ভাশুরের সামনে ঘোমটা টানাই নিয়ম! 'ভাদ্দরবউ' শব্দে কি লুকিয়ে অন্য কোনও অর্থ

Shobdogolpodrum: ভাদ্রবউ বা ভাদ্দরবউ-এর ব‍্যুৎপত্তি কোথায়?

এবারের আলোচ্য শব্দ 'ভাদ্দরবউ'। ভাশুর-ভাদ্দরবউ সম্পর্কের কথা কে না শুনেছে! আমাদের বর্তমান জননেতাদের অনেকের ভাষণের সঙ্গে সত্যের যে ভাশুর-ভাদ্দরবউ সম্পর্ক সেটা তো দিনের আলোর মতো সত্যি। তেমনই সত্যি পরীক্ষার রেজাল্টে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে অনেক পরীক্ষার্থীর অর্জিত প্রকৃত জ্ঞানের ভাশুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ ভাদ্রবধূ বিষয়ে লেখা হয়েছে- [সং-ভাতৃবধূ > গ্রা° ভাদ্দরবৌ, ভাদর-বৌ]। বি, কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী। সুবলচন্দ্র মিত্রর সরল বাঙ্গালা অভিধানে পাচ্ছি, ভাদ্রবধূ> ভাদ্দরবউ(বাংপ্র)। ভাতৃবধূর অপভ্রংশ বলে জানানো হয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ লিখছে,- ভাদ্রবধূ> ভাদ্দরবধূ।(দেশজ)। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত 'বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'-এ সংস্কৃত ভ্রাতৃবধূ থেকে ভাদ্রবধূ তথা ভাদ্দরবউ এসেছে বলে জানানো হয়েছে।সংসদ বাংলা অভিধান দিচ্ছে–ভ্রাতৃবধূ> ভাদ্দর বউ বা ভাদ্রবউ। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে পাই, - [স ভ্রাতৃবধূ> ভাদ্দর বউ]। চলন্তিকা দিচ্ছে- 'সং ভ্রাতৃবধূ থেকে ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দর বউ।' সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে 'ভাশুর-ভাদ্দরবউ সম্পর্ক' নিয়ে লেখা হয়েছে 'অর্থাৎ যেখানে সান্নিধ্যও আপত্তিজনক।'

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' গ্রন্থে একটু অন্য রাস্তায় হেঁটেছেন। ভাদ্দরবউয়ের ভাদ্দর= ভাতৃদার, অর্থাৎ কনিষ্ঠ ভাইয়ের স্ত্রী। ভাতৃদার তথা ভাদ্দর থেকেই নাকি ভাদ্রবধূর 'ভাদ্র' এসেছে। তার সঙ্গে 'বধূ' যুক্ত করা হয়েছে অতিরিক্ত উৎসাহে । প্রাকৃতভাষার সংস্কৃতায়নের মতো। ভাতৃজায়া থেকেই এসেছে ভাজ। এখানে কিন্তু ভাজবউ বলা হয় না। ভাজ বললেই যখন চলে যায়, তখন ভাজবউ খামোখা বলতে হবেই বা কেন! তেমনই ভাদ্দরবউ না বলে 'ভাদ্দর' বললেই তো চলত। তাই হরিচরণের ব্যাখ্যাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।

আরও পড়ুন: মহিলাদের চুলেই ছিল পাচারের রাস্তা! কোথা থেকে এল ‘খোঁপা’ শব্দটি

ভাশুর আর ভাদ্দরবউয়ের সম্পর্কে বরাবরই থাকে একটা দেওয়ালের ব্যবধান, একটা আড়াল যেন দরকার হয়। কখনও তা অন্দরমহলের পর্দা, কখনও তা ঘোমটার আবরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখায় এই ভাশুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে। 'শব্দতত্ত্ব'-এর অন্তর্গত 'ভাষার কথা'-য় লিখেছেন,

বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাশে, এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর-ভাদ্রবৌয়ের সম্পর্ক...।

এক জায়গায় লিখেছেন,

ভাষার দিক থেকে দেখলে তখন সাহিত্য ছিল ভাসুরের বৈঠক, ভাদ্রবৌ ঘোমটা টেনে তাকে দূরে বাঁচিয়ে চলত, তার জায়গা ছিল অন্দরমহলে।

