আসল মানে আমগাছ, যেভাবে স্ল্যাং হয়ে উঠল 'চূত' শব্দটি
মূর্খার্থে 'চুতিয়া' শব্দটির গোড়া খুঁজলে আম বা গৃহদ্বারের সঙ্গে ক্ষীণ সংযোগসূত্র পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে গৃহদ্বারের রক্ষীরা কেউ কেউ একটু বোকা হতো। তাদের ধোঁকা দিয়ে তস্করমশাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাজ হাশিল করে বেরিয়ে যেত।
আজকের শব্দ 'চূত'। মানে আম বা আমগাছ। যদিও আরও কয়েকটি অপ্রচলিত অর্থ আছে শব্দটির। সংসদ বাংলা অভিধানে 'চূত'-এর ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [ সং.√চুৎ + অ(দীর্ঘ-ঊ)]। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ চূত-এর ব্যুৎপত্তি এরকম, [চূষ(চুষা) + ত(র্ম্ম )]। আম বা আমগাছ অর্থে এই ব্যুৎপত্তি। আবার ব্যুৎপত্তি যখন [চুত্(ক্ষরণে) + অ(অপা°], তখন এর অর্থ প্রসবদ্বার। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' জানাচ্ছে, চূত শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল, [√চুৎ ক্ষরণ + অ (ক)-ক, দীর্ঘ (অ-টী)]। চূতক, চূতমঞ্জরী, চূতলতা, চূতকোরক, চূতাঙ্কুরস্বাদ, চূতপোত, চূতবিকার, চূতপল্লবিত ঘট ইত্যাকার শব্দ ও শব্দবন্ধও উল্লিখিত হয়েছে বিভিন্ন অভিধানে।
সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গালা অভিধান'-এ (বর্তমান সংস্করণের নাম 'সরল বাঙ্গালা অভিধান') 'চূত' শব্দটির ব্যুৎপত্তি হরেদরে একইরকম, তবে প্রাগুক্ত অর্থগুলি ছাড়াও একটি অর্থ আছে। সেটি হল 'গৃহদ্বার', অর্থাৎ বাড়ির মূল দরজা। তেমনই নগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত বিশ্বকোষ-এ একটি অতিরিক্ত অর্থ আছে, মলদ্বার।
এ তো গেল ব্যুৎপত্তিবিষয়ক গৌরচন্দ্রিকা। আমরা আধুনিক সময়ের লোকজন 'চূত' শব্দটি বলছি না কেন? কেনই বা ভুলে মেরে দিলাম চূত-কে? বস্তুত আম ছাড়া বাঙালি আর কোনও প্রতিশব্দই আজকাল ব্যবহার করে না। আম্র, রসাল, সহকার, মাকন্দ, আঁব- কে কে কবে কোথায় আর ব্যবহার করছে! শুধু তৎসম আম্রকুঞ্জ, আম্রকানন, আম্রপালী লিখতে গেলে আম্র-র ডাক পড়ে। চূত-র কোনও অর্ধতৎসম বা তদ্ভব রূপ চোখেই পড়ে না।
আরও পড়ুন: ধর্মতলা আসলে এসেছে ‘দ্রুম’ শব্দটি থেকে? জেনে নিন, আসলে কী অর্থ
অথচ রামায়ণে, কালিদাসের রচনায়, বৌদ্ধ সাহিত্যে আম-অর্থে চূত-ই মূলত ব্যবহৃত হতো, আম্র অনেক পরে এসেছে। তাহলে কি চূত শব্দটি উবে গেল? না কি যৌনগন্ধবাহী সমোচ্চারিত একটি শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল? বাঙালির ভোকাবুলারি থেকে শ্লীল চূত-কে বিদায় দিয়ে স্ল্যাং 'চুত' শব্দটির মৌরসিপাট্টা শুরু হল? না কি কোথাও কোথাও শালীন অর্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে এর তদ্ভব বা অপভ্রংশ-প্রাপ্ত রূপ?
চূতীয়া (চুতিয়া) শব্দটিকে বাঙালি স্ল্যাং হিসেবেই ধরে। কিন্তু হিন্দি অভিধানে 'চূতীয়া' (অবিকল এই বানান) শব্দের অর্থ মূর্খ বা বোকা। বাঙালি 'চূতীয়া' বা 'চুতিয়া' যে প্রাবল্য ও আক্রোশের সঙ্গে উচ্চারণ করে, তাতে মূর্খ অর্থ ছাড়িয়ে অনেক গভীরে তার বিস্তার ঘটে। হিন্দি শব্দকোষ জানাচ্ছে, চ্যুত বা পতিত থেকে চূতীয়া। বুদ্ধিচ্যুত, জ্ঞানচ্যুত হলেই লোকে 'চূতীয়া'। অন্তত হিন্দি অভিধানে 'চূতীয়া' শব্দটি শালীন।
বাংলা অভিধানগুলির মধ্যে একমাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ চুতিয়া শব্দটি দেখতে পাচ্ছি। একটি অর্থ মূর্খ, এসেছে হিন্দি 'চূতীয়া' থেকে, আর একটি অর্থ লোহা পেটানোর হাতুড়ি।
মূর্খার্থে 'চুতিয়া' শব্দটির গোড়া খুঁজলে আম বা গৃহদ্বারের সঙ্গে ক্ষীণ সংযোগসূত্র পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে গৃহদ্বারের রক্ষীরা কেউ কেউ একটু বোকা হতো। তাদের ধোঁকা দিয়ে তস্করমশাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাজ হাশিল করে বেরিয়ে যেত। তা থেকেই 'চূতীয়া'-র অর্থ মূর্খ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ যে 'চূতীয়া' শব্দটি ব্যবহৃত হতো দ্বাররক্ষী বোঝাতে, সেই শব্দেরই মানে বদলে গিয়ে মূর্খ হয়ে গেল। আবার, আমগাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে গোলা লোক গাছের ডাল থেকে পড়ে গিয়ে মূর্খের তকমা পেতে পারে আমজনতার কাছে। মূর্খ কালিদাসের মতো কেউ যে আমগাছের ডালে বসেই ডালের গোড়াটি কাটছিল না, তা কে বলতে পারে! তাই চূত থেকে হিন্দি ও বাংলা চূতীয়া (চুতিয়া) শব্দ আসার সম্ভাবনা আছে। অসমের একটি প্রাচীন অঞ্চলের নাম চুতিয়া। জানি না, এটি আমের কারবারিদের স্বর্গরাজ্য ছিল কিনা।
'চুদুরবুদুর' শব্দটি একসময় চারদিকে বেশ শোরগোল ফেলেছিল। বাংলাদেশ থেকে ভারতে এর ঢেউ এসে পৌঁছেছিল। ত্রিপুরার আগরতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার বিভাগীয় প্রধান নির্মল দাস শব্দটিকে গ্রাম্য, শালীন তকমা দিয়েছিলেন। শব্দটি শ্লীল না অশ্লীল, সে নিয়ে পণ্ডিত ও বিদ্বজ্জনমহলে ব্যাপক তর্কবিতর্ক দেখা গিয়েছিল সেসময়। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসা হয়েছিল, শব্দটি মোটেও অশ্লীল নয়, রীতিমতো শালীন, তবে শব্দটি গ্রাম্য। ভাষাবিদরা কিন্তু শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেননি। অনার্য শব্দ এটি, মাত্র এটুকুই জানিয়েছিলেন।
আমি অনেক খোঁজ নিয়েছি শব্দটির উৎস সম্বন্ধে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদিত 'আঞ্চলিক ভাষার অভিধান'-এ শব্দটির অর্থ আছে– বাড়াবাড়ি, গড়িমসি। এক ধরনের খেলাও আছে চুদুরবুদুর নামে। বস্তুত টালবাহানা করা, উল্টোপাল্টা বকা, এদিক-সেদিক করা, ধানাইপানাই করা-কে আমরা এ-বঙ্গে 'চুদুরবুদুর করা' বলি। সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের 'হারবার্ট' উপন্যাসে শব্দটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে।
