টাকা 'গচ্চা' যায় সকলেরই, কোথা থেকে এল এই শব্দ
Bengali Vocabulary: ছেলে জয়েন্টে চান্স না পেলে অনেককে বলতে শুনেছি, 'শুধু শুধু দু'বছরের কোচিংয়ে মোটা টাকা গচ্চা গেল।'
এবারের আলোচ্য শব্দ 'গচ্চা'। সামান্য ভুলের জন্য কারও কখনও মোটা টাকা গচ্চা যায়নি, এটা হতেই পারে না। হয়তো সেরকম সাবধানী লোক আছেন, তবে সংখ্যায় কোটিতে গুটিক। 'গচ্চা' শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে আক্ষরিক অর্থেই নানা মুনির নানা মত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ লিখেছেন, 'বি, [ ? ] বৃথা ব্যয়; অকারণ দণ্ড।' বলা বাহুল্য, ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে তিনি ব্যর্থ। তাই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একটি জিজ্ঞাসা-চিহ্ন দিয়েই তিনি খালাস। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ব্যুৎপত্তি-ব্যর্থতা দেখে মনে হলো, কপালে দুঃখ আছে এ-যাত্রায়!
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান' ব্যুৎপত্তি জানাচ্ছে, [হিন্দি. ঘাটা >]। ঘাটা থেকে গচ্চা আসার সম্ভাবনা কতটা, সেটা চিন্তা করলে মাথা ঝিমঝিম করে। অনেক ঘাটের জল খেয়ে তবেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে। সংসদ বাংলা অভিধানে 'গচ্চা' নিয়ে লেখা হয়েছে, 'বি, ক্ষতিপূরণ; অনর্থক দণ্ড; অসাবধানতার জন্য লোকসান (একগাদা টাকা গচ্চা গেল, গচ্চা দিতে হলো) [দেশি]। 'চলন্তিকা'-য় ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়নি। প্রচলিত অর্থই শুধু দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ব্যুৎপত্তি 'দেশি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ গচ্চা শব্দটির সম্বন্ধে লেখা হয়েছে,- 'গোঁজা, দাঁড়; অনর্থক ক্ষতিপূরণস্বরূপ দণ্ড, গুণাগার; অসাবধানতার দরুণ লোকসান। বাংলা প্রচলিত। বি।' গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত 'বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'-এ গচ্চা-র ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [পালি গচ্ছ > ]। শেষ পর্যন্ত পালিকে ধরেও টানাটানি! ১৯৭০-এ শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা গল্প থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, 'চার চারটা টাকা গচ্চা গেছে।'
আরও পড়ুন: চোর না পতিতা? ‘ছিনাল’ শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই
গচ্চা নিয়ে সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে একটিই মাত্র বাগধারা আছে। সেটি হলো, 'আড়াই টাকা গচ্ছা যাক্, নিজের কথা ওপরে থাক।' এর অর্থ আর খোলসা করে বলা হয়নি এখানে। তবে গচ্চা-কে এখানে পাঠভেদে 'গচ্ছা' লেখা হয়েছে। মনে হয়, আদালতের মামলা-মোকদ্দমা-সংক্রান্ত লবজ এটি।
গচ্চা নিয়ে এত মতান্তর, কিন্তু কোনও অভিধানেই শব্দটিকে সংস্কৃত থেকে আগত তথা তৎসম বলে দাবি করা হয়নি। গচ্চাকে দেশি শব্দ বলে দাবি করেছে অনেক অভিধান। কিন্তু সত্যনারায়ণ দাশের লেখা বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ বইয়ে গচ্চা-র দেখা মেলে না। অস্ট্রিক থেকে আসছে কি না, তাও কেউ খোলসা করে বলেননি। শব্দটি ভোটচিনীয় গোত্রের কি না, সেটাও জানা যায়নি।
ইউরোপীয় কোনও ভাষা থেকেই আসেনি গচ্চা। গুগল ট্রানস্লেটে অন্তত পাইনি আমি। আসেনি আরবি-ফারসি থেকেও। মোহাম্মদ হারুন রশিদের আরবি ফারসি উর্দু বাংলা অভিধানে নেই গচ্চা। নেই মুহাম্মদ ফজলুর রহমানের আরবি-বাংলা অভিধানেও।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যকর্মে একবারও 'গচ্চা-র দেখা পেলাম না। আর কারও সাহিত্যেও পেলাম না। মাঝখান থেকে অনেকটা সময় গচ্চা গেল। হয়তো অনেকে লিখেছেন, ধরার কোনও উপায় নেই এই মুহূর্তে। অতএব শিবরাম চক্কোত্তিই অগতির গতি। 'চার চারটা টাকা গচ্চা গেছে' বলে কথা! 'হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন'-এর কি না জানি না অবশ্য!
