এটাই দেখার এখন।