কেন পাথুরিয়াঘাটা মানে 'বেশ্যাদের ঘাট'? অভিধানে লুকিয়ে যে রহস্য

গবেষক-লেখক রাধারমণ মিত্র তাঁর 'কলিকাতা দর্পণ' বইয়ে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটকে বেশ্যা বা গণিকাদের ঘাট বলে চিহ্নিত করেছেন। অতীতে এইঘাটে নাকি বেবুশ্যে রমণীদের সমাগম ঘটত খরিদ্দারের আশায়।

এবারের শব্দ 'পাথ'। কয়েকটি অভিধানে এই শব্দটির স্থান হয়েছে পাথঃ বা পাথস্ হিসেবে। তবে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান', নগেন্দ্রনাথ বসুর 'বিশ্বকোষ' আর সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গালা অভিধান'-এ 'পাথ' হিসেবেই এন্ট্রি আছে। বলা বাহুল্য, পাথ মানে জল। অম্বু, উদক, নীর, বারি-র সঙ্গে পাথও উচ্চারিত হওয়া উচিত।

'বিশ্বকোষ' অভিধানে 'পাথ' শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেওয়া আছে, [√পাতীতি পা-থুট, নিপাতনাৎ সাধুঃ]। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'আদর্শ বাঙ্গালা অভিধান'-এ (প্রথম প্রকাশ- ১৯২৬) পাথ ও পাথঃ, দু'টি শব্দেরই দেখা পাচ্ছি, অর্থ জল। পাথ-এর ব্যুৎপত্তি হল, [সং. √পা(পান করা) + থ র্ম্ম।]। কিন্তু এই অভিধানেরই হালফিলের সংস্করণ 'সরল বাঙ্গালা অভিধান' থেকে শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন, তা জানি না। সম্পাদকের খেয়াল বলে বিষয়টিকে লঘু করা যায় না। বাংলা ভাষা কারও খেলার সামগ্রী নয়। ইচ্ছেমতো রাখলাম আর বাদ দিলাম, এটা অবিমৃশ্যকারী কাজ। সংসদ বাংলা অভিধানে পাথ বা পাথস্, কোনওটাই নেই।

অভিধানকে আকারে ছিমছাম করতে গিয়ে বাংলা ভাষার অঙ্গহানি করাটা কি সমীচীন?

আরও পড়ুন: আসল মানে আমগাছ, যেভাবে স্ল‍্যাং হয়ে উঠল ‘চূত’ শব্দটি

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ পাথঃ (পাথস্) শব্দটির দেখা মেলে, পাথ নেই। যদিও অর্থ একই। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ পাথ না থাকলেও এটা জলের মতো পরিষ্কার যে, কোনও এক সময় পাথ শব্দটি মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চালু শব্দ ছিল এটি।

পাথঃ থেকে অনেক সমাসবদ্ধ পদ এসেছে। যথা পাথোজ (পদ্ম), পাথোরুহ (পদ্ম), পাথোদ (মেঘ), পাথার (সাগর), পাথিস (সাগর), পাথোধর (মেঘ), পাথোধি (সমুদ্র), পাথোনিধি (সমুদ্র)।
সংস্কৃত সাহিত্যে পাথস্-এর ব্যবহার থাকলেও বাংলা সাহিত্যে পাথ শব্দটির ব্যবহার প্রায় নেই বললেই হয়। কোন পথে এবং কেনই বা পাথ-এর নিষ্ক্রমণ ঘটল, তা বোঝা দুষ্কর। জল এসেই যেন বাঙালির সবকিছু জলবৎতরলং করে দিয়েছে। অম্বু, উদক, বারি, নীর-ই বা বলছি কোথায়! তবে পাথ-এর কোনও অর্ধতৎসম বা তদ্ভব রূপ হয়তো আছে বহমান বাংলা ভাষায়, আমরাই ধরতে পারছি না। পাথজাত কতিপয় শব্দের অস্তিত্বও থাকতে পারে।

কয়েকটি সম্ভাব্য শব্দ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

পাতকূয়া, পাতকুয়ো বা পাতকো– যাই বলে ডাকা হোক না কেন, সমস্ত অভিধানেই পোড়া মাটির পাট বা বেড়ির কথা বলা হয়েছে। হরিচরণ যেমন লিখেছেন, '[পাটকূয়া> পাতকূয়া], মাটির পাটে পাশবাঁধা ছোট কূয়া।' জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লিখেছেন, 'পাত (পৎ>)= পাতাল + কুয়া (কূপ)]'। জল সংগ্রহের নিমিত্ত পাতালপ্রবেশ করাতেও অভিধানকাররা পিছপা হননি!

