'যার ধন তার ধন নয়...', কেন 'নেপোয় মারে দই'? অভিধান ঘেঁটে যে উত্তর পাওয়া যায়
বাংলা প্রবাদ 'যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই।' কোনও কোনও বইয়ে এটি 'নেপো মারে দই' হয়ে গেছে। তা, এই নেপো শব্দের অর্থ ও ব্যুৎপত্তি কী?
এবারের শব্দ নেপো। নেপো বললেই 'নেপোয় মারে দই' প্রবচনের কথা মনে আসে। পুরো প্রবাদটি হলো, 'যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই'। সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ের মতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ি সর্বপ্রথম এটির উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন,
আয়ান ঘোষ বিয়ে করলেন রাজকন্যা রাধা।
নন্দর বেটা কৃষ্ণ তাতে ভাগ বসালেন আধা।
আর শুনেছ দুখের কথা আর শুনেছ সই,
যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই।
এই পদ্যাংশ থেকেই এসেছে বাংলা প্রবাদ 'যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই।' কোনও কোনও বইয়ে এটি 'নেপো মারে দই' হয়ে গেছে। তা, এই নেপো শব্দের অর্থ ও ব্যুৎপত্তি কী?
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ নেপো শব্দের অর্থ 'রাজা' দেওয়া আছে। ব্যুৎপত্তি, নৃপ> নেপো (গ্রাম্য প্রয়োগ)। 'যার ধন তার ধন নয়, নেপো মারে দই' প্রবচনের উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, 'প্রজার শ্রমলব্ধ অর্থের ভাগ লইয়া রাজার সুখসমৃদ্ধি ভোগ হইতে?' স্বগতোক্তিমূলক জিজ্ঞাসায় তিনি বুঝিয়ে দেন তিনি নিজেই সন্দিগ্ধ এই ব্যাখ্যায়।
আরও পড়ুন: শিউলি মানে শুধু ফুল নয়, বিশেষ একটি পেশাও! অভিধানে দানা বাঁধে যে রহস্য
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' অভিধানে নেপো শব্দের এন্ট্রি নেই। কেন নেই, সেটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো তিনি 'নেপো' শব্দটিকে ভদ্রসমাজের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেননি। শব্দটিকে ইতরতাদোষে দুষ্ট ভেবে ব্রাত্য করে রেখেছেন।
সংসদ বাংলা অভিধানে নেপো-র অর্থ দেওয়া হয়েছে, 'অনধিকারী, ধূর্ত লোক, বাটপাড়'। শব্দটিকে দেশি বলে উল্লেখ করেছেন অভিধানকার। 'যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই' প্রবচনটির উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, 'যারা পরিশ্রম করে তারা পরিশ্রমের ফল ভোগ করে না, চালাক লোকে ফাঁকি দিয়ে সে ফল ভোগ করে।'
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির বিবর্তমূলক অভিধানে নেপো-র অর্থ আছে ধূর্ত ব্যক্তি। ব্যুৎপত্তি 'নৃপ' থেকে। সম্পাদক 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' থেকে থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, 'দালালি কাজটা ভাল, নেপো মারে দইয়ের মত এতে বিলক্ষণ গুড় আছে।'
সরল বাঙ্গালা অভিধানে নেপো-র অর্থ, ফাজিল, ধূর্ত ব্যক্তি, ডেঁপো। বাংলা প্রাদেশিক শব্দ বলা হয়েছে। ব্যুৎপত্তি দেননি অভিধানকার সুবলচন্দ্র মিত্র।
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে নেপো মানে 'অতিশয় ধূর্ত ব্যক্তি' লেখা হয়েছে। শব্দটিকে দেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবার কোনও কোনও লেখায় নেপো-কে নফর শব্দ থেকে আগত বলে দাবি করা হয়েছে। নফর মানে চাকর বা পরিচারক। আরবি থেকে এসেছে বাংলায়। চাকরের চুরিবিদ্যা থাকবেই, তার কোনও মানে নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের 'পুরাতন ভৃত্য' পড়লে তৎকালীন ভদ্দরলোক শ্রেণির মনোভাব বোঝা যায়। 'যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর'!
