বাঙালির জিভে জল আসে 'হেঁশেল' শুনলেই! শব্দের উৎস জানলে চমকে উঠতে হবে

'হেঁশেল' শব্দটি এল কোথা থেকে?

এবারের শব্দ 'হেঁশেল'। বাঙালির হেঁশেলে উঁকি দিলেই দেখা যায় রন্ধনপটিয়সীদের নানাবিধ কর্মকাণ্ড। কুটনো কোটা থেকে হাঁড়িতে বা প্রেসার কুকারে কিছু রান্না করা, ভাতের ফ্যান গালা, কাঁচা মাছমাংসের সদ্গতি করা, সবই চলে সেখানে। রান্নার সুগন্ধে ম ম করে চারপাশ।

তা, এই 'হেঁশেল' শব্দটি এল কোথা থেকে?

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালাভাষার অভিধান'-এ হেঁশেল (হেঁসেল) শব্দের ব্যুৎপত্তি দেওয়া আছে, [হাঁড়িশাল> হাঁসিয়াল> হেঁসেল। পূর্ববঙ্গীয় প্রাদেশিক উচ্চারণে হাসিয়াল, -লী]।

কৌতূহল হওয়ায় 'হাসিয়াল' শব্দটিরও খোঁজ নিতে হলো। হাসিয়াল-এর ব্যুৎপত্তি এবং হাসিয়াল থেকে হেঁশেল আসার দুরূহ পথ এখানে উদ্ধৃত করছি। পিলে চমকে ওঠার মতো সেই যাত্রাপথ।

আরও পড়ুন: গরম ফুলকো লুচি বানাতে অপরিহার্য, কিন্তু ‘ময়ান’ শব্দের আসল অর্থ কী? ফেল করেছে অভিধানও

হাসিয়াল, হাসিয়ালী, হাঁসিয়ালী- [ সং-হাণ্ডীশাল> হাঁড়িশাল> প্রাদে. হাঁড়শাল> (দ্রুত) হাঁশ্(ল্)শাল> হাঁ(হা)শি(সি)য়াল(লী)> ক্ষে. হেন্সেল> হাঁ(হা)শা(সা)ল্, হাঁস্যাল> হেঁসেল(হেঁশেল)]।

অতঃপর 'হাণ্ডী' শব্দটিও দেখতে হল। এখানেই রহস্য লুকিয়ে আছে। হাণ্ডী মানে যে হাঁড়ি, সেটা তো থাকবেই, কিন্তু হাণ্ডী থেকে আগত শব্দগুলির মধ্যে 'হাণ্ডীশাল' নেই! শুধুমাত্র 'হাণ্ডীয়ে' আছে। অথচ, তৎসম শব্দ হলে হাণ্ডীশাল শব্দটিও থাকার কথা।

আর একটি ব্যাপারও লক্ষণীয়। হাণ্ডীশাল শব্দটিকে সংস্কৃত বা বাংলা তৎসম বলে দাবি করা হলেও আমি বামন শিবরাম আপ্তের 'The Practical Sanskrit-English Dictionary'-তে দেবনাগরী হরফে 'হাণ্ডীশাল' খুঁজে পাইনি। সেখানে হণ্ডী ও হণ্ডিকা আছে। আসলে সংস্কৃত হণ্ডী থেকেই বাংলায় হাণ্ডী তথা হাঁড়ি এসেছে। আপ্তের অভিধানে হণ্ডী-র ইংরেজি অর্থ দেওয়া হয়েছে, 'Earthen pot'। তবে সেখানে হণ্ডী থাকলেও 'হণ্ডীশালা' শব্দটির দেখা মেলেনি।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ হেঁশেল এন্ট্রিতে আছে, দ্রষ্টব্য 'হানশেল'। তাই হানশেল শব্দটি দেখতেই হয়। সেখানেও জটিলতা। হানশা(শে)ল, হেঁশে(সে)ল, হেনশেল=বি ['হাণ্ডীশাল' মূল; ওড়িয়া হাণ্ডীশাল, হাসিয়ালী]। আবার বঙ্গীয় শব্দকোষেই 'হাঁস্যাল' এন্ট্রিতে আছে, [হাঁড়ীশাল > হাঁস্যাল]। মানে হেঁশেল। মনে হয়, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বিখ্যাত পাকশালা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হেঁশেল শব্দের মূলে 'হান্ডীশাল' শব্দটির কথা ভাবতে প্ররোচিত করেছিল। প্রতিদিন ছাপ্পান্ন ভোগ তৈরি করা কি যে সে রান্নাঘরে সম্ভব!

