পেটে খেলে পিঠে সয়, পিঠ থেকেই কি এল 'পেট' শব্দটি?
Bengali Vocabulary: সংস্কৃত না অস্ট্রিক না দ্রাবিড়, ঠিক কোথা থেকে এসেছে পেট শব্দটি, তা ভেবে কূলকিনারা পাওয়া শক্ত।
এবারের শব্দ পেট। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে পেট মানে যখন পিটক, মঞ্জুষা বা ঝাঁপি, তখন এর ব্যুৎপত্তি, [√পিট্ সংঘাত + অ (ঘঞ্)-র্ম্ম, স্ত্রী আ (টাপ্), ঈ (ঙীব্); তামিল 'পেট্টি', বাক্স]। আবার পেট মানে যখন উদর, তখন এর ব্যুৎপত্তি, [ 'পোট্ট' – দেশি] মানবপেটের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে, 'বড় বড় বানরের বড় বড় পেট। যাইতে সাগর-পারে মাথা করে হেঁট।' (নবীন তপস্বিনী: দীনবন্ধু মিত্র) সুবলচন্দ্র মিত্রর আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে পেট শব্দটির বিষয়ে লেখা হয়েছে, '১. মঞ্জুষা; পেটরা, ঝাঁপি, প্রভৃতি; সমূহ। [পিট + অপ্ অধি। সং; পু] ২. উদর। দেশজ; সং।' জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ উদরার্থে পেটের ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছ, [দেশী প্রাকৃত পোট্র= উদর; মারাঠী- পোট, পোড় ]।সংসদ বাংলা অভিধানে পেট শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করা হয়নি। বলা হয়েছে, [তামিল পেটু?]। সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধানে মঞ্জুষা, পেটরা, ঝাঁপি অর্থে পেট-কে সংস্কৃত থেকে আগত বলা হয়েছে। [ পিট + অল্ অধি। বি; পু।] আবার উদর-অর্থে পেটকে 'বাংলা প্রচলিত' বলে দেগে দেওয়া হয়েছে।
জামিল চৌধুরী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা অভিধানে পেট-কে দেশি বলা হয়েছে। অস্ট্রিক না দ্রাবিড় তা অবশ্য খোলসা করে বলা হয়নি। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে, সংস্কৃত থেকে আগত শব্দ পেট। অর্থ– উদর, অন্তর, গর্ভ, উপরিভাগ, অভ্যন্তর ভাগ। মালাধর বসু থেকে উদ্ধৃতি আছে, 'ঘরে ঘরে আনে দড়ি বান্ধে তার পেটে।' কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা থেকে আছে, 'বলিলে বচন নাহি প্রবেশিব পেট।' ১৯৪২-এ লেখা জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি আছে, 'ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো।' ১৯৪৯-এ সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, 'বাসের পেটে একপাল কাবুলী।'
অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাশ প্রণীত 'সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান'-এ পেট শব্দটিকে কোল বা অস্ট্রিক বলা হয়েছে। সাঁওতালি ভাষায় শব্দটি তাই স্বমহিমায় বিরাজ করছে। আবার অধ্যাপক সত্যনারায়ণ দাশ সংকলিত 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইয়ে পেট-কে কন্নড় পোট্টে বা পেঙ্গু পোটো থেকে আগত বলা হয়েছে। পেঙ্গুও দ্রাবিড়গোষ্ঠীর ভাষা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, পেট-কে ঘিরে ত্রিমুখী লড়াই।
আরও পড়ুন: টাকা ‘গচ্চা’ যায় সকলেরই, কোথা থেকে এল এই শব্দ
তবে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকের মধ্যে যেন টাগ অফ ওয়্যার চলছে পেটের পিতৃত্ব নিয়ে। সংস্কৃতের দাবি একটু ফিকে সেখানে। সত্যিই কি পেট তামিল, কন্নড় বা কোল-মুন্ডারি থেকে এসেছে? না কি সংস্কৃত বা তৎসম থেকে অর্ধতৎসম বা তদ্ভব হয়ে গেছে? পেটের মধ্যেই কি বাক্সপ্যাঁটরার ভাবটি লুকিয়ে নেই? মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সময় বিখ্যাত সার্জন ডা. এম. এন দাসকে (মৃগাঙ্কমোহন দাস) বলতে শুনেছি, ''Abdomen is a magic box." এক ডায়াগোনসিস করে পেট চিরে দেখেন, আর একটা রোগ লুকিয়ে আছে। বস্তুত ডাক্তারি বিদ্যা কষ্টিপাথরে যাচাই হয় পেটের অপারেশনে। ডা. শঙ্কর সেনগুপ্ত বলতেন, 'Pandora Box'। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে পেট-এর মধ্যেই বাক্স-প্যাঁটরার ভাবটা লুকিয়ে আছে। 'দেহের ঝাঁপি' বললে সত্যের অপলাপ হয় না। দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত থেকে আগত পিটক বা পেট বা মঞ্জুষা বা প্যাঁটরা বা ঝাঁপির ব্যুৎপত্তি আর দেহস্থ পেটের ব্যুৎপত্তি একই।
আর একটি ভাবনাও জাগে মনের মধ্যে, পেটের উল্টোদিকেই যে পিঠ, তার ব্যুৎপত্তি নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সকলেই একবাক্যে বলেন, 'পৃষ্ঠ' থেকে পিঠ। পিঠের বিবিধ অর্থ আছে। ১. পৃষ্ঠ বা back ২.পশ্চাদ্ভাগ বা hind ৩. তল বা surface ৪.পাশ বা side। Surface অর্থে পিঠের ব্যবহার চমৎকৃত করে। পাতার এপিঠ ওপিঠ, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, ন্যাড়ের এপিঠ-ওপিঠ,– লবজগুলি আমাদের শোনা। তাহলে দেহতনুর সামনের দিকটিও এক অর্থে পিঠ। পিঠ থেকেও কি পেট আসতে পারে না?