নৃপ থেকে না নফর থেকে না দেশি উৎস থেকে, কোথা থেকে যে নেপো-র আগমন, তা বোঝে কার সাধ্যি। তবু চেষ্টা তো একটা করতেই হয়! একটু তলিয়ে দেখাই যাক না! নেপো কী মারে? না, দই মারে। নেপো আর দই-য়ের মধ্যে সম্পর্ক কী? সেটা কোনও অভিধানেই কিন্তু খোলসা করে বলা হয়নি। দই যে ধনসম্পদের সমার্থক, এটাই সর্বত্র বোঝানো হয়েছে। দই ও দুধের সঙ্গে মিলিয়ে খোঁজাখুজি শুরু করলাম। কিছুটা ক্লু মিলল অভিধানেই।
'নিপান' বলে যে শব্দটি প্রায় সমস্ত অভিধানে আছে, তার অর্থ দুগ্ধদোহন পাত্র বা দুগ্ধভাণ্ড। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ নিপান শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়েছে,-' পশুপক্ষ্যাদির অনায়াসে জলপানের সুবিধার নিমিত্ত কূপসমীপে নির্মিত ক্ষুদ্র জলাশয়, চৌবাচ্চা; গো-দোহন-পাত্র, দুগ্ধভাণ্ড। ব্যুৎপত্তি –সং নি-পা (পান করা) +অনট্। বঙ্গীয় শব্দকোষে নিপান শব্দের অর্থ আছে, ১. 'পশুগণের জলপানার্থ কূপসমীপস্থ জলাধার, উপকূপজলাশয়, আহাব। ২. পুষ্করিণ্যাদি জলাশয় ৩. কূপ ৪. গোদোহনপাত্র।' ব্যুৎপত্তি একই।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে নিপান অর্থে আছে, ১. যেখানে পশু-পক্ষী সকল জলপান করে, কৃত্রিম জলিশয়, চৌবাচ্চা ২. দুগ্ধদোহন পাত্র, দুধের কেঁড়ে।সংসদ বাংলা অভিধানেও আছে, নিপান মানে যে পাত্রে দুধ দোহন করা হয়। ব্যুৎপত্তির ব্যাপারে সম্পাদক সুভাষ ভট্টাচার্যের মধ্যপন্থা লক্ষ করার মতো। তিনি নিপান-এর ব্যুৎপত্তি লিখেছেন, [বাং. নি + √পা + অন]। অর্থাৎ, সংস্কৃত থেকে নিপান শব্দটির আগমন নিয়ে তিনি সংশয়াচ্ছন্ন। তাই প্রথমে বাং তথা বাংলা বসিয়েছেন। অথচ এই সংশয়ের কোনও কারণই থাকত না, যদি তিনি বামন শিবরাও আপ্তের ''The Practical Sanskrit- English Dictionary '-টি উল্টেপাল্টে দেখতেন। নিপান শব্দটিকে খাঁটি সংস্কৃতের মর্যাদা দিয়ে এন্ট্রি রেখেছেন শ্রদ্ধেয় বামন শিবরাও আপ্তে। এখানে নিপান-এর অন্যতম অর্থ হল 'Milk Pail' বা দুগ্ধাধার। বামন শিবরাও আপ্তে যেখানে শব্দটিকে নিখাদ সংস্কৃত ধরছেন, সংসদ পঞ্চম সংস্করণের সম্পাদক সুভাষ ভট্টাচার্য সেটাকে বাংলা শব্দ ভেবেছেন! সংস্কৃতজ্ঞান প্রখর না হলে অভিধান সম্পাদনা করা দুরূহ কাজ।
নিপান কিন্তু অভিধানে রয়ে যাওয়া অপ্রচলিত শব্দ নয়। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে এর বিবর্তিত অর্থ হল, পাত্রবিশেষ। কবি আল মাহমুদের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি আছে, 'লাল রক্তে কাচের নিপান ভরে যায়'।
