'চিনি'-র দখল চিনের? স্বাদে মিষ্টি, কিন্তু শব্দের ভেতর লুকিয়ে জটিল রহস্য
Bengali Vocabulary: অনেকের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, চিনি শব্দটি চিনদেশীয়।
এবারের শব্দ 'চিনি'। বস্তুত পাঠ্যবইগুলিতে চিনা ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় আগত শব্দের মধ্যে চিনি-র উদাহরণ থাকায় অনেকের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, চিনি শব্দটি চিনদেশীয়।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ চিনি শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে সন্দিহান। চিনির ব্যুৎপত্তিতে সপ্রশ্ন ['চীনীয়–মূল(?)'] লিখেছেন তিনি। চিনদেশে প্রথম তৈরি হয় বলেই চিনি, তা তিনি বেদবাক্য বলে মেনে নেননি। চিনিকে যে চিনা ভাষায় Thang বলা হয়, তাও লিখেছেন।
নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ-এ চিনি নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হলেও চিনি শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়নি। চলন্তিকা-তেও নেই চিনি-র ব্যুৎপত্তি। সুবলচন্দ্র মিত্র আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে চিনি-কে চিনা শব্দ লিখেছেন। আবার সেই তিনিই সরল বাঙ্গালা অভিধানে চিনি শব্দটিকে 'বাংলা প্রচলিত' বলে দেগে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘পাগল’ নাড়ালে রক্ষে নেই, ‘সাঁকো’ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে কোন রহস্য
বস্তুত চিনিপাতা দই, চিনির বলদ, চিনিচাঁপা, শব্দবন্ধগুলি কমবিস্তর সকলেরই জানা।।
বাংলা একাডেমি-র জামিল চৌধুরী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা অভিধান জানাচ্ছে, চিনির ব্যুৎপত্তি [ সং শর্করা > ]। কিন্তু কোন দুরূহ রাস্তায় শর্করা অপভ্রংশ হয়ে চিনি হয়েছে, সেটা তিনি জানাননি। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত (সহ-সম্পাদক স্বরোচিষ সরকার) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে চিনি-র ব্যুৎপত্তি [সং চীনীয়]।
১৫০০ সালে লেখা মালাধর বসুর 'অতপ্ত তণ্ডুল ফুল চিনি চাঁপাকলা' ও ১৬০০ সালে লেখা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'কিনিঞা নবাত ফেনি বিশা দরে কিনে চিনি পান কিনে সহস্রের দরে।'–পঙক্তিদু'টি তিনি উদ্ধৃত করেছেন।