সংসদ বাংলা অভিধান জানাচ্ছে, হেঁশেল, হেঁসেল- বি. রান্নাঘর। [বাং. হাঁড়িশাল]। তবে ঢাকার 'বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান'-এ হেঁশেল শব্দের ব্যুৎপত্তিতে হাসিয়াল শব্দ থেকে হেঁশেল আসার কথা লেখা হয়েছে। হাণ্ডীশাল-এর কথা বলাই হয়নি। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ হেঁসেল (হেঁশেল) শব্দটিকে 'বাংলা প্রচলিত' হিসেবে দেগে দেওয়া হয়েছে। মূল শব্দ বলা হয়নি।

তাহলে কি হেঁশেল শব্দের আর কোনও ব্যুৎপত্তি হতে পারে? ভেবে দেখতেই হয়! অভিধান ঘাঁটা ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। কেউ কিছু লিখে যাননি এ-বিষয়ে।

হাসিয়াল শব্দটি যে হাণ্ডীশাল থেকে আসেনি, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এর কারণ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস অনেক কসরত করে তবেই হাণ্ডীশাল থেকে হাসিয়াল-এ উপনীত হয়েছেন। এটা কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়। বাংলাদেশের 'বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান'-এ হাণ্ডীশাল বা হাঁড়িশাল শব্দ থেকে নয়, হাসিয়াল থেকে হেঁশেল শব্দটি আসার কথা বলা হয়েছে। ওড়িশা থেকে অনেক দূরবর্তী হওয়ায় সেখানকার অভিধানপ্রণেতারা 'হাণ্ডীশাল' (ওড়িয়া) তত্ত্ব গ্রহণ করেননি। সুবলচন্দ্র মিত্রর অভিধানে তো হেঁশেলকে 'বাংলায় প্রচলিত' বলে দায় এড়ানো হয়েছে।

হাসিয়াল তথা হাঁসিয়াল শব্দটির আর কোনও ব্যুৎপত্তি হতে পারে কিনা খুঁজতে খুঁজতে 'হাঁসা' শব্দটি দেখলাম। হাস্য বা হাসাহাসি ছাড়াও (অশুদ্ধ প্রয়োগে) 'হাঁসা' শব্দটির অন্য একটি অর্থ আছে। হাঁসা মানে কাটা, গভীরভাবে কাটা, চিরে ফেলা। হাঁসানো মানে কেটে ফেলা বা বড় কিছুকে ছোট করে কেটে সমতা আনা। হাঁসুয়া বা হাঁসিয়া বা হেঁসো শব্দটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এটি কৃষিকার্যে ব্যবহৃত কর্তন বা কাটাকাটির একটি বিশেষ অস্ত্র। কাস্তের মতো বাঁকানো, তবে করাতের মতো দাঁত নেই, মসৃণ ও ধারালো, আকারেও বড়।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে হাঁসুয়া শব্দের আর একটি অর্থ দেওয়া হয়েছে, 'বঁটি'। বঁটি তো হেঁশেলের প্রধান একটি উপকরণ। জানি না, কোনও আধুনিকা রাঁধুনি বঁটিকে হাঁসুয়া বলেন কিনা। তবে ধারালো হাঁসুয়া দিয়ে দলিত পরিবারের মহিলাদের সবজি কাটতে দেখেছি অতীতে।

সংসদ বাংলা অভিধানে 'হাঁসা' শব্দের অর্থ হল, 'কাটা, গভীর করে চিরে ফেলা'। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় হাঁসা বা হাঁসানো শব্দের অন্যতম অর্থ দিয়েছেন, 'কাটা, ভাঙা। প্রয়োগ দেওয়া হয়েছে, 'ফুটী, তরমুজ হাঁসানো'। কিন্তু তাঁর ব্যুৎপত্তি বিভ্রান্তিকর। তিনি লিখেছেন, (ফাঁসা> হাঁসা)। এই ধারণা ঠিক হরিচরণোচিত নয়। আসলে হস্ ধাতু (বিকশিত হওয়া) থেকে হাঁসা এসেছে। হাসলে যেমন দন্ত বিকশিত হয়, কোনও কিছু কাটলেও তার ভেতরের অংশ বাইরে আসে, প্রকাশিত হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস আরও বিস্ময়ের অবতারণা করেছেন হাঁসিয়া (হাঁসুয়া) শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে। তিনি লিখেছেন, হংস থেকে হাঁসুয়া এসেছে। রাজহংসের গ্রীবার মতো বাঁকা বলে এহেন নাম। যা দিয়ে হাঁসানো (কাটা) হয়, তাই যে হাঁসিয়া বা হাঁসুয়া, তা তিনি ধরতে পারেননি। 'চলন্তিকা' অভিধানে আবার রাজশেখর বসু মহাশয় 'হাঁসা' শব্দের অর্থ দিয়েছেন, 'মূলত হেঁসো দিয়ে গভীরভাবে কাটা'।

