বাউল শব্দ কি এসেছে 'বাউন্ডুলে' থেকে? অভিধানে যে উত্তর রয়েছে

বাউন্ডুলে বা বাউণ্ডুলে, বানান যাই-ই লেখা হোক না কেন, তা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেই লেখা উচিত। শব্দের আলোচনায় ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যায় মাঝে মাঝে।

আজকের শব্দ বাউণ্ডুলে/বাউন্ডুলে। সংসদ বাংলা অভিধানে বানান 'বাউন্ডুলে' থাকলেও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ 'বাউণ্ডুলে' আছে। অর্থাৎ, প্রথম অভিধানে শব্দটিকে দেশি ভেবে বাউন্ডুলে ও শেষোক্ত দু'টি অভিধানে তদ্ভব ভেবে 'বাউণ্ডুলে' লেখা হয়েছে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বাউণ্ডুলে-কে সংস্কৃত থেকে জাত শব্দ ভেবেছেন। তবে ব্যুৎপত্তি একটু কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেন, [সং=বাত> বাউ। বাতগুল্ম(বাতুল) + ইয়া (সাদৃশ্যার্থে)> বাতগুল্মিয়া> ভ্রং বাতণ্ডুলিয়া> গ্রাম্য উচ্চারণবিকারে বাউণ্ডুলিয়া ইত্যাদি ]। অনেক কসরত করে তৎসম বাতগুল্ম থেকে বাউণ্ডুলে এনেছেন তদ্ভব রূপে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ আর এককাঠি সরেস। এখানে মূল জায়গায় (ব-বর্গে) বাদ পড়ে গেছে বাউণ্ডুলে। বাউণ্ডুলের স্থান হয়েছে পরিশিষ্টে। হয়তো হরিচরণ সংস্কৃত-ঘেঁষা ভাবেননি বলে শব্দটিকে ব্রাত্য করে রেখেছিলেন প্রথমদিকে। তারপর একটু সংস্কৃত টাচ দিয়ে বাউণ্ডুলেকে জাতে তুলে পরিশিষ্টে আশ্রয় দিয়েছেন। বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুযায়ী শব্দটির ব্যুৎপত্তি, [বাহিণ্ড্ (বি- √আহিণ্ড্)—মূল(?)]। গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা থেকে উদ্ধৃৃতি দিয়েছেন, 'হ্যাঁ খোকা ঠাকুর-পো, চিরকাল বাউণ্ডুলেগিরি করে বেড়াবে?'

আরও পড়ুন: কেন পাথুরিয়াঘাটা মানে ‘বেশ্যাদের ঘাট’? অভিধানে লুকিয়ে যে রহস্য

সংসদ বাংলা অভিধানে শব্দটিকে দেশি বলে চালানো হয়েছে। ব্যুৎপত্তির কথাই ওঠে না তাই। দেশি ভেবেই 'ণ' পরিহার করে 'ন' লেখা হয়েছে বানানবিধি অনুসারে।সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান', রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা'-য় বাউণ্ডুলে শব্দটি নেই। নেই ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রণীত 'বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান'-এও। তাহলে এই প্রশ্ন উঠবেই, শব্দটি দেশি (অস্ট্রিক/দ্রাবিড়), না সংস্কৃত-জাত? ড. সত্যনারায়ণ দাশের লেখা 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ' বইয়ে বাউণ্ডুলে শব্দটি নেই। সুতরাং, বাউণ্ডুলে দ্রাবিড় থেকে বাংলায় আসেনি। এই শব্দটিকে অস্ট্রিকও বলা যায় না। কেননা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্-র আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে শব্দটির এন্ট্রি নেই। অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস সংকলিত সমশব্দ অভিধানেও নেই, অন্তত আমি খুঁজে পাইনি।