সংসদ বাংলা অভিধান চিনি-র ব্যুৎপত্তিতে লিখছে, [ চৈ. চি-নি,—তু হি চীনী]। যখন গুগল ট্রানস্লেটে সহজেই দেখা যায়, ট্র্যাডিশনাল ও সিমপ্লিফায়েড চাইনিজে Sugar-এর চিনা তর্জমা Thang, তখন সংসদ অভিধানে প্রদত্ত ব্যুৎপত্তি চৈনিক 'চি–নি'-কে সত্যিই অচেনা ঠেকে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান জানাচ্ছে, [সং=শর্করা=ফা=শকর, শক্কর, শকরীন, শীরা(চিনির রস)= শীরীনী(মিষ্টতা)>বিণ, ক্রমে হিন্দিতে শির্ণী, শিন্নি > চিনি]। অর্থাৎ সংস্কৃত শর্করা থেকে চিনি আনতে তাঁকে ফারসির সাঁকো বেয়ে হিন্দির হাওড় পেরিয়ে অনেকটা ঘুরপথে আসতে হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, চিনদেশীয় বা চিনীয় থেকে চিনি আসার প্রচলিত তত্ত্ব ছাড়াও আরও মত আছে চিনির ব্যুৎপত্তির বিষয়ে। সকলেই চিনের আধিপত্য মেনে নেননি।
চিনির বলদ যে আজীবন চিনির বস্তা বয়েই যায়, চিনি খেতে পারে না, তা সকলেই জানে। তবে এটা জানা যায় না, পিঠ থেকে চিনির বস্তা ফেলে দিয়ে কখনও কোনও বিদ্রোহী বলদ ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিল কি না। যদি তা ঘটে থাকে কোথাও, সেটা ব্যতিক্রমী ঘটনা বলেই চিহ্নিত হবে।
সুশীলকুমার দের 'বাংলা প্রবাদ' বইটিতে চিনি নিয়ে অজস্র প্রবাদ আছে। যেমন—
১. অন্য লোকে ভুরা(নিকৃষ্ট গুড়) দেয়, ভাগ্যে আমি চিনি।(ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসে প্রযুক্ত)
২. যে খায় চিনি, তায় জোগান চিন্তামণি।
৩. কারো দুধে চিনি, কারো শাকে বালি।( 'তোমার এখন দুধে চিনি, আমার এখন শাকে বালি'—গোপাল উড়ে। 'শুনিয়াছি যে আমাদের শাকে বালি ঘুচিয়া দুগ্ধে চিনি হইবেক– দীনবন্ধু মিত্রের গদ্যপদ্য)
৪. চাঁড়ালেরে চিনি, বামুনেরে লবণ।(নিহিতার্থ বলা নেই)
৫. চিনি খেয়ে মেনী হওয়া।
৬. চিনির পুতুল।
৭. চিনির বলদ।
[অর্থাৎ, কেবল বহিয়াই যায়, আস্বাদ পায় না। 'চিনির বলদ সবে একখানি গুণ'–ভারতচন্দ্র। 'আমি যাহা জানি তাহা অবশ্যই বলিব, কিন্তু আমি চিনির বলদের ন্যায়'—টেকচাঁদ ঠাকুরের অভেদী। 'হয়ে আছে চিনির বলদ সদা আজ্ঞাকারী'—গোপাল উড়ে। চিনির বলদ তোমরা কেবল, কেরাণী, মুহুরী সরকারের দল'—মনমোহন বসু। 'শুধু কি বলদ হে, চিনি বহে আঁখি ঢাকা'—সত্যেন্দ্র দত্ত।]
৮. চিনির ভেতর বাহির সমান মিঠে।
৯. পিঁপড়ের গর্ত থেকে চিনি টেনে বার করা।
১০. বামুনের পাতে লবণ নাই, ধোপার পাতে চিনি।
১১. মায়ে রাঁধে যেমন তেমন, বোনে রাঁধে পানি
ওই অভাগী রাঁধে যেন চিনি পরমান্নি। (পক্ষপাতমূলক ঘটনা বোঝাতে)
১২. যে হাতে আছে চিনির গন্ধ, সে হাত চুষতে সবার আনন্দ।
১৩. সতীনের হাত সাপের ছোঁ, চিনি দিলে তুলে থো।
১৪. সুয়া যদি নিম দেয় সেই হয় চিনি
দুয়া যদি চিনি দেয় নিম হন তিনি। (ভারতচন্দ্র)
চিনি-বিষয়ক এই প্রবচনগুলি যেন সমাজের আয়না। সামাজিক বৈষম্য, জাতপাত, পারিবারিক কলহ-বঞ্চনার ছবি যেন প্রতিফলিত হয় এই প্রবাদগুলিতে। চেনা সমাজ যেন মুহূর্তে অচেনা ঠেকে প্রবাদের জেরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে চিরেতা বা নিমের সরবত পান করতেন। তেতো খেলেও চিনিরও তিনি সমঝদার ছিলেন নিশ্চয়। 'জাপানযাত্রী'-তে কবিগুরু লিখেছেন,