চূত মানে যেমন আম, বদর মানে কুল। সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে, চূতঃ + বদরং= চূতর্বদরং, বাংলায় 'চূতর্বদর'। মানে, আমের মধ্যে থাকা কুল। আম একটি গ্রীষ্মকালীন ফল, কুল শীতকালীন। আম আকারে বড়, কুল ছোট। আম মূলত মিষ্ট স্বাদের, আর কুল অম্লতার দ্যোতক। তাই ফলদুটি পরস্পর বিপরীতধর্মী। কবি সুকুমার রায় আবোলতাবোল-এ লিখেছেন, 'আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে/ কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।'
উল্টোপাল্টা কথা বলা, দীর্ঘসূত্রিতা করা, টালবাহানা করা অর্থে 'চূতর্বদর করা' বোঝাত। চূতর্বদর থেকে অপভ্রংশে চুদুরবুদুর হয়ে গেছে। বস্তুত এটি একটি কৃষিভিত্তিক প্রবচন। মানুষের কথা বলার বিভিন্ন ভঙ্গি বোঝাতে অনেকগুলি বাংলা প্রবচন আছে। লক্ষণীয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি-দু'টি ফল বা ফসলের নাম থাকে এই ধরনের প্রবচনে। যথা, আমড়াগাছি করা, খেজুরে আলাপ করা, তিলকে তাল করা, ধানাইপানাই করা, তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা, মুখে খই ফোটা ইত্যাদি। এই গোত্রেরই প্রবচন 'চূতর্বদর করা' বা 'চুদুরবুদুর করা'।
সংস্কৃত বা তৎসম বাংলা থেকে একটি ব্যুৎপত্তি তো পাওয়া গেল, অস্ট্রিক বা দ্রাবিড় থেকে কিছু আসতে পারে কি? অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস সংকলিত 'সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান'-এ চুদুরবুদুর শব্দটি নেই। আবার ড. সত্যনারায়ণ দাশ বিরচিত 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইটিতেও 'চুদুরবুদুর' শব্দটি নেই। তাই চুদুরবুদুর শব্দটি অনার্য ভাষা থেকে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তবে সাঁওতাল বা মুন্ডাসমাজে 'চদর বদর' বলে একটি পুতুল খেলা প্রচলিত আছে। এখনও পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূমে খেলাটি টিকে আছে। যদিও কলাকুশলীর অভাবে খেলাটি অস্তিত্বের সংকটে। এই চদরবদর-ও কিন্তু সাঁওতালি বা মুন্ডারি ভাষা থেকে আসেনি। বাংলা 'চাদর বাঁধনী'-ই নাকি লোকমুখের অপভ্রংশে চদরবদর, এটাই বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। এর সঙ্গে চুদুরবুদুর করার কোনও মিল খুঁজতে যাওয়া অনাবশ্যক।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' অভিধানে চূতমঞ্জরী নিয়ে একটি অজানা তথ্য আছে। 'কবিপ্রসিদ্ধি যে, চূত স্ত্রীগীতে বিকসিত হয়; স্ত্রীগীত ইহার দোহদ' (বানান অপরিবর্তিত)। অর্থাৎ আগেকার দিনে আমের মঞ্জরী বা মুকুল না এলে স্ত্রীলোকের দল গান গাইত আমবাগানে। আমের মুকুল আনার দোহদ (সাধভক্ষণ) নাকি ছিল নারীকণ্ঠের সংগীত। এই রুদালিজাতীয় কর্মকাণ্ডের কোনও সাক্ষী আর আছে কি না জানি না, তবে প্রথাটি পরিবর্তিত অবস্থায় এখনও থাকতে পারে কোথাও কোথাও। এই চূতরমণীদের কোনও বিবরণ কোনও লেখায় পাইনি আমি, 'চূতরমণী' শব্দটিও অন্তর্জলিযাত্রায়। হয়তো কোনও প্রাকৃত রূপ ধারণ করে শব্দটি আমাদের ভোকাবুলারিতে স্বমহিমায় বিরাজ করছে।