সংক্রামক রোগ থেকে জন্ম আলস্যের? কীভাবে এল 'কুঁড়ে' শব্দটি?

Bengali Word Origin: প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে শব্দটিকে কুষ্ঠরোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ভেবে নিয়েছেন।

এবারের আলোচ্য শব্দটি হ'ল কুড়ে, বানানভেদে কুঁড়ে। এ কিন্তু পর্ণকুটীর বা মেটে পাথরের গোলাকার ভোজনপাত্র নয়, এ হল অলস অর্থে কুঁড়ে। এই কুড়েই (কুঁড়ে) ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে তাবড় তাবড় অভিধানকারকে। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে শব্দটিকে কুষ্ঠরোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ভেবে নিয়েছেন। আসলে তা যে কত বড় ভ্রান্ত ধারণা, সেটা ধরা পড়ে গেছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে কুড়ে, কুঁড়ে, কুড়িয়া-এন্ট্রিতে শব্দটিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা ভাষা-চিকিৎসকরাও করতে পারবেন না। লেখা হয়েছে, বিং [কুড় + ইয়া > কুড়িয়া > কুড়্যা(কুড়ে); কুঁড়িয়া, কুঁড়ে; হি কোঢ়িয়া, মারাঠি কোডী, মৈ কোঢ়িআ,—কুষ্ঠগ্রস্ত, অলস; ওড়িয়া কোঢ়িআ; অসমিয়া কুঠীয়া] কুষ্ঠরোগপীড়িত, গৌণার্থে কর্মে অপটু। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে কুঁড়ে শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে লেখা হয়েছে, [সংস্কৃত কুষ্ঠ]। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৮৮০ সালের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি আছে, "যত সব কুঁড়ে আছে ঠাঁই জুড়ে।" কুঁড়ের বাদশাহ যে কে সেটা বোঝাতে দৃষ্টান্ত দেওয়া আছে, সেলিনা হোসেনের ১৯৭৫-এর একটি লেখা থেকে, "ছেলেটা বাপের মতো কুঁড়ের বাদশা হয়েছে।"

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই অভিধানের মতে অনেক কিছুর বিবর্তন হলেও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল ধারণার কোনও বিবর্তন বা পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ 'কুষ্ঠ' থেকেই কুঁড়ে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কুষ্ঠ-ধারণার সপক্ষে মত জোগাড় করতে সাধক রামপ্রসাদ সেনের গান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, "প্রসাদ বলে ওমা তারা হ'য়ে আছি আদি কুড়ে/ ওই যে তোমার দরজা জুড়ে বসে গেছে যত দেশের কুড়ে।" কুষ্ঠরোগীরা যেমনভাবে তীর্থস্থানে মন্দির-মসজিদের দরজা জুড়ে বসে থাকে, কুড়েরাও দরজার সামনে প্রসাদের জন্যে লাইন লাগিয়েছে। অর্থাৎ হরিচরণবাবু সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন কুষ্ঠরোগী ও কুড়ে একই শব্দজাত। কুষ্ঠ থেকে কুড়। তা থেকে কুড়িয়া হয়েই নাকি কুড়ে তথা কুঁড়ে।

আরও পড়ুন- ‘পাগল’ নাড়ালে রক্ষে নেই, ‘সাঁকো’ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে কোন রহস্য

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে কুঁড়ে নিয়ে লেখা হয়েছে, [কুঁড়িয়া দ্রষ্টব্য] বিণ, অলস। বি, কুঁড়েমি। প্রবাদের উল্লেখ করা হয়েছে, "কাজে কুঁড়ে,ভোজনে দেঁড়ে, বচনে মারে পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে"। "কুঁড়ে গরু অমাবস্যা খোঁজে।" অমাবস্যায় হলচালনা নিষিদ্ধ বলিয়া সেদিন গরুর বিশ্রাম। (তা হতে) অলস ব্যক্তি বিশ্রামদিনের অনুসন্ধান করে।"

কুঁড়ের আগের বানানরূপ কুঁড়িয়া। সেখানে এই অভিধানকারের ব্যাখ্যা, [হিন্দি - কোঢ়িয়া, গ্রাম্য কুঁড়ে]। সংসদ বাংলা অভিধান লিখেছে, [ কুঁড়ে- বিণ.(দেশি) অলস। কুঁড়েমি বি. অলসতা, আলসেমি]।

জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা আকাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে অবশ্য কুঁড়ে তথা কুড়ে-কে দেশি শব্দ বলা হয়েছে। সুবলচন্দ্র মিত্রর আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে কুঁড়ে বা কুড়ে শব্দটিই নেই। এখানেই আমার খোঁজাখুঁজির শুরু। সুবলচন্দ্র মিত্রর অভিধানে কুঁড়ে পেলাম না। কিন্তু পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে 'কুণ্ঠ' পেলাম। কী আশ্চর্য, অর্থের দিক থেকে 'কুণ্ঠ' শব্দটি কুঁড়ের সমার্থক। অলস, জড়, মূর্খ, অকর্মণ্য। ব্যুৎপত্তি, [কুন্ ঠ + অন্, ক্ত ক। বিণ; ত্রি।] সমস্ত প্রামাণ্য বাংলা অভিধানে 'কুণ্ঠ' শব্দটি আছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে কুণ্ঠ-র বিষয়ে লেখা হয়েছে, "বিণ [ √কুণ্ঠ্ + অ (অচ্)-ক ], কর্মে মন্দ; অলস, অকর্ম্মণ্য"। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধান কুণ্ঠ-এন্ট্রিতে লিখেছে, "[কুণ্ঠ্ (আলস্য করা) + অ(র্ত্তৃ)৷ যে আলস্য করে] বিণ, আলস্যযুক্ত; অলস; জড়, কুঁড়ে"। সংসদ বাংলা অভিধানে কুন্ঠ-বিষয়ে আছে, [-কুণ্ঠ বিণ.(অন্য শব্দের পরে সমাসবদ্ধভাবে ব্যবহৃত) কর্মে অনিচ্ছুক, কাতর (ব্যয়কুণ্ঠ, শ্রমকুণ্ঠ)]। অর্থাৎ সংসদ বাংলা অভিধান কুণ্ঠ-কে স্বাধীন শব্দ হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি। অন্য শব্দের লেজুড় হিসেবে ভেবে নিয়েছে। তবে শ্রমকুণ্ঠ মানেই যে অলস, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।

বাংলা আকাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে কুণ্ঠ-র ব্যুৎপত্তি [সং. √কুণ্ঠ + অ]। অর্থ অকর্মণ্য, অলস(কর্মকুণ্ঠ)।
অর্থাৎ সমস্ত অভিধানে কয়েক পাতার ব্যবধানে কুণ্ঠ ও কুঁড়ে শব্দদু'টি আছে একই অর্থে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে তো কুণ্ঠ-র অর্থই দেওয়া হয়েছে কুঁড়ে। সুশীলকুমার দে'র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে কুড়ে (কুঠে) নিয়ে অনেকগুলি প্রবাদ আছে।

১. কাঙাল কুড়ে বেনে, বেচে শুঁঠ আর ধনে।

২. কুড়ে মুরগির ঠোঁটে বল।

৩. ভাবনা কিরে কুঠে, তোর মাচা ভরা ঘুঁটে।

৪.মিথ্যা কথা প্রবঞ্চনা, হয় ত কুড়ে, নয় ত কানা।

৫. সাত কুড়ের ঘর, গোঁসাই রক্ষা কর।

৬.ধর্মের ঘরে কুড়ের অভাব নাই।

আরও পড়ুন-চোর না পতিতা? ‘ছিনাল’ শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বত্র 'কুঁড়ে' বানানটি ব্যবহার করেছেন। 'বাংলভাষা-পরিচয়'-এ লিখেছেন, "এই প্রসঙ্গে আমাদের ভাষার একটি বিশেষ ভঙ্গীর কথা বলি। 'সব' শব্দের অর্থে কোনো দূষণীয়তা নেই, 'যত' সর্বনাম শব্দটাও নিরীহ। কিন্তু দুটোকে এক করলে সেই জুড়িশব্দটা হয়ে ওঠে নিন্দার বাহন। 'মূর্খ', 'কুঁড়ে' কিংবা 'লক্ষ্মীছাড়া' প্রভৃতি কটুস্বাদ বিশেষণ ওই 'যত সব' শব্দটাকে বাহন ক'রে ভাষায় যেন মুখ সিঁটকোতে আসে, যথা, 'যত বাঁদর এক জায়গায় জুটেছে' বললেই যথেষ্ট অকথ্য বলা হয়।"

'চিরকুমার সভা'-য় তিনি রসিকের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, "সংসারে সেরা লোকেরাই কুঁড়ে এবং বেকার লোকেরাই ধন্য। উভয়ের সম্মিলন হইলেই মণিকাঞ্চনযোগ। এই কুঁড়ে-বেকারের মিলনের জন্যেই তো সন্ধ্যাবেলাটার সৃষ্টি হয়েছে।"

ভারতবর্ষ বইয়ে কবিগুরু লিখেছেন, "রূপকথায় শুনিয়াছি রাজা প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন সকালবেলায় উঠিয়া যার মুখ দেখিবেন তারই সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন। কন্যাদায়-হরণের এটা সোজা রাস্তা— যারা কুড়ে মানুষ তাদের পক্ষে এই রাস্তাই ভালো।'

কুণ্ঠ থেকেই কুঁড়ে শব্দটি এসেছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। হরিচরণবাবু কুষ্ঠের পক্ষে যতই সওয়াল করুন না কেন, তা ধোপে টেকে না। তা ছাড়া কুষ্ঠ থেকে কুঁড়ে হলে, আরও অনেক রোগ থেকে আলস্যসূচক আরও অনেক শব্দ সৃষ্টি হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি। বেতো ঘোড়া অবশ্য কুঁড়ের চেয়েও শ্রমবিমুখ! আমার মতে,
কুণ্ঠ + ইয়া > কুণ্ঠিয়া > কুণ্ঠে > কুঠে > কুড়ে। অথবা,
কুণ্ঠ + ইয়া > কুণ্ঠিয়া > কুণ্ডিয়া > কুঁড়িয়া > কুঁড়ে > কুড়ে।
বস্তুত কুণ্ঠ বলে একটি শব্দ যে অভিধানগুলিতে সশরীরে বর্তমান এবং তার অর্থ যে অলস, অকর্মণ্য, শ্রমবিমুখ, তা কুঁড়ের খোঁজ না পড়লে জানাই যেত না!

More Articles