মহিলাদের চুলেই ছিল পাচারের রাস্তা! কোথা থেকে এল 'খোঁপা' শব্দটি
ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় খোঁপা শব্দটি দ্রাবিড় উত্তরাধিকার বহন করছে।
এবারের শব্দ খোঁপা। মহিলাদের কেশসজ্জার এই শৌখিন বিষয় নিয়ে কিছু লেখা অনধিকার চর্চা নয় বলেই মনে হয়। বিশেষত লেখাটি যদি হয় শব্দের ব্যুৎপত্তি-বিষয়ক।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ খোঁপা শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [হি খোং(খো)পা; ঠ খোংপা; তু 'খোফা'; 'খোম্ফা'(অপ্র); F-Coiffe, L- Cofia, E-Coif– a covering for the head,worn by women]। তবে হিন্দি(হি) ও মারাঠি(ঠ)-তে কোথা থেকে এসেছে খোঁপা, সে-বিষয়ে হরিচরণ নীরব। সংস্কৃত তথা তৎসম কি না, সেটা এখানে পরিষ্কার নয়। ফ্রেঞ্চ ল্যাটিন, ইংরেজি ভাষার প্রায় সমোচ্চারিত শব্দগুলি থেকেও এসেছে বলে মনে হয় না।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ খোঁপা শব্দটির ব্যুৎপত্তি আছে, '[ক্ষুপ শব্দজ]'। ক্ষুপ তৎসম শব্দ, অর্থ ঝোঁপ বা গুল্ম। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে জুতসই উদ্ধৃতিও আছে। 'কপালে টিপের ফোঁটা, খোঁপা বাঁধা চুল'। স্পষ্টতই উপমাবোধাত্মক ব্যুৎপত্তি, কল্পনার মিশেলও দিয়েছেন অভিধানকার। 'বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান'-এ খোঁপার ব্যুৎপত্তিতে শুধুমাত্র লেখা হয়েছে, বাংলা শব্দ। এর বেশি কিছু বলা নেই।
আরও পড়ুন: বাঙালির জিভে জল আসে ‘হেঁশেল’ শুনলেই! শব্দের উৎস জানলে চমকে উঠতে হবে
জামিল চৌধুরী সম্পাদিত 'বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'-এ ব্যুৎপত্তি আছে, [স ক্ষুপ]। প্রয়োগ উদাহরণ আছে বড়ু চন্ডীদাস থেকে। 'লবঙ্গ দোলঙ্গ খোঁপা বান্ধিআ উল্লাসে'। জীবনানন্দ দাশের ১৯৩২-এ লেখা কবিতা থেকেও উদ্ধৃতি আছে, 'তাদের খোঁপার ফাঁস খুলে যায়'। মিস্টিক জীবনানন্দের পক্ষেই এসব পঙক্তি লেখা সম্ভব।
নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ-এ পাচ্ছি, খোঁপা(খোপা) দেশজ শব্দ। অর্থ, কেশগুচ্ছ, ধমিল্ল। সুকুমার সেন লিখেছেন সংস্কৃত 'ক্ষপেক' থেকে খোঁপা শব্দটি এসেছে। অর্থ, কোথাও কোনও কিছু লেগে থাকা বা এঁটেসেঁটে থাকা। তবে সুকুমারবাবু সবকিছুর মধ্যেই যে সংস্কৃতের প্রেত আবিষ্কার করেছেন, তা তাঁর লেখা 'বাংলা স্থাননাম' বইটি পড়লেই বোঝা যায়।
সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ পাই, খোঁপা 'বাংলা প্রচলিত' শব্দ। ইংরেজি Coiffure এর সঙ্গে সাদৃশ্য টেনেছেন। যদিও ইংরেজি শব্দটি চুলের আবরণী বোঝায়, কেশবিন্যাস বোঝায় না।