গচ্চা তাহলে এল কোথা থেকে? দেশি হোক বা বাংলায় প্রচলিতই হোক, ব্যুৎপত্তিটা কোথায় পাওয়া যাবে? সবাই তো এ-বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। অগত্যা একটু নিজে নিজে চেষ্টা করতে দোষ কী!
গাঁটের কড়ি-র গাঁট মানে ট্যাঁক। গাঁট থেকে গচ্চা হওয়া বেশ শক্ত। অর্থও দাঁড়ায় না। গচ্ছিত ধনের 'গচ্ছিত' থেকেও সঠিক অর্থে গচ্চা আসা কঠিন। হরিচরণে বলা হয়েছে, টাকা রাখার আধারকে গচগিরি বলে। তা না হয় হল, লোকসানটা হচ্ছে কীভাবে? গচ মানে আবার স্থূল বা পুরু। তা থেকেও প্রচলিত অর্থে গচ্চা আসা অসম্ভব। তৎসম বাংলায় 'গতসর্বস্ব' বলে একটি কথা আছে বটে, হৃতসর্বস্বের মতো। সাহিত্যে প্রয়োগও আছে। অক্ষয়কুমার দত্তর লেখা বই 'অক্ষয়-সুধা'-য় 'গতসর্বস্ব' পাওয়া যায়। পাওয়া যায় হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের 'কলিকাতা সেকালের ও একালের' বইয়েও।
গতসর্বস্ব কিন্তু বিশেষণ পদ, মানে যে সর্বস্ব(সমস্ত ধন) খুইয়েছে। তা থেকে 'বিশেষ্য' গচ্চা আসা শক্ত। অভিধানে 'গতস্ব' বলে কোনও শব্দের দেখা পাইনি। 'গত যে স্ব'(হাতছাড়া হয়েছে যে ধন), বললে একটা মানে দাঁড়ায়। 'পরের স্ব' তথা পরস্ব-র মত গতস্বও বিশেষ্য। গতস্ব থেকে অবশ্য সহজেই 'গচ্চা' আসতে পারে।
গতস্ব > গতচ্ছ > গচচ্ছ > গচ্ছা > গচ্চা।
খেসারত বা লোকসানকে গতস্ব তথা গচ্চা বলা যেতেই পারে। এতে অন্যায় কিছু নেই। তবে সবচেয়ে সদর্থক ব্যুৎপত্তি পাওয়া যাবে গছা বা 'গছান' শব্দটির দিকে তাকালে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ 'গছা' শব্দটির একটি ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে,- গছা সর্ম্ম [ গছ+ আ; অসমিয়া√গছা]। অর্থ, গ্রহণ করান, পাওয়ান বা দেওয়া। উদাহরণ, 'তথাচ যতন করি প্রভু গছাইলা'।(ভক্তমালগ্রন্থ-বলাইদাস গোস্বামী-সম্পাদিত) ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখেছেন, 'শ্লোক রাখি কৌটা ঢাকি হীরারে গছায়'। 'ধনা রাক্ষসীর করে গছাইয়া দিল।' (বাইশ কবি মনসা, অমূল্যরতন বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রকাশিত)। 'গছান' শব্দের মানে বুঝতে আর কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
দোকানে রদ্দি জিনিস গছিয়ে দেওয়া তো দোকানদারের একটি গুণপনা বলেই চিহ্নিত হয়। তেমনই কনে দেখা আলোয় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েকে ধবধবে ফরসা বলে নাকি 'গছিয়ে' দেওয়া হতো আগেকার দিনে। পাত্রপক্ষও খাওয়াদাওয়া করে পাওনাগণ্ডার মোহে যেন একটু রিল্যাক্সড মুডে তখন।টাকার কাছে মেয়ের গাত্রবর্ণ তো নস্যি! তবে পণপ্রথা উঠে যাওয়ার পর এসব আর দেখা যায় না মনে হয়।।