আমরা (মানুষের) সেইসব ভ্রমণ ও দুঃসাহসের বোতলে-ভরা মোরব্বা উপভোগ করছি যেন। এতে কোনো কাঁটা নেই, খোসা নেই, আঁটি নেই; কেবল শাঁসটুকু আছে, আর তার সঙ্গে যতটা সম্ভব চিনি মেশানো।
বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ চিনা শব্দের অর্থ যেমন চিনদেশীয় দেওয়া হয়েছে, তেমনই চিনা মানে ক্ষুদ্র ধান্যবিশেষ।কেননা, তামিল, তেলুগুতে 'চিন্না' মানে ক্ষুদ্র। তা থেকেই এই 'চিনা'। খনার বচনে আছে, 'যদি বর্ষে ফাগুনে, চিনা কাউন দ্বিগুণে।' তামিল যে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ভাষা, তা পণ্ডিতরাই বলেন। সুতরাং চিন্না থেকে ক্ষুদ্রার্থে চিনা বা চিনে আসা খুবই সম্ভব।
চিনে (ছিনে) জোঁক, চিনে বাদাম, চিনে চিংড়ি, এগুলো কোনওটাই চিনদেশীয় বা চৈনিক নয়, 'চিনে' মানে এখানে ছোট। চিনা বাজার, চিনদেশীয় লোকেদের বাজার না বড়বাজারের পাশে ছোট বাজার, সেটা নিয়ে আমরা দোলাচলে। হয়তো প্রথমে বড়বাজারের তুলনায় ছোটবাজারকেই বলা হতো চিনাবাজার, পরে চিনারা সেখানে এসে হাজির হয়, ব্যবসা শুরু করে। লোকের মনে এই ধারণা ক্রমশ গড়ে ওঠে যে চিনাদের জন্যই চিনাবাজার নামটি এসেছে।
চিনির দানা ছোট হয়, মিছরির তুলনায় অনেক ছোট। তাই ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দানার মিষ্টদ্রব্য বোঝাতে, মিছরির সঙ্গে চিনিকে পৃথক করতে চিনা বা চিনে দানা বলা হত। তা থেকেই কালক্রমে 'চিনি' শব্দটি চালু হয়ে গেল। অনেক জায়গায় এখনও ছোট দানা মিছরি, ছোট দানা খণ্ড, বলতে শোনা যায়। ছোট মানেই তো চিন্না, চিনা, চিনে, চিনি।
তা বলে চিন থেকে আসা চিনি-প্রস্তুতকারক টং অছিউ যে বজবজের কাছে চিনির কারখানা গড়ে তুলেছিলেন, সেটা কি আমরা দেখিনি? জায়গাটির নামই তো হয়ে গেছে অছিপুর। বাওয়ালির কাছে। টং অছিউ উন্নতমানের আখের চাষও শুরু করেছিলেন চিনি তৈরির জন্য।
কাশীতেও চিনি রফতানি হতো কলকাতা থেকে। তাকে বলা হতো কাশীর চিনি। সেই চিনির রং লালচে। আসলে ইক্ষুরসজাত ছোট দানার মিষ্টদ্রব্যই চিনি নামে পরিচিত হয়েছিল। এর সঙ্গে চিনদেশের কোনও যোগ নেই। ইউরোপের মতো চিন ও ভারতও চিনি প্রস্তুতে দক্ষ ছিল। তার মানে এই নয় চিনীয় থেকে চিনি হয়েছে। বিশ্বকোষ থেকে জানতে পারি ভারতেই প্রথম শর্করা বা চিনি উৎপন্ন হয়েছিল। চিনের দাবি সেখানে নস্যাৎ করা হয়েছে। আর চিনে তৈরি হলেই জিনিসটির নাম চিনি হয় না। তাহলে তো চিনে আবিষ্কৃত বা চিন থেকে আসা সমস্ত জিনিসই চিনি নামে পরিচিত হত! তামিল 'চিন্না' শব্দ থেকে চিনা ধানের মতো চিনিও যে এসেছে, সে-ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।