'শব্দতত্ত্ব'-র আর এক জায়গায় লিখেছেন,

ইংরেজিতে বানানে উচ্চারণে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক, পরস্পরের মাঝখানে প্রাচীন শব্দতত্ত্বের লম্বা ঘোমটা।

ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দরবউ, যাই বলে ডাকা হোক না কেন, তার মাহাত্ম্য দেখা গেছে যুগে যুগে। বেশ উচ্চস্থান দেওয়া হয়েছে তাকে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে। 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এ যে প্রয়োগ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তা হলো,

(বেদব্যাস) ভাদ্রবধূ-সহবাস, করলেন কেমনে ভাই! (দাশরথি রায়ের পাঁচালি)

বা,

ও টাকা আমার ভাদ্রবধূ, আমি ও টাকা ছুঁই? (অমৃতগ্রন্থাবলী)

'বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'-এ (গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত) প্রয়োগের অন্য দৃষ্টান্ত আছে। ১৯৩১-এ কাজি নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 'ভাদ্দর বউকে ভাসুর সেবা করতে এলে...।' ১৯৩০-এ জীবনানন্দ দাশ লিখে গিয়েছেন, 'ভাসুর পীড়িত হলে অতএব ভাদ্রবৌকে দেখে বকে।' জীবনানন্দ অন্যত্র লিখেছেন, 'ভিখারীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ও ভাদ্রবৌ সকলেই নারাজ।'

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভাশুর আর ভাদ্রবউয়ের মাঝখানে সমাজ একটি গূঢ় ব্যবধান রচনা করেছিল ন্যায্য কারণে। একান্নবর্তী রক্ষণশীল পরিবারে কনিষ্ঠ ভ্রাতার নবোঢ়া পত্নীকে পরিবারের বয়স্ক লোকজনের কাছ থেকে যেন একটু লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল সমাজের নিয়ামক-বিধায়করা। তার একটি উপায় হলো, ভাতৃবধূর ওপর দেবীমহিমা আরোপ করা। তৎসম বাংলা 'ভদ্রা' শব্দটির অর্থ সাধ্বী, কল্যাণী, সুশীলা। সংস্কৃত সম্বোধনে ভদ্রে। কৃষ্ণের ভগিনীর নামও ভদ্রা, ভদ্রা কৃষ্ণের এক মহিষীর নামও। দুর্গার ভদ্রকালী রূপটিতেও ভদ্রার ছাপ। তাহলে কি ভাদ্দরবউ কথাটি আদতে ছিল 'ভদ্রাবধূ'? দেবত্ব আরোপ করে তাকে বাড়ির বয়স্ক পুরুষমানুষদের থেকে নিরাপদ অবস্থানে রাখার প্রচেষ্টা? ভদ্রাবধূ > ভদ্দরাবউ > ভাদ্দরবউ? এইভাবেই কি এল ভাদ্দরবউ? হতেও পারে। তত্ত্বটি আমার স্বকপোলকল্পিত হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়!

নগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত বিশ্বকোষ অভিধানে লেখা হয়েছে- 'ভাদ্রমাসের উভয়পক্ষের চতুর্থী তিথিতে চন্দ্র দর্শন করিতে নাই। দৈবাৎ যদি চন্দ্র দর্শন ঘটে, তাহা হইলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়।' মনে প্রশ্ন জাগে, ভাদ্রবধূর 'ভাদ্র' অংশটি কি তবে আদতে ভাদ্র-ই ছিল? আমাদের বিশিষ্ট অভিধানকাররা ভাতৃবধূ থেকে ভাদ্রবধূ এসেছে, এটা আগে থেকেই যেন ধরে নিয়েছেন। ভাদ্রমাসের কী কী বৈশিষ্ট্য আছে? এই মাসেই আছে নষ্টচন্দ্র অনুষ্ঠান। এই মাসেই আছে জন্মাষ্টমী। গণেশ চতুর্থীও আছে। নষ্টচন্দ্রের পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর 'হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান' বইয়ে।