রাজশেখর বসুর চলন্তিকা-য় শুধু আছে, খোঁপা মানে কবরী। ব্যুৎপত্তি দেননি পরশুরাম। সংসদ বাংলা অভিধানে জানানো হয়েছে, খোঁপা এসেছে মধ্যযুগীয় বাংলা খোম্পা থেকে। অশোক মুখোপাধ্যায়ের সমার্থ শব্দকোষ-ও দেখতে হয়। সেখানে খোঁপা এন্ট্রিতে আছে, 'খোঁপা, কবরী, ধম্মিল, ধমিল্ল, যুক্তবেণী; ধুড়বুড়ি; ধুদ্ধুড়ি; এলোখোঁপা; চুড়ো খোঁপা, টপনট; কানড় খোঁপা, কানড়, কানড়া; ডোনাট।'
এই কানড় খোঁপা জিনিসটি কী, সেটা দেখতে গিয়ে সংসদ বাংলা অভিধান ঘাঁটতে হল। 'কানড়' সম্বন্ধে লেখা হয়েছে, ' স্ত্রীলোকের কেশবিন্যাসবিশেষ, কর্ণাটকপ্রদেশের প্রসিদ্ধ কুণ্ডলাকৃতি খোঁপা'। এসেছে সংস্কৃত 'কর্ণাট' থেকে'।
তাহলে কি খোঁপার সঙ্গে দক্ষিণী ভাষাগুলির যোগসূত্র আছে? দ্রাবিড় ভাষাগুলি থেকে বহু শব্দ বাংলায় এসেছে। আদতে বাঙালি দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-আর্য উত্তরাধিকার বহন করছে।
ড. সত্যনারায়ণ দাশ প্রণীত 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটিতে পেয়ে গেলাম অভীষ্ট সূত্র। সেখানে খোঁপা শব্দটিকে দ্রাবিড় ভাষা থেকে আগত বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে, [খোঁপা- বি. কেশবিন্যাস। কন্নড়. কোপ্পু, তামিল. কোপপু, খোপ।]। অর্থাৎ, কন্নড় ভাষায় কোপ্পু আর তামিল ভাষায় কোপপু বা খোপ বলা হয় খোঁপা তথা খোপাকে।
হিসেবটা মিলে গেল। খোঁপা বঙ্গে দক্ষিণী দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এসেছে। খোঁপায় ফুল গোঁজার দক্ষিণী কালচার সম্প্রতি তামিলনাড়ুর উটিতে গিয়ে দেখলাম। কোয়েম্বাটোর থেকে উটি যাওয়ার পথে সর্বত্র দেখেছি দক্ষিণী কায়দায় শাড়ি পরা মহিলারা খোঁপায় ফুল গুঁজে দিনের বেলায় ঘুরতে বেরিয়েছে। চা-পাতা থেকে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনের একটি ফ্যাক্টরির কর্মকাণ্ড দেখতে বিরাট লাইন পড়েছিল। অনেক তামিল, কন্নড় প্রবীণাও খোঁপায় ফুল গুঁজে সাধারণবেশে সেসব দেখতে এসেছেন। সংলগ্ন দোকানগুলিতে কেনাকাটাও করছেন কবরীনন্দিত হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমগ্র সাহিত্যকর্মে মোট বত্রিশবার খোঁপা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। 'ঘরে বাইরে'-র বিমলার আত্মকথা, নিখিলেশের আত্মকথা-য়, 'নৌকাডুবি' উপন্যাসে, 'গল্পগুচ্ছ'-র নষ্টনীড়, মানভঞ্জন গল্পে, বিচিত্র প্রবন্ধে, তিনি বারবার খোঁপা শব্দটি লিখে গেছেন। কবরী যে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল, সে তো আমরা জানিই।