পিঠ > পেঠ > পেট। এই পরিবর্তনে তল-অর্থও বোঝানো গেল আর দেহের পিছনের তলপিঠ থেকে সামনের তল পেট-এর পার্থক্যও প্রতীয়মান হলো। তাহলে কি আদতে পিঠ আর পেট একই ছিল? পেটে খেলে পিঠে সয়, এই প্রবাদের মধ্যেই যেন পরিস্ফুট হয়েছে পেট আর পিঠের একাত্মতা! আদতে দু'জনেরই যে মা-শব্দ 'পৃষ্ঠ'! পেটে বুদ্ধি না থাকলে তো পিঠে গম গম করে পড়বেই দুচারটে কিল! সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে অনেকগুলি প্রবাদ আছে পেট নিয়ে।
১. একটা পেট তবু কুকুর মরে, খেতে না পেয়ে দুয়ার ধরে।
২. খাটো পেটে আই-ঢাই, মোটা পেটে দিলেই নাই।
৩. ঘরের ষাঁড়ে পেট ফাঁড়ে।
৪. ঘোড়ার পেট, গাধার পিঠ, খালি থাকে কদাচিৎ।
৫. টোকাপানা মাথাটি, খালুই পানা পেটটি।
৬. পরের তেলে কাপড় নষ্ট, পরের ভাতে পেট নষ্ট।
৭. পেট ভাল নয়, চালভাজা খায়।
৮. পেটমোটা হওয়া।
৯. পেটে এক, মুখে এক।
১০. পেটে কালির আঁচড় নেই।
১১. পেটে খিদে মুখে লাজ, সে পিরিতে কী বা কাজ।
১২. পেটে থাকলে গুণ করে, বার হলে খুন করে।
১৩. পেটে দড়ি দিয়ে(গামছা বেঁধে) পড়ে থাকা।
১৪. পেটে দিয়েছে ঠাঁই, হাঁড়িতেও দেবে ঠাঁই।
১৫.পেটে নেই গাধি, ভাতে পড়ে লাদি।
১৬. পেটে নেই ভাত, কানে কেয়াপাত।
১৭. পেটে-পেটে বুদ্ধি।
১৮.পেটে ঢুঁ মারলেও 'ক' অক্ষর বেরোয় না।
১৯.পেটে ভাত নেই ঠোঁটে আলতা।
২০. পেটের ভেতর হাত-পা সেঁধোনো।
২১. পেটের ভাত চাল হয়ে যাওয়া।
২২. পেটে পেটে এত!
আরও আছে। সব লিখে পেট ভর্তি করে লাভ নেই। তবে এইসব প্রবাদের মধ্যে দিয়ে পুরনো দিনের সমাজচিত্রটা কিছুটা হলেও ধরতে পারা যায়। একপেট গিলে এসে অনেকেই যে বাড়িতে অশান্তি বাঁধাত আগেকার দিনে, সেটাও জানা আছে অনেকের। ইদানীং পেটে লাথি মারা, বুকে পা তুলে দেওয়াও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।ডাক্তারি করতে গিয়ে দেখেছি, কথায় কথায় পেটের নাম মুখে আনতে হয়। পেটে আসছে, মুখে আসছে না, বলে অনেক রুগি কালক্ষেপ করে ডাক্তারবাবুর মেজাজ চড়িয়ে দেয়। তবে ডিপ্লোম্যাটিক ডাক্তাররা হাসিমুখেই ওসব আসা-টাসার ধার না ধেরে নিদানপত্র তৈরি করে ফেলেন। 'বুঝেছি', বলেই তাঁরা কম্পাউন্ডারকে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন।
পেটে যন্ত্রণা হওয়া, পেট কামড়ানো, পেট মোচড়ানো, পেটফাঁপা, পেটে জল জমা, পেট ভুটভাট করা, পেট ডাকা– পেটেই যত গণ্ডগোল। পেট ছেড়ে দেওয়াটাও গ্রামের দিকে শোনা যায়। 'পেট ভার হয়েছে' বলে অনেকেই না খাওয়ার বাহানা দেখান। পেট ভার না মন ভার, তা অবশ্য অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে যায় মাঝে মাঝে।
সংস্কৃত না অস্ট্রিক না দ্রাবিড়, ঠিক কোথা থেকে এসেছে পেট শব্দটি, তা ভেবে কূলকিনারা পাওয়া শক্ত। তবু চেষ্টা করতেই হলো।