কূপ, কূয়া, কুয়া, কুয়ো, ইঁদারা, যা বলেই ডাকা হোক না কেন, এর ব্যবহার ছিল নানাবিধ। জল তোলা ছাড়াও মূল্যবান ধনরত্ন রাখার জন্য, মানুষকে গুম করার জন্য, কূপ বা কুয়োর ব্যবহার ছিল অতীতে। অন্ধকূপ বলে বিশেষ কূয়ায় ফেলে মানুষকে হত্যা করত অত্যাচারী শাসকরা। পাথ বা জল সংগ্রহের জন্য যে কূয়া (কুয়ো) খনন করা হতো, তাকে বলা হত 'পাথকূয়া'। পাথকূয়া থেকেই যে লোকমুখে পাতকুয়ো বা পাতকো হয়ে গেছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

'পাথি' শব্দটিও পাথ বা জলের চিহ্ন বহন করছে। ছোট চুপড়িকে পাথি (চলিত বাংলায় পেতে) বলে। বঙ্গীয় শব্দকোষে আছে, [সং পাত্রী > প্রা পত্তী > বা পাতী, -তি, -থি]। আমার মনে হয়, পাথ থেকে পাথী হয়ে পরে পাথি তথা পেতে এসেছে। এই ধরনের, বাঁশ বা তলতার চেড়ি দিয়ে তৈরি আধার রান্নাঘরে ব্যস্ত বউঠাকরুনদের অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। আনাজ বা মাছ, যাই হোক না কেন, এই আধারে নিয়ে জলে ধোওয়ার রেওয়াজ সুদূর অতীত থেকেই আছে। আগেকার দিনে পুকুরের ঘাটে ধোওয়া হত, এখন ট্যাপ বা চাপাকলের জলে। জলের সংস্পর্শে আসতেই হতো পাথী তথা পাথি বা পেতে-কে। পাথের সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই পাত্র নয়, পাথ থেকেই পাথি আসার সম্ভাবনা বেশি।

'পাথুরিয়া' শব্দটি শুনলেই যেন পাথরে পাথরে ঘষাঘষি শুরু হয় মনের মধ্যে। সমস্ত অভিধানেই 'পাথর+ইয়া' ভেবে পাথরিয়া তথা পাথুরিয়া শব্দটি আনা হয়েছে। পাথুরিয়া বা পাথুরে মানে যে প্রস্তরনির্মিত, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস আর একটি অর্থও দিয়েছেন 'পাথুরিয়া'-র। তিনি লিখেছেন, 'উত্তরাখণ্ডী হিন্দীভাষায় পাতর (পতিতা=বেশ্যা)+ইআ, ঈআ(স্বার্থে)–পাতরিয়া, পাতরীয়া] কাঞ্চনী, গণিকা, বেশ্যা। (পতিতা অহল্যার পাষানী হওয়ায় বেশ্যা=পাষানী=পাথুরিয়া=পাতর?)।'


এই সূত্র ধরেই গবেষক-লেখক রাধারমণ মিত্র তাঁর 'কলিকাতা দর্পণ' বইয়ে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটকে বেশ্যা বা গণিকাদের ঘাট বলে চিহ্নিত করেছেন। অতীতে এইঘাটে নাকি বেবুশ্যে রমণীদের সমাগম ঘটত খরিদ্দারের আশায়। সত্যি না মিথ্যে, সেটা অবশ্য জানি না।

'পাথুরিয়া' শব্দটির এই দ্বিতীয় অর্থটি দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস একটি উপকার করেছেন, তৃতীয় অর্থের খোঁজেও আমি তল্লাশি শুরু করেছিলাম একসময়। সমধর্মী আরও কিছু শব্দ খুঁজেছিলাম প্রথমে। এই গোত্রের আরও কিছু শব্দ হল, কাঠুরিয়া, সাপুড়িয়া, হাটুরিয়া। শব্দগুলির অর্থ যথাক্রমে কাঠ, সাপ ও হাটের দ্রব্য বিক্রয় করা যাদের পেশা। সাপুড়িয়ারা অবশ্য সাপখেলা দেখিয়েও অর্থ উপার্জন করে।

সংসদ বাংলা অভিধানে কাঠুরিয়ার(কাঠুরে) ব্যুৎপত্তি লেখা হয়েছে, [বাং. কাঠ + উরিয়া, উরে]। অনুরূপভাবে আমরা যদি (পাথ + উরিয়া= পাথুরিয়া) ভাবি, তাহলে কোনও ক্ষতি নেই। অর্থাৎ পাথ বা জলের ব্যবসায়ীদের পাথুরিয়া বলা যাবে।

