যা বিশাল, বাঙালির কাছে তাই 'পেল্লায়'! এই শব্দের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে তামিল ভাষা
Bengali Vocabulary: তামিল 'পেরিয়া' বাংলায় পেল্লিয়া তথা পেল্লায় বা পেল্লাই হয়ে গেছে?
এবারের শব্দ 'পেল্লায়'। উচ্চারণভেদে পেল্লাইও বলা হয়। অর্থ, বিরাট, বিশাল। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ পেল্লায় শব্দটিই নেই। সংস্কৃত ভাষা থেকে না এলে হরিচরণবাবু যেন অবজ্ঞার সঙ্গে অনেক শব্দকে খরচের খাতায় ফেলে দেন। এটা তাঁর পক্ষে অবশ্য স্বাভাবিক সেই যুগের সাপেক্ষে। শান্তিনিকেতনের বিশুদ্ধবাদী ভাবধারা তাঁর মধ্যে গেড়ে বসেছিল তখন। পতিসরের কাছারিবাড়ির কেরানিকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন অভিধান রচনার কাজে।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালাভাষার অভিধানে 'পেল্লায়' আছে অবশ্য। কিন্তু ব্যুৎপত্তি পিলে চমকে যাওয়ার মতো। অর্থ প্রকাণ্ড, বিরাট, বেজায় ঠিকই আছে নিশ্চয়, তবে ব্যুৎপত্তি–[ সং- প্রলয় > ]। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের 'বঙ্গবাসী' পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি আছে, ''দেশ হইতে এক পেল্লায় বীর আসিয়া 'যুদ্ধং দেহি' বলিয়া হুঙ্কার ছাড়িয়া দাঁড়াইল।"
হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের 'স্বর্ণপ্রতিমা' উপন্যাস থেকেও উদ্ধৃতি আছে। 'সে একটা পেল্লায় সুদখোর মানুষ।' প্রসঙ্গত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক লেখক হরিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর কলকাতা-বিষয়ক বই 'কলিকাতা সেকালের ও একালের' বইটির জন্য বিখ্যাত হলেও কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। 'স্বর্ণপ্রতিমা' তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
আরও পড়ুন: পেটে খেলে পিঠে সয়, পিঠ থেকেই কি এল ‘পেট’ শব্দটি?
'পেল্লায়' শব্দটির ব্যুৎপত্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহনবাবু বাস্তবিকই এক প্রয়লঙ্কর কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছেন। 'প্রলয় কাণ্ড এই ভাব হইতে' নাকি বিরাট, প্রকাণ্ড, বিশাল ভাবটি আসছে। এটা মানা যায় না। ধ্বংসের আয়োজন কীভাবে বিরাট, বিশাল বলে চিহ্নিত হয়, তা বোঝা দুষ্কর। তবে পরবর্তীকালে যত অভিধান লেখা হয়েছে, কোনওটাতেই অভিধানকাররা প্রলয়-তত্ত্বের বাইরে বেরতে পারেননি। সকলেই একবাক্যে [প্রলয় > পেল্লায়] ব্যুৎপত্তিটিকেই শিরোধার্য করেছেন। সংসদ বাংলা অভিধান, বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান (জামিল চৌধুরী-সম্পাদিত), বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধান, সর্বত্রই প্রলয় থেকে পেল্লায় আসার কথা বলা হয়েছে।
বিবর্তনমূলক অভিধানে প্রয়োগদৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে শিবরাম চক্রবর্তীর ১৯৪০ সালে লেখা গল্পের। 'তার নাড়িতে পর্যন্ত প্রকৃতির ছাপ পেল্লায় রকমের।' মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত আরবি ফারসি উর্দু বাংলা অভিধানে পেল্লায় নেই। অর্থাৎ, আরবি-ফারসি নয় শব্দটি। অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস সম্পাদিত 'সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান'-এ পেল্লায় পাইনি। কোল-অস্ট্রিক-মুন্ডারি ভাষা থেকে তাই পেল্লায় শব্দটি আসেনি। তাহলে সাঁওতালি-বাংলা অভিধানে স্থান পেত পেল্লায়।
পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-চিনা-জাপানি-স্প্যানিশ-ল্যাটিন, কোনও ভাষা থেকেই যে পেল্লায় শব্দটি আসেনি সেটাও নিশ্চিত। কেননা বিদেশি ভাষা থেকে আগত শব্দের তালিকাগুলি খুঁটিয়ে দেখলে পেল্লায়-জাতীয় কোনও শব্দের দেখা মেলে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমগ্র সাহিত্যকর্মে মাত্র দু'বার 'পেল্লায়' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ১৩৫৫ সালে গল্পস্বল্পের অন্তর্গত 'রাজার বাড়ি' গল্পে লিখেছেন- 'আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে ইরু খুব একটা-কিছু মনে করত। হয়তো একদিন ইস্কুল থেকে আসতেই সে ব'লে উঠেছে, উঃ সে কী পেল্লায় কাণ্ড।'