এবার বাউণ্ডুলে-র কতকগুলি সমার্থক শব্দের খোঁজ করা যাক। ভবঘুরে, বেটো, বখাটে, বিশ্ববখাটে ইত্যাদি শব্দের কথা আমরা জানি বাউণ্ডুলের প্রতিশব্দ হিসেবে। 'ভব' মানে পৃথিবী বা ইহলোক। ভবঘুরে-র আক্ষরিক অর্থ, পৃথিবী চষে ফেলার মানসিকতার লোক। ইংরেজিতে বলে Globe trotter। এরকম লোককে আমরা বাউণ্ডুলে-র তকমাও দিই। সোজা কথায় বলা যায়, বাউণ্ডুলের পায়ের তলায় সরষে।

বিশ্ববখাটের ভাবটাও একইরকমের। টো-টো কোম্পানি, বখাটে, বিশ্ববখাটে, বাউণ্ডুলে, বোহেমিয়ান শব্দগুলি প্রায় একই গোত্রের। বাউণ্ডুলে/বাউন্ডুলে কোনও বিদেশি ভাষা থেকেও আসেনি। আরবি-ফারসি-বাংলা অভিধানে কাছাকাছি উচ্চারণ ও অর্থের শব্দের দেখা মেলেনি। তাহলে কি বাউণ্ডুলের আর কোনও মূল আছে? বিশেষত, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জিজ্ঞাসাচিহ্ন ভাষাবিদদের অন্য সোর্সের কথা ভাবতে প্ররোচিত করে।

ভব (পৃথিবী), বিশ্ব- এই শব্দগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ হল ব্রহ্মাণ্ড। ব্রহ্ম, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী, ব্রহ্মাণী শব্দগুলির অপভ্রংশ আমরা জানি। ব্রহ্মদৈত্য যে বেম্মদত্যি হয়, সেটাই বাঙালি জানে। ব্রাহ্মণ হয়ে যায় 'বাউন'। ব্রাহ্মণী এবং ব্রহ্মাণী হযে যায় 'বাউনি'। ব্রহ্মাণ্ড-র সঙ্গে সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় 'ল' যোগ করে ব্রহ্মাণ্ডল আসে। যেমন শীত + ল = শীতল, হাত + ল= হাতল, মাংস + ল= মাংসল, কুশ + ল= কুশল, মৃদু + ল= মৃদুল। অর্থাৎ, ব্রহ্মাণ্ডের গলিঘুঁজি যে চিনতে চায়, সেখানে ঘুরে বেড়াতে চায়, সে-ই ব্রহ্মাণ্ডল মানসিকতার বলে পরিগণিত হতে পারে। ব্রহ্মাণ্ডল থেকে অপভ্রংশে ব্রহ্মাণ্ডুলে আসে। ব্রাহ্মণ শব্দটি যেমন তদ্ভবে বাউন হয়ে পড়ে, ব্রহ্মাণ্ডুলে তেমনিভাবে 'বাউণ্ডুলে' বা 'বাউন্ডুলে' হয়ে যাবে। ভবঘুরে, বিশ্ববখাটে, বাউণ্ডুলে, সব একই গোত্রের শব্দ, অর্থও প্রায় একই।

এবার দেখতে হবে, বাউণ্ডুলে শব্দটি বাউণ্ডুলে-তেই রয়ে গেল, না কি তার আরও অপভ্রংশ চলতে লাগল ভাষার বহমান স্রোতে। একটি অভিমত আছে, বাউল শব্দের ব্যুৎপত্তি নাকি বাউণ্ডুলে থেকে। আমি নিজেও এটা বিশ্বাস করি। যদিও প্রথাগত ব্যুৎপত্তি হলো, বাতুল থেকে বাউল। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে পড়েছিলাম সাহিত্যিক সুধীর চক্রবর্তীর লেখা বই 'বাউলফকির কথা'। সেখানে বাতুল থেকে বাউল আসার তত্ত্বকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যদিও ব্যাকুল, বায়ুল ইত্যাদি আরও কয়েকটি মূল শব্দের কথা আছে, যা থেকে বাউলের আগমন ঘটতে পারে। তবে সেখানে বাউণ্ডুলে তত্ত্ব নেই।

শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একটি বাউলবিষয়ক প্রবন্ধে লিখেছেন, বাতুল থেকে বাউল আসাটা যদি মানতে হয়, তবে মাতুল থেকে মাউল হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি। তাছাড়া বাউল-অর্থে বাতুল শব্দটির প্রয়োগের লিখিত কোনও নিদর্শন নেই। এই লেখাটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি বছর কুড়ি আগে একটি প্রবন্ধে বাউণ্ডুলে থেকে বাউল আসতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলাম। কারণ, পরিব্রাজক বা ভবঘুরে-বাউণ্ডুলের ভিক্ষা যেমন মাধুকরী বা মাদগিরি, বাউলের ক্ষুন্নিবৃত্তিও হয় মাধুকরী থেকে। ভবঘুরে-বাউণ্ডুলের চলাই জীবন, বাউলেরও তাই। চরৈবতি, চরৈবতি– এটাই যেন তার মূল মন্ত্র। তাই বাউণ্ডুলে থেকেই বাউল আসার সমূহ সম্ভাবনা।

পরবর্তীকালে ২০০৮-এ ইংরেজ লেখিকা Jeanne Openshaw তাঁর লেখা 'Seeking Bauls of Bengal' বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এই বইটিতে বাউলদের জীবনযাপনের সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন তিনি। কাকতালীয়ভাবে তাঁর দেওয়া বাউল শব্দের ব্যুৎপত্তিতে বাংলা শব্দ 'বাউণ্ডুলে' থেকেই বাউল আসার জোরালো সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। 'বিশ্ববাউল' কথাটিও আছে সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ 'বাদলবাউল' শব্দটির সৃষ্টি করে গেছেন। পায়ের তলায় সরষে, মনে আধ্যাত্মিক ভাব, হাতে একতারা-দোতারা-ডুবকি, মুখে দেহতত্ত্বের গান, বাউলের এই চিরায়ত ছবিটির মধ্যে ভবঘুরে তথা বাউণ্ডুলে-ভাব লুকিয়ে আছে।

বানান বাউণ্ডুলে হোক বা বাউন্ডুলে-ই হোক, তার চলার যেন শেষ নেই। চরৈবেতি, চরৈবেতি। বাংলায় আর একটি শব্দ 'বুল' বা 'বুলা' মানেও ভ্রমণ করা। বুল-এর ব্যুৎপত্তি, [ সং √ব্রজ্ > প্রাকৃত > বাংলা বুল]। বুলা= সর্ম্ম [বুল + আ]। অথবা [সং √গম্ > প্রাকৃত > বাংলা বুল]। বুলা মানে যে ভ্রমণ করা, ঘুরেফিরে বেড়ানো, এটা অনেকেরই অজানা। কথা বলা বা বুলির সঙ্গেই যেন বুলাকে একাত্ম করে নিয়েছে বাঙালি। অতীতে কিন্তু ভ্রমণার্থে 'বুলা' শব্দটির ব্যবহার ছিল। 'চৈতন্যভাগবত'-এ আছে, "ঘরে ঘরে বুলে প্রভু"। বা "আপ্তগণে রক্ষিয়া বুলেন নিরন্তর"। 'চৈতন্যচরিতামৃত'-তে আছে, "হাটে হাটে বুলে"। মনে হয় পাঁচশো বছর আগে চৈতন্যদেবের সময় 'বুলা' শব্দটির ব্যবহার ছিল লোকমুখে।

বাউল আর বুলা-র মধ্যে ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে। বাঙালির পদবি যেমন বাউল হয়, বাঙালির নামও হয় বুলা, বুলে। সাঁতারু বুলা চৌধুরীকে কে না চেনে। ছেলেবেলায় পাড়ার খেলার বন্ধুদের অনেকেরই ডাকনাম ছিল 'বুলে'। বুলু ডাকনাম মেয়েদের মধ্যে খুব চলত। আর বছর পঁচিশ-তিরিশ আগে পরিবার-পরিকল্পনার বিজ্ঞাপনে জনৈকা বুলাদি তো খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। সেই বুলাদি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন, তা 'দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা।'

বাউন্ডুলে বা বাউণ্ডুলে, বানান যাই-ই লেখা হোক না কেন, তা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেই লেখা উচিত। শব্দের আলোচনায় ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাকে শিবের গীত না বলে শব্দের গীতও বলা যায়।

More Articles