নিপান নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, নিপান নিয়ে যাদের কারবার, তাদের হদিশ পাওয়া। সেতার থেকে যেমন সেতারী, কুঠার থেকে যেমন কুঠারী, নিপান থেকে তেমনই নিপানী আসে। মানে দুগ্ধদোহক। নিপানী শব্দটির ব্যবহার এখন আছে কিনা জানি না। অতীতে দুগ্ধদোহকদের নিপানী বলা হতো কি না, বলা শক্ত। তবে নিপানী বলে স্থাননামের খোঁজ পেয়েছি। মহারাষ্ট্রের বেলগাঁও জেলায় নিপানী নামে একটি শহর আছে। এখানে গরুর বিরাট হাট বসত আগে। অনেকটা শোনপুরের হাটের মতো। নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ অভিধানে নিপানী শহরের উল্লেখ পাই। লেখা হয়েছে, 'এই স্থানে ব্যবসা বাণিজ্যের বিশেষ উন্নতি আছে। প্রত্যেক হাটের দিন ২।৩ সহস্র গোমহিষাদি বিক্রয়ার্থ আনীত হয়।' গরু-মোষের সঙ্গে গোয়ালাদের সরঞ্জাম থাকতেই পারে সে হাটে। যথা, জাবনা খাওয়ার গামলা, জালা, হালচাষের লাঙ্গল, মই, দড়ি, দুধ দোওয়ার কেঁড়ে, বালতি ইত্যাদি।
নিপানী মানে কিন্তু গোয়ালা বোঝায় না। দুগ্ধদোহন যাদের কাজ তারাই নিপানী। জাতে গোয়ালা নয়, অথচ দুধ দুয়ে দেয়, এমন লোক অনেক দেখা যায়। মাহিষ্য-কৈবর্ত-জেলে-মালো বাড়ির মহিলা-পুরুষরাও দুধ নিজেরাই দুয়ে নেয়। অর্থাৎ, নিপানী এক শ্রেণির মানুষ, যাদের পেশা দুধ দুয়ে দেওয়া।
নিপানী-রা সৎ হতে পারে, অসৎও হতে পারে। নিপানী শব্দটিই অপভ্রংশে নেপো হয়ে গেছে। গৃহস্থের দুধদই কিছুটা আত্মসাৎ করার প্রবণতা নিপানী তথা নেপোদের মধ্যে কারও কারও থাকতেই পারে। দুধ বা দইয়ের কেঁড়ে নিয়ে প্রসন্ন গোয়ালিনীর মতো কেউ কেউ ছলনাময়ী হয়ে উঠতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তর যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন প্রসন্ন গোয়ালিনীদের হাতটানের কথা।
এইভাবেই কি দুধ বা দইয়ের কারবারিদের সঙ্গে গোধন-সম্পদের হরণের সম্পর্ক স্থাপিত হলো? রাজা কেন দই চুরি করতে যাবে, সেটা থেকেই এই আলোচনার শুরু। রাজারা কস্মিনকালে দুধ-ছানা-দই চুরি করত কিনা জানি না। এও জানি না রাজারা গোধন বা গরু চুরি করত কিনা। তবে নেপো বা দুধদুইয়েরা দুধ-দই-ননী-ক্ষীর সরাতেই পারে। তাদের পেশার সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ। গোস্বামী গৃহস্থের হকের দুধ বা দই নিঃশব্দে তারা সরিয়ে ফেললে কাকপক্ষীতেও টের পায় না! অস্যার্থ, নৃপ বা রাজা নয়, নফর বা চাকর-বাকর নয়, নিপানী বা দুগ্ধদোহক তথা নেপোরাই দই-দুধ মারতে সক্ষম।