এইদিন অর্থাৎ ভাদ্রমাসের চতুর্থী তিথিতে চন্দ্র তার গুরু বৃহস্পতির পত্নী তারা-র ওপর বলাৎকার করে ও গুরুপত্নীকে হরণ করে। সেইজন্য বৃহস্পতি অভিশাপ দেন, কেউ যেন এইদিন চন্দ্রের মুখদর্শন না করে। তাই এইদিন চন্দ্রদর্শন পাপ। উত্তর ভারতে একটি আলাদা কাহিনি শোনা যায়। এইদিন গণেশ চতুর্থী। সারাদিন ধরণীর গৃহে গৃহে পূজিত হয়ে গণেশ বাবাজীবনের মোদকভক্ষণ কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে যায়। সন্ধ্যায় একটু ফুরসত পেয়ে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। টলোমলো পায়ে হাঁটতে থাকা বেসামাল গণেশকে দেখে আকাশের চাঁদ নাকি খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাই দেখে গণেশ ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে চাঁদকে অভিশাপ দেন যে, ওইদিন অর্থাৎ ভাদ্রমাসের চতুর্থীতে কেউ চাঁদের মুখ দেখবে না। দেখলে মহাপাপী হবে। এহ বাহ্য। বৈষ্ণবদের কৃষ্ণকলঙ্কিনী নামে এক ব্রতও আছে এইদিন। নষ্টচন্দ্রের দিন চাঁদ দেখে ফেলার অপরাধে কৃষ্ণের নামে স্যমন্তক মণিহরণের অভিযোগ ওঠে। আবার রাধা এইদিন চাঁদ দেখে ফেলায় তার নামে কৃষ্ণের বাঁশি চুরির বদনাম রটে।

তাই ভাদ্রমাস অদর্শনের মাস। এইমাসে চতুর্থীর চাঁদ দেখা যেমন অপরাধ, ভাশুরের মুখ দেখাও সমমাত্রার অপরাধ। ভাশুরের আবার ভাতৃবধূর মুখ দেখা বারণ। ভাশুর-ভাদ্রবউয়ে চলে নিয়ত একে অপরকে এড়িয়ে চলার প্রতিযোগিতা। 'ভাদ্রবধূ' নামকরণ তাহলে সার্থক। সদর্থকও বটে। আদতে হয়তো ভাদ্রবধূই ছিল কথাটি। পণ্ডিতরাই খামোখা গুলিয়ে ফেলেছেন। এই ভাদ্রবধূ আসলে ভাদ্রমাসের গূঢ় রহস্যে ভরা বধূ। ভাশুরের দর্শন পেতে অরাজি এক অন্তঃপুরবাসিনী। অবগুণ্ঠনময়ী এক নিভৃতচারিণী। ভাতৃবধূ থেকে যে ভাদ্রবধূ এসেছে, এটা মানতে দ্বিধা লাগে। ভাতৃদ্বিতীয়া থেকে ভাইদ্বিতীয়া তথা ভাইফোঁটা। তাহলে ভাতৃবধূ তো ভাইবউ হওয়ার কথা। ভাদ্দর হওয়ার কথাই তো নয়। পক্ষান্তরে ভাদ্রবধূ যদি সতিই ভাদ্রমাসের লক্ষণাক্রান্ত বধূ হয়, তাহলে তা থেকে ব্যাকরণসম্মতভাবেই ভাদ্দরবউ এসে যায়।

ভাদ্রমাসের নষ্টচন্দ্র অনুষ্ঠানের পৌরাণিক ব্যাখ্যা যাই-ই হোক না কেন, পরে তা অন্য রূপ ধরে। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী তাঁর 'হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান' বইটিতে লিখেছেন,

বাংলায়ও ইহা একটি উৎসবের দিন বলিয়া পরিগণিত ছিল। তবে অন্যভাবে। এইদিন রাত্রিতে তরুণ সম্প্রদায় চুরির আনন্দে মাতিয়া উঠিত এবং প্রতিবেশীর বাড়ি হইতে অবাধে টুকিটাকি খাদ্যবস্তু ফলমূল চুরি করিত। তবে গৃহস্থরা এই চুরি বন্ধ করা বা চোর ধরার জন্য ব্যস্ত হইত না। ইহা লইয়া কোনও ঝগড়াবিবাদ বা মনকষাকষি হইত না। ইহা নির্দোষ কৌতুক বলিয়া বিবেচিত ও উপেক্ষিত হইত।

নষ্টচন্দ্রের মূল ব্যাখ্যার সঙ্গে এই বঙ্গীয় সংস্করণের খুব বেশি তফাৎ নেই। হয়তো চোর ধরতে গিয়ে উত্তেজনার বশে যাতে ভুল করে চাঁদ দেখে ফেলতে না হয়, সেইজন্যই ছাপোষা মানুষজন ঘরের ভেতরে থাকাই শ্রেয় মনে করত। তরