চেনা বামুনের লাগে না, কোথা থেকে এসেছে 'পৈতে' শব্দটি?
Bengali Vocabulary: চেনা বামুনের যে পইতার দরকার নেই, তা সকলেই জানি, তবে চেনা শব্দের পইতার দরকার আছে কি?
এবারের শব্দ পৈতা বা 'পইতা'। কথ্যভাষায় 'পইতে'। ব্রাহ্মণ তথা দ্বিজের এই বিশেষ চিহ্নটি নিয়েও যে অভিধানে মতভেদ থাকতে পারে তা অনেকেরই কল্পনার বাইরে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ পাওয়া যাচ্ছে,– পইতা, পৈতা বি [ সং পবিত্র > প্রা পইত্ত > বা পইতা, পৈতা। অর্থ, উপবীত। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ পাচ্ছি,– পইতা, পৈতা [ সং পবিত্রা > পবিতা(সূত্র)>] বি, উপবীত, যজ্ঞসূত্র, যজ্ঞোপবীত। চেনা বামুনের যে পইতার দরকার নেই, তা সকলেই জানি, তবে চেনা শব্দের পইতার দরকার আছে কি না, সে-বিষয়ে তর্কের অবকাশ আছে।
গোলাম মুরশিদ সংকলিত বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে পইতার ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [ সং উপবীত >]। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ১৬০০ সালের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, "অঙ্গদ কঙ্কণ সাপ, সাপের পইতা।" সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধানে পাই, পইতা, পৈতা–[ উপবীত>], দেশজ, সংস্কৃত।
সংসদ বাংলা অভিধানে ব্যুৎপত্তি পাচ্ছি, [সং. পবিত্র(=উপবীত)]। অর্থাৎ সংসদ অভিধানের সংকলকের বিখ্যাত মধ্যপন্থা এখানেও দেখা যাচ্ছে। পবিত্র থেকে, না উপবীত থেকে, কোথা থেকে পইতা আসছে, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে না পেরে তিনি শব্দদুটিকে এক পঙক্তিতে নিয়ে এসেছেন। এক সূত্রে গেঁথেছেন। তাতে যে ভবি ভোলার নয়, তা তিনি বোঝেননি।
আরও পড়ুন: ‘লালঝুঁটি কাকাতুয়া’ শুনলেই মনে পড়ে ছোটবেলা, ‘ঝুঁটি’ আদৌ বাংলা শব্দ?
তবে পবিত্র না উপবীত, তানিয়ে মতান্তর থাকলেও সিংহভাগ অভিধানই 'পবিত্র' শব্দটির পক্ষে। যেমন রাজশেখর বসুর চলন্তিকা, জামিল চৌধুরী সংকলিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান। সুশীলকুমার দে-র বাংলা প্রবাদ বইটিতে পৈতা নিয়ে যে প্রবাদগুলি আছে, তা হলো যথাক্রমে ১. চেনা বামুনের আবার পৈতা ২. দেখাও পৈতা, মার ভাত ৩. পৈতা থাকলেই বামুন হয় না ৪. পৈতে পুড়িয়ে ভগবান্, বা পৈতে পুড়িয়ে সন্ন্যাসী (দণ্ডী সন্ন্যাসী হইলে যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করিতে হয়)।
লেখক দাশু রায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, 'পৈতে পুড়িয়ে হয়েছি ভগবান্'। পবিত্র শব্দটি থেকে পৈতা/পইতা আসার সম্ভাবনা কতটা ভাবতে গিয়ে মনে প্রশ্ন জাগবেই। পবিত্র একটি বিশেষণ পদ, পইতা বিশেষ্য। তাহলে কি পরপদ কিছু ছিল অতীতে? পবিত্রর পর যদি সূত্র বা সুতা থাকত, তাহলে পৈতাসুতো বলে একটি শব্দও থাকত আমাদের বাংলা ভোকাবুলারিতে। সেটাও তো কাউকে বলতে বা লিখতে দেখিনি। আর পবিত্র তো অনেক কিছুই। বিদ্যাস্থান, দেবস্থান, সবই তো পবিত্র। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা, সবই পবিত্র বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভক্তদের কাছে। শুধু এক খণ্ড সুতোই বা পবিত্রতার ধারক ও বাহক হবে কেন?
উপবীত শব্দটিও খুব সহজভাবে আসেনি। মূলে কথাটি ছিল যজ্ঞোপবীত। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধান উপবীত এন্ট্রিতে লিখেছে, ১. [উপ-বী(গমন করা) + ত(র্ত্তৃ)] বিণ, যজ্ঞোপবীত দ্বারা সংস্কৃত, যার যজ্ঞোপবীত হইয়াছে। ২.বি যজ্ঞসূত্র, পৈতা [দ্রঃ- "অখণ্ড অদিতি বা সূর্য্যপথ। ইহা সূর্য্যকে বেষ্টন করিয়া আছে। সূর্য্য যখন পুরাতন পথ সমাপ্ত করিয়া নূতন পথ ধরেন, তাঁহার নূতন উদয় হয়। ইহা রাখীপূর্ণিমার উৎসবের কারণ। এইদিন হরির নূতন যজ্ঞোপবীত ধারণ হয়। তাহারই অনুকরণে লোক আগামী বর্ষে বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য রক্ষাসূত্র হাতে পরে]।
বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে, "উপবীত ক্লী[উপ + √বী +ত(ক্ত)-ক; উপ+√ব্যে + ত–শ্রুতৌ উপব্যয়তে ইতি শ্রবণাৎ; ছান্দস]। বঙ্গীয় শব্দকোষে আরও পাই, "[ উপবীত— ব্যাসবিন্যাসবিশেষ, (তদ্ধর্মতাহেতু) যজ্ঞসূত্র। শ্রৌত ও স্মার্ত্ত কর্মে দুই গ্রন্থি উপবীত এবং উত্তরীয়াভাবে এক গ্রন্থিধারণের বিধি আছে। বিপ্রের কার্পাসসূত্রের, ক্ষত্রিয়ের শণসূত্রের, ও বৈশ্যের মেষলোমের উপবীত বিধেয়(মনু)। উপবীত গ্রন্থিত্রয়যুক্ত।"
তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথমে কথাটি ছিল 'যজ্ঞোপবীত'। তা থেকেই ক্রমে ক্রমে উপবীত এসেছে। এইসব জটিল রাস্তা ছাড়া আর কোনও সরলতর রাস্তায় পৈতা বা পইতা এসেছে কিনা ভাবতে গিয়ে কয়েকটি অভিধান ঘেঁটে দেখতে হল। সংসদ বাংলা অভিধানে পরিবৃতি ও পরিবৃত শব্দদুটি দেখতে পাওয়া গেল। পরিবৃত শব্দটিকে গড়পড়তা সকলেই চিনি, এটি বিশেষণ পদ। 'পরিবৃতি' তার বিশেষ্যরূপ হলেও কম ব্যবহারহেতু অচেনা ঠেকে। সংসদে পরিবৃতির অর্থ আছে, সম্যক বেষ্টন। পরিবৃত মানে যে সম্যক পরিবেষ্টিত, তা আমরা জানি। শত্রুসৈন্য-পরিবৃত একাকী যোদ্ধা, শ্যালক-শ্যালিকা পরিবৃত জামাইবাবু, চেড়িপরিবৃত সীতা, সবই আমাদের দেখা।
জ্ঞানেন্দ্রমোহনে 'পরিবৃতি'-র এন্ট্রি দেওয়া হয়েছে, '[পরি- বৃ(আবরণ করা) + তি] বি, বেষ্টন; পরিধি চতুর্দিকের বেড়া]। বঙ্গীয় শব্দকোষে পরিবৃতির অর্থ আছে, পরিবেষ্টন। পইতা তো উপনয়নপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণসন্তানের গলাকে পরিবেষ্টন করেই ঝুলতে থাকে। তাহলে পরিবৃতি থেকেই কি পইতা তথা পৈতা এসেছে?পরিবৃতি > পইবিতি > পইতি > পইতা > পইতে।
এটা লিখে ফেলা সহজ, কিন্তু প্রমাণ করা সহজ নয়। একগাছা সুতো বা একটি যজ্ঞসূত্র গলায় ঝুললেই তো আর তাকে পইতা বলে ডাকা যাবে না, তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা বা দৈবীভাব আসবে কোথা থেকে?দেখতে হলো, বামন শিবরাম আপ্তের 'The Practical Sanskrit-english Dictionary'। এখানে পরিবৃতি-র অর্থ আছে, Surrounding। বেদে যে 'পরিবৃতং' শব্দটির ব্যবহার আছে, তাও বলা হয়েছে। অর্থ, Surrounded place for sacrifice। অর্থাৎ, গলাকে বা দেহকে পরিবেষ্টন করে যে মন্ত্রপূত সূত্র ঝোলে, তা-ই পরিবৃতি তথা পৈতা বা পইতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যে দশবার পইতা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বিসর্জন বা রাজর্ষি নাটকে রঘুপতি বারবার পইতা স্পর্শ করে, ক্রুদ্ধ স্বরে কথা বলছেন, এ দৃশ্য বারেবারে আছে। জীবনস্মৃতির হিমালয়পর্বে তিনি যে পইতার পর বাবার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন, তাও আমরা জানি। গোরা, নৌকাডুবিতেও আছে পইতার উল্লেখ।
বৈদিক যুগে মেয়েদেরও পইতা হতো। গার্গী, লোপামুদ্রা প্রমুখ নারীঋষি ছিলেন বলে বৈদিক যুগে মেয়েদের পইতার প্রথার পালে বাতাস লেগেছিল। পৌরাণিক যুগে ক্রমশ মেয়েদের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হতে লাগল। লৌকিকে এসে তো মেয়েদের পইতাকে অলৌকিক বলেই মনে হয়। যদিও আমরা জানি দক্ষিণভারতে নাকি এখনও মেয়েদের পইতা হওয়ার চল আছে। জানি না তারা নিয়মিত আহ্নিক করে কিনা, অমাবস্যা-পূর্ণিমায় খাওয়াদাওয়ার বিধিনিষেধ মেনে চলে কিনা। একটা বছর খুব কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় উপনয়ন তথা পইতার পরে।
মেয়েদের বেদ পাঠ নিষিদ্ধ করে, গায়ত্রীমন্ত্র জপের অধিকার হরণ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মাথারা তাদের একঘরে করে রেখেছিলেন। এবার নারীশক্তি আস্তে আস্তে জাগ্রত হচ্ছে। বৈদিকমতে বিবাহ যখন শুরু হয়ে গেছে, বৈদিকমতে মেয়েদের উপনয়ন বা পইতা হওয়াও আটকানো যাবে না। তবে উপনয়ন ধারণ করার মত সাবেক কাজ আজকালকার মেয়েরা করবে কিনা বলা শক্ত। হয়তো অন্য কোনও ফর্মে ট্রেন্ডি, মিনিয়েচার পইতে বাজারে আসবে।
যাই হোক, পইতা শব্দটির উৎসে ফেরা যাক। পবিত্র, উপবীত-এর মতো প্রচলিত ব্যুৎপত্তি ছাড়াও বস্তুগত ব্যুৎপত্তি যে সম্ভবপর, তা 'পরিবৃতি' শব্দটির মধ্যে নিহিত আছে। এটি সম্পূর্ণভাবে আমার নিজস্ব মতামত। আপন মনের জল্পনাকল্পনার ফসল। এর মধ্যে সারবস্তু থাকলে গ্রহণ করা যেতে পারে। যদি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা মানতে না চান, নির্দ্বিধায় মতটি বর্জন করতে পারেন। নতমস্তকে মেনে নেব।