'জামি' শব্দটি কি অশ্লীল? জানেন এই হারিয়ে যাওয়া শব্দের অর্থ
জামি মানে যে কুলস্ত্রী, কুলবধূ বা দুহিতা, এটি বেশিরভাগ প্রামাণ্য অভিধানেই আছে। তা, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ', জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান', সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গলা অভিধান' বা নগেন...
এক-একটি তৎসম বাংলা শব্দের তদ্ভব রূপ আমরা কোথাও দেখতে পাই না। হয়তো দেখতে পাই, কিন্তু চিনতে পারি না। যেমন ধরুন, 'জামি' (জম.ইঞ্। ইন্ নিপাতনাৎ সাধুরিত্যেকে) শব্দটির কথা। জামি মানে যে কুলস্ত্রী, কুলবধূ বা দুহিতা, এটি বেশিরভাগ প্রামাণ্য অভিধানেই আছে। তা, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ', জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান', সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গলা অভিধান' বা নগেন্দ্রনাথ বসুর 'বিশ্বকোষ'– যাই হোক না কেন। বানানভেদে 'জামী'-ও লেখা হয়েছে কোথাও কোথাও। জামিকৃৎ মানে যে সম্বন্ধী, তাও জানতে পারি অভিধান থেকে।
একসময় জামি শব্দটি থেকে জামিষষ্ঠী হয়ে জামাইষষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল বলে একটি তত্ত্বের অবতারণা করেছিলাম, কিন্তু জামি শব্দটি নিজে যে কোথায় হারিয়ে গেল, সেটাই আমার কাছে ধোঁয়াশা। সাহিত্যে এর কোনও ব্যবহার নেই, গল্প-উপন্যাসে তো নেই-ই, কবিতাতেও নেই। সংস্কৃত শ্লোকের বাইরে এর প্রয়োগ দেখছি না। জামি-র বহুবচন যে জাময়ঃ বা জাময়ো, তা সংস্কৃত শ্লোকেই পাই।
আরও পড়ুন: লীলাবতী, কালো বিড়াল আর জামাইষষ্ঠীর হাট
মনুসংহিতায় যেমন লেখা হয়েছে:
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎকুলং
অস্যার্থ, জামি যে সংসারে পূজিত হন, সেখানে সুখসমৃদ্ধি বিরাজ করে, আর যে সংসারে জামি লাঞ্ছিত হন, সেই সংসারে অশান্তি দেখা দেয়, বিনাশ হয় বংশের।আবার এও লেখা হয়েছে,
জামিঃ স্বসৃকুলস্ত্রিয়োঃ
আর এক জায়গায় আছে,
নবোঢ়াদুহিতৃস্নুষাদ্যা জাময়ঃ
তা না হয় হলো, আস্ত একটি শব্দ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ভ্যানিশ হয়ে কোথায় যে চলে যায়, তাকে আর ট্রেস করা যায় না কেন, সে-বিষয়ে আমার উৎসাহ ও অনুসন্ধিৎসার জন্যই নাছোড়বান্দা হয়ে খুঁজতে থাকি।জামি-র উৎস ও মোহনার সন্ধানে অভিযান চালাতে চালাতে অনেক সম্ভাব্য শব্দের দেখা মেলে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বোঝা যায়, এ সে নয়। মানে অভীষ্ট তদ্ভব রূপটি অধরাই থেকে যায়। অভিধান থেকে অভিধানে তল্লাশি চালিয়ে যেতে হয়। মনে এই আশা নিয়ে, 'পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন'।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিরচিত 'বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান'-এ জামি শব্দটি নেই দেখে কিঞ্চিৎ অবাকই হলাম। আসলে আরবি-ফারসি থেকে আসা জাম, জামিয়া প্রভৃতি শব্দের দৌরাত্ম্যে জামি-বেচারির করুণ হাল হয়েছে। কোথাও শব্দটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
জামীর মানে লেবু, তার সঙ্গেও জামি-র কোনও সম্পর্ক নেই। জামবাটি, জামদানি- শব্দদু'টি যথাক্রমে কাঁসার বড় পাত্র, বিশেষ ধরনের শাড়ি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু হতাশ হতে হয়, যখন দেখি শব্দদু'টির জাম অংশটি ফারসি থেকে এসেছে, মানে বৃহৎ বা সেরা। তবুও যেন মন মানে না। এটাও কি হতে পারে না যে, মহিলা তথা জামি-রা রান্নাঘরে যে বড় বাটি ব্যবহার করত, সেটাই ছিল জামিবাটি বা সংক্ষেপে জামবাটি? তেমনই জামিদের পছন্দসই শাড়ি বলেই হলো জামিদানি তথা জামদানি নাম? কোনওটাই হয়তো ঠিক নয়, তবু মন বলে, এটাই হয়তো অভ্রান্ত। হতেও তো পারে, জামি থেকেই এসেছে এয়োস্ত্রীদের প্রয়োজনীয় জামবাটি ও জামদানি?