সত্যিই প্রাচীন কলকাতায় গঙ্গাজল বেচে বড়লোক হয়েছিলেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে সেরা ছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠ। তিনি তো আবার গঙ্গাজল কলসিতে ভরে প্যাক করে নিজস্ব সিলমোহর লাগিয়ে বাংলার বাইরে রপ্তানি করতেন। যেসব প্রদেশে গঙ্গা বহমান নয়, অর্থাৎ, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে তাঁর গঙ্গাজল পৌঁছে যেত মন্দিরে মন্দিরে। দ্বারকার সোমনাথ মন্দির ও তেলেঙ্গানার কালিকা মন্দিরে তাঁর গঙ্গাজলের কলসি পৌঁছে যেত। তিনি এই ব্যবসায় টু-পাইস কামিয়ে কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন। পাথুরিয়া বা জলের কারবারিরা গঙ্গার উক্ত ঘাটটি ব্যবহার করত বলে 'পাথুরিয়াঘাটা' নামটি হয়েছিল কি না তা অতি অবশ্যই ভাবতে হবে।

উড়িয়া বেহারা তথা ভারীরা একসময় দৈনন্দিন প্রয়োজনের গঙ্গাজল বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিত। সেই হিসেবে তারাও এক ধরনের পাথুরিয়া। টালার পাম্প চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত এই পেশা রমরম করে চলত। এখন এর রেওয়াজ কমে গেলেও পুরনো বহুতল বিল্ডিংয়ের ওপরের তলাগুলোয় জলের জোগানের জন্য পাথুরিয়াদের ডাক পড়ে। পাথুরিয়া বলে একটি গোষ্ঠী সত্যিই এখনও টিকে আছে ওড়িশায়। তাদের কাজ এখন ইট কাটা। জলের বাহকরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারীর কাজ ছেড়ে জল দিয়ে মাটি মেখে কাদা করছে, আর ছাঁচে ইট কাটছে। জলের ক্যানেস্তারাগুলোকে এখন এভাবেই কাজে লাগাচ্ছে তারা। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটেও জলের ব্যবসায়ীদের চিহ্ন সুনিশ্চিতভাবেই আছে।

তবে এ বঙ্গে জলের ব্যবসায়ী বা জলের ভারী অর্থে পাথুরিয়া শব্দটির কোনও অপভ্রংশের ব্যবহার এখনও আছে কি না, সে-ব্যাপারে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি। সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে একটি প্রবাদ আছে, 'হু হু-জ্বরা, কুড়ে পাথরা।' যদি এমন অর্থ করা যায়, ক্রমাগত জল ঘেঁটে ঘেঁটে বৃদ্ধ অশক্ত কোনও জলের ভারীর মাঝে মাঝেই কাঁপ দিয়ে জ্বর আসে, তাই অলস ও ফাঁকিবাজ হয়ে পড়ছে নিজের কাজের ক্ষেত্রে, তাহলে খুব একটা ভুল হবে কি? পাথুরিয়াকে তাহলে পাথরা বলা হতো এক সময়? কে জানে! উত্তর কলকাতার কোনও প্রাচীন পরিবারে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। মহর্ষি দ্বারকানাথ ঠাকুরের পত্নী, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরমা দিগম্বরী দেবী সাতসকালে সাত ঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করতেন প্রতিদিন। সেই জল গঙ্গার ঘাট থেকে তুলে আনত পাথুরিয়া তথা পাথরা-রা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জলরাখার চৌবাচ্চাগুলি এখনও দেখতে পাওয়া যাবে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পাথরপ্রতিমা জায়গাটির নামেও আছে সময়ের জলছবি। পাথরের মূর্তির জন্যে পাথরপ্রতিমা, এটাই অনেকে বলেন। কিন্তু যদি বলা যায়, বর্ষায় বা বন্যার সময় সমুদ্রের রূপ ধারণ করে বলেই জায়গাটিকে কেউ 'পাথারপ্রতিম' বলে ডেকেছিল, তা থেকেই লোকমুখে পাথরপ্রতিমা হয়ে গেছে, খুব একটা ভুল হবে না।

উথালপাথাল, উথলপাথল– যাইই বলা হোক না কেন, শব্দটির অব্যবহিত পরে ঢেউয়ের অনুষঙ্গ এসে পড়ে। প্রাচীন কাব্যে পাই, 'উথলপাথল হল সপ্তসিন্ধুজল'। উথালপাথাল-এর পাথাল অংশটি নিশ্চিতভাবেই 'পাথ' থেকে জাত।

মোদ্দা কথা, কলাপাতায় মুড়ে জলীয় বাষ্পের 'ভাপে' রান্না করা ইলিশ বা ভেটকির 'পাতুরি' পাতা থেকে এসেছে, না পাথ থেকে এসেছে, সে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কিছু বাংলা শব্দের মূলে যে 'পাথ' শব্দটি, তা আমাদের মানতেই হবে।

More Articles