এবার একটু ব্রতকথায় আসা যাক। মিললে মিলতে পারে অমূল্যরতন! 'ধন-গছান-ব্রত' বলে একটি ব্রত ছিল আগেকার দিনে। ব্রাহ্মণকে কিছু নগদ অর্থ দিতে হতে এই ব্রতের নিয়ম অনুসারে। পরজন্মে যেন ধনপ্রাপ্তি হয়, সেই আশা নিয়েই এই ব্রত করত গৃহস্থ মহিলারা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, 'পরজন্মে ধনপ্রাপ্তির আশায় ব্রাহ্মণকে ধনদানরূপ স্ত্রীলোকের ব্রতবিশেষ'। পুরুষের সাহচর্য ছাড়া অবশ্য এই ব্রত করা সম্ভব ছিল না। বলাই বাহুল্য সব পুরোহিতের খিদে সমান নয়। কেউ কেউ অল্পে সন্তুষ্ট হলে কী হয়, কেউ কেউ বিরাট পরিমাণ অর্থ হাঁকত। তা দেখে তিতিবিরক্ত ব্রতকারী মহিলারা পরে ব্রাহ্মণদের অসাক্ষাতে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত 'অনেক টাকা গছান্ গেল'। তা থেকেই ক্রমে ক্রমে অনেক টাকা গচ্ছা গেল, বা মোটা টাকা গচ্চা গেল, লবজটির উৎপত্তি হয়।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ধন-গছান-ব্রতের মতো আর একটি ব্রতের কথাও উল্লেখ করেছেন। সেটি হল, 'ফল-গছান ব্রত'। এই ব্রতে ধনের জায়গায় ব্রাহ্মণকে ফলদান করতে হয় পরের জন্মে সুফল লাভের আশায়। 'কলিকাতার ইতিবৃত্ত' বইয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত আগেকার দিনের ব্রতপার্বণের উল্লেখ করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, 'বালিকাদিগেরও অনেকগুলি ব্রত আছে, তন্মধ্যে কয়েকটী উল্লেখ করিলামঃ– ঋতু পূজা, গোকাল গাভী পূজা, ফল গছান, ধন গছান, সেঁজুতী ব্রত, পুণ্য পুকুর, যমপুকুর, নখচুল প্রভৃতি।' তবে বালিকা অর্থে তিনি সব মেয়েদেরই বোঝাতে চেয়েছেন, মনে হয়।
ছেলে জয়েন্টে চান্স না পেলে অনেককে বলতে শুনেছি, 'শুধু শুধু দু'বছরের কোচিংয়ে মোটা টাকা গচ্চা গেল।' এমনকী, কোনও ডাক্তারের অধীনে থেকে রোগ না সারলে ডাক্তার পাল্টিয়ে অন্য ডাক্তারের চেম্বারে এসে রোগী সক্ষোভে বলেন, 'ওঁকে এক বছর দেখিয়েও কোনও রেজাল্ট পাচ্ছি না, শুধু শুধু টাকাগুলো গচ্চা গেল।'
সামনে বসা ডাক্তারের মুখে তখন একটা ম্লান হাসি দেখা দিয়েও মিলিয়ে যায়। 'ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে' বলে একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ে।