আমার মনে হয়, একসময় 'হাঁসাশালা' বা 'হাঁসানশালা' বলে একটি শব্দ ছিল। এর অর্থ যেখানে বঁটি বা ছুরিতে তরিতরকারি ও মা়ছমাংস কেটে রন্ধনযোগ্য করে তোলা হয়। মূলত শাকসব্জি কোটার ব্যাপারগুলো হতো এখানে। আগেকার দিনে ঘোর বৈষ্ণবরা কুটনো কোটা বলত না। চিত্রা দেব 'ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল' বইয়ে লিখেছেন,

তখনকার দিনে এঁরা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুররা ব্যঙ্গ করে বলতেন, 'মেছুয়াবাজারের গোঁড়া'। পেঁয়াজ ঢুকত না বাড়িতে। মাছ-মাংসের তো কথাই নেই। পাছে কুটনো-কাটা বললে হিংস্র মনোভাব জেগে ওঠে তাই বলা হত 'তরকারি বানানো'।

আঁশবঁটি মানে মাছকাটার বঁটি। আকারে বড়সড় ও ভারী এই ধরনের বঁটি। আদতে এটি হাঁসবঁটি ছিল কিনা ভেবে দেখতে হবে। মানে এই বঁটিতে গভীরভাবে কোনও কিছু চেরা যায় বা কাটা যায়। তা, আমিষই হোক বা নিরামিষই হোক। আমিষবঁটি, আঁইসবঁটি কথাগুলি হয়তো পরবর্তীকালের আমদানি। মনে হয় গোঁড়া বোষ্টমরা আনাজ কাটা বা কোটা না বলে আনাজ হাঁসা, হাঁসানো বলা শুরু করেছিল।

এর সমর্থন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেও। 'গল্পগুচ্ছ'-র কর্মফল গল্পের এক জায়গায় একটি কথোপকথন পাচ্ছি,

সতীশ। ওগুলো আজকের মতো বার করে দিতে হবে। বিশেষত তোমার এই বঁটি-চুপড়ি-বারকোশগুলো কোথাও না লুকিয়ে রাখলে চলবে না।
জেঠাইমা। কেন বাবা, ওগুলোতে এত লজ্জা কিসের। তাদের বাড়িতে কি কুটনো কুটবার নিয়ম নেই।


অর্থাৎ, ঠাকুরবংশের জোড়াসাঁকো (জুনিয়র ব্রাঞ্চ) ও পাথুরিয়াঘাটার (সিনিয়ার ব্রাঞ্চ) বৈষ্ণব-শাক্ত দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লেখাপত্রেও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

হাঁসাশালা বা হাঁসানশালা শব্দটি অপভ্রংশে হাঁসশাল তথা হাঁসিয়াল তথা হ্যাঁশাল হয়ে গেল। হ্যাঁশাল থেকে হেঁশেল হতে একগ্রাস ভাত মুখে তুলতে যেটুকু সময় দরকার, ততটুকুও লাগে না।

তপন সিংহর 'গল্প হলেও সত্যি' সিনেমাটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা একান্নবর্তী পরিবারের হেঁশেলের চেহারাটি সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন। সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' ও 'অপরাজিত' সিনেমায় সর্বজয়ার হেঁশেলের করুণ কাহিনিও আমাদের জানা।শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের সেই টগর বোষ্টমীর কথা মনে পড়বেই। রেঙ্গুনগামী জাহাজে নন্দ মিস্ত্রির সঙ্গে তার কলহের নিখুঁত বিবরণ বিধৃত আছে এই বইয়ে। শ্রীকান্তকে শুনিয়ে শুনিয়ে টগর বলছে,

জাত-বোষ্টমের মেয়ে আমি, আমি হলুম কৈবত্তের পরিবার! কেন, কিসের দুঃখে? বিশ বচ্ছর একসঙ্গে ঘর করচি বটে, একদিনের তরে হেঁসেলে ঢুকতে দিয়েচি?

More Articles