তাহলে কি কোথাও দেখা পাব না জামি-র, কোনওখানেই মিলবে তার হদিশ? খুঁজতে খুঁজতে মনে অবসাদ দেখা দেয় একসময়।
অবসাদ থেকেই হঠাৎ মনে পড়ে আটের দশকে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার দিনগুলির কথা। বউবাজারের মেডিক্যাল কলেজ মেন হস্টেলে আমার রুমমেট গৌতম (এখন অস্থি-বিশেষজ্ঞ) প্রায়ই বলত, "চল কলেজ স্কোয়ারে ছাম দেখে আসি।" মফসসল থেকে পড়তে আসা ঘরের বাকি তিন জন 'ছাম' কথাটির মানে বুঝতাম না। একদিন জিজ্ঞেস করায় বলল, "মেয়েছেলে বুঝিস না হাঁদা?" সত্যিই তার মুখে 'ছাম' শব্দের এই অর্থ শুনে আমরা যুগপৎ চমকিত ও শিহরিত হয়েছিলাম। তাকে সঙ্গ না দিলে যে 'মেরে থোবড়া বিলা' করে দিতে পারে, সে ভয়ও দেখাত।
ছাম শব্দটি পরে আর কারও মুখে শুনিনি, পড়িওনি কোথাও। বিস্মৃতির অতল অন্ধকারে চলে যাচ্ছিল শব্দটি।
হঠাৎ করেই একদিন অভ্র বসুর লেখা 'বাংলা স্ল্যাং, সমীক্ষা ও অভিধান' বইটিতে ছাম শব্দটিকে আবিষ্কার করে চমকে উঠেছিলাম। ছাম/ছামি/ ছামিয়া- তিনটি শব্দেরই মানে 'সুন্দরী মেয়ে'।
তাহলে কি জামি থেকেই অপভ্রংশে ছামি হয়ে ছাম হয়ে গেছে? নবারুণ ভট্টাচার্য এই শব্দটি কখনও ব্যবহার করে গেছেন কি না জানি না, তবে জামি-অর্থে ছাম শব্দটির ব্যবহার বাংলার হালফিলের সাহিত্যে থাকতেই পারে। আমার জানা নেই, কেউ সুন্দরী নারী অর্থে ছাম শব্দের ব্যবহার করে গেছেন কি না। লেখক অজিত রায় আর আমাদের মধ্যে নেই। বাংলা স্ল্যাং নিয়ে তাঁর ছিল সুগভীর পাণ্ডিত্য। তাঁকে জিজ্ঞেস করার আর কোনও উপায় নেই।
তবে জামি যে ছামি হয়ে ছাম হয়ে গেছে, অশ্লীলতাগন্ধী হয়ে উঠেছে, এটা ভাবলেই রোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে।
আমরা ছেলেবেলায় মা-জেঠিমার মুখে অনেক আটপৌরে শব্দ শুনতাম। কলুর বউ, কিষাণবউ, বড় বউ, মেজ বউ, সেজ বউ, ন'বউ, ছোট বউ ইত্যাদি ইত্যাদি। সপ্তাহে একদিন নাপিতবউ আসত নরুন দিয়ে নখ কাটতে। এছাড়া বাড়ির কারও কারও ভাসুর-ভাদ্দরবউ সম্পর্ক তো ছিলই।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশী ডাক্তারের স্টাইলে কুসুমকে 'পরানের বউ' ডাকার মতো বাবাও কাউকে কাউকে গণেশের বউ, কার্তিকের বউ বলে সম্বোধন করতেন। এই জাতীয় সম্বোধনের মধ্যে জেঠিমাকে পাশের পাড়ার কাউকে 'জামিবউ' ডাকতে শুনতাম প্রায়ই। এই শব্দবন্ধ যদি সঠিক হয়, তবে বউ অর্থে জামি-র একটি প্রণিধানযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
যাই হোক, শব্দতল্লাশি চালিয়ে যেতেই হবে।
সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-পর্তুগিজ-ডাচ-গ্রিক-চিন-জাপানি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেন্দ্রাভিমুখে যাত্রা করতে হবে। কেন্দ্র লিখেই মনে পড়ল, কেন্দ্র, জামিত্র আর সুড়ঙ্গ- শব্দ তিনটি বাংলায় এসেছে গ্রিকভাষা থেকে। চোখ-কান খোলা রেখেই ভাষার খানাতল্লাশি চালাতে হবে।