১৩৫৫ সালেই ভাষাতত্ত্ব-বিষয়ক একটি প্রবন্ধ 'বাংলাভাষা-পরিচয়'-এ লিখেছেন, 'বাল্যকালে প্রলয়-ব্যাপারকে'পেল্লায়' ব্যাপার বলতে শুনেছি মেয়েদের মুখে।' আসলে প্রলয় শব্দটির অপভ্রংশপ্রাপ্ত রূপ হলো 'পেলয়'। তারাশঙ্করের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা', গজেন্দ্রকুমার মিত্রর 'উপকণ্ঠে', এই দু'টি বইয়ের কথা মনে আছে, যেখানে 'পেলয়' শব্দটি আছে মুখের ভাষায়। 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'-য় বনওয়ারী বা সুচাঁদ পিসির মুখে তরাস, পেলয়, এসব খুবই স্বাভাবিক। বিশেষত দেবতা 'বড়কত্তা'-র অধীনে যখন তাদের বাস করতে হয়! গজেন্দ্রকুমার মিত্র 'উপকণ্ঠে' উপন্যাসে চরিত্রের মুখে বসাচ্ছেন, 'অক্তগঙ্গা বা পেলয় কুরুখেত্তর ঘটে যাক।' প্রলয়জাত এই 'পেলয়'-কে অনেকেপেল্লায়-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মত বিরাট মাপের লেখকও তার ব্যতিক্রম নন।
দ্রাবিড়ভাষা থেকে কি পেল্লায় আসতে পারে? ভাবতে ভাবতে গুগল ট্রান্সলেট -এর শরণাপন্ন হলাম। বাংলা 'বিশাল' শব্দটি দেখলাম তামিল-এ পেরিয়া। কন্নড়ে পেরিয়, পেড্ডা। রাজনীতিবিদ পেরিয়ার রামস্বামীর নাম অনেকেই জানেন। দক্ষিণের পেরিয়ার নদী, পেরিয়ার জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যও অনেকের কাছে পরিচিত। পেরিয়া যে দক্ষিণে এখনও বড় বা বিশাল অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে তো দেখাই যাচ্ছে। কেরলের কাসারগড় জেলায় পেরিয়া গ্রামের দেখা পাচ্ছি। আবার সুজলাসুফলা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজিলায় পেরিয়া ইউনিয়নের অস্তিত্বও আছে। তাহলে বাংলায়, অন্তত স্থাননামে বিশাল-অর্থে পেরিয়া একসময় চালু শব্দ ছিল। পরে অপভ্রংশে পেল্লায় হয়ে গেছে। পেরিয়া > পেল্লিয়া > পেল্লায়া > পেল্লায় > পেল্লাই।
চিন্না তামিল শব্দ। বাংলায় এসেছে চিনা বা চিনে হয়ে। অর্থ ছোট। তেমনি তামিল 'পেরিয়া' বাংলায় পেল্লিয়া তথা পেল্লায় বা পেল্লাই হয়ে গেছে। মানে বিরাট, বিশাল, বৃহৎ। জানি না অবাঙালি পদবি পিল্লাই-ও এখান থেকেই এসেছে কিনা। চিনা বা চিনে সংযোগে অনেক শব্দ এসেছে বাংলাভাষায়। যথা চিনা বাদাম, চিনা ধান, চিনে জোঁক, চিনে চিংড়ি, চিনা বাজর। সবক্ষেত্রেই চিনা বা চিনে মানে এখানে ক্ষুদ্র। তেমনই পেল্লায় বা পেল্লাই বাড়ি, পেল্লায় মাঠ, পেল্লায় গোলা, পেল্লায় মল, সবই পেল্লায়ের সদর্থক ব্যবহার।
বন্ধু শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র এক পেল্লায় দূরবিন দিয়ে দিবারাত্র আকাশের গ্রহনক্ষত্র দেখে যাচ্ছেন ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে। পেল্লায় পেল্লায় গ্রহের ফাঁক দিয়ে অতিকায় নক্ষত্রদের দর্শনে তিনি নিয়োজিত।
অভিধানকাররা পেল্লায়কে প্রলয়-শব্দের অপভ্রংশ পেলয়-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় শব্দটিই রাখেননি অভিধানে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, সুবলচন্দ্র মিত্র, সুভাষ ভট্টাচার্য, জামিল চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ, রাজশেখর বসু প্রমুখ স্বনামধন্য অভিধানকার তাঁদের পেল্লায় পেল্লায় বইয়ে 'পেল্লায়' শব্দটির ব্যুৎপত্তি ভুল দিয়েছেন। প্রলয়-এর বাইরে কেউ অন্যকিছু দেননি। ভাবার চেষ্টাও করেননি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই ভুলের ফাঁদে পা দিয়েছেন।কবিগুরুর একটি গানের চরণ দিয়েই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করছি–
প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে
হে নটরাজ! জটার বাঁধন পড়ল খুলে।