ফিরিঙ্গি খোঁপা একসময় বঙ্গনারীদের প্রিয় কেশবিন্যাস ছিল। হুতোম থেকে বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবাই ফিরিঙ্গি খোঁপার কথা লিখে গিয়েছেন গল্পে-উপন্যাসে।
কত রকমের খোঁপা ছিল, সেটা আমার জানানোর বিষয় নয়, খোঁপার ব্যুৎপত্তি সঠিকভাবে নির্ণয় করাই আমার উদ্দেশ্য। এর জন্যে কিছু খোঁপা বিষয়ক ছড়ার খোঁজ নিতে হল। একটি ছড়া এরকম,
উলার মেয়ের কলকলানি
শান্তিপুরের চোপা
গুপ্তিপাড়ার হাতনাড়া
বাঘনাপাড়ার খোঁপা।
সুশীলকুমার দের 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে এর আর একটি ভার্সন আছে-
উলোর মেয়ের কুলুজি
অগ্রদ্বীপের খোঁপা
শান্তিপুরের হাতনাড়া
গুপ্তিপাড়ার চোপা।
তুলনায় নবীন স্বপ্না চক্রবর্তীর গাওয়া গানের আদি প্রবচন-রূপটি–
বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল
এমন খোঁপা বেঁধে দিব লক্ষ টাকা মূল।
তাঁর গানটির গীতিকার অবশ্য 'লক্ষ টাকা মূল'-এর জায়গায় আধুনিকতা আনার জন্যে 'লাল গাঁদাফুল' করে দিয়েছেন। বাংলা প্রবাদের আর একটি হলো, 'জামাই যে মরদ মেয়ের খোঁপাতেই পরিচয়'। অথবা, 'লাজে বউ খান খান, খোঁপার ভেতর মাছখান'। আর একটি প্রবাদ তো এখনও প্রাসঙ্গিক, ' সাজিয়াগুজিয়া রইলাম, খোঁপা টনটনিয়ে মইলাম (মরিলাম)'। এটাও মন্দ নয়, 'চুল নেই মেয়ে চুলেরে কাঁদে/ কচুপাতার ঢিপলে দিয়ে ডাগর খোঁপা বাঁধে।'
খোঁপা যে অতীতে জিনিস পাচারেও ব্যবহার করা হতো, প্রবাদগুলি পড়লেই বোঝা যায়। অনেক বাড়ির ড্রেসিং টেবিলেই ফলস খোঁপার গোলাকৃতি ভরাটি (বল) পাওয়া যাবে। লীলা মজুমদার তাঁর লেখা 'আর কোনোখানে' বইটিতে স্কুলে তাঁর খোঁপা নিয়ে ভোগান্তির কথা সবিস্তারে বর্ণনা দিয়েছেন। বারবার খুলে যেত তাঁর পগেয়া খোঁপা। শেষমেশ খোঁপাকে বিদায় জানাতে বাধ্য হন।
সাদা-কালো সিনেমার নায়িকাদের মাথার দিকে তাকালে খোঁপার ক্রমিক বিবর্তনের চেহারাটি ধরা যাবে। কাননবালা, সুপ্রিয়া দেবী, সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেনের খোঁপা বাঁধার স্টাইলের হেরফের আছে। এখনকার সিনেমায় নায়িকাদের খোঁপা দুর্লভ। সবই তো স্ট্রেট এখন! তবে দক্ষিণী নায়িকাদের মধ্যে বড় খোঁপা বাঁধার চল এখনও আছে। খোঁপায় ফুলও গোঁজেন তাঁরা।
মালাবার উপকূলে কয়েক শতাব্দী আগে নারীদের হাট বসত। দাসী-বাঁদি ও রক্ষিতা করা হতো এই সমস্ত দুর্ভাগা নারীকে। খোঁপা দেখে তাদের নির্বাচন করা হত। কেউ যেত বড়লোকের বাঁদি হয়, কেউ যেত গরিবের ঘরে।
খোঁপার সঙ্গে দক্ষিণী রাজ্যগুলির মহিলাদের নিবিড় যোগ আছে। ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় খোঁপা শব্দটি দ্রাবিড় উত্তরাধিকার বহন করছে।
'খোঁপার ওই গোলাপগুলি' কি সত্যিই শুকিয়ে যেতে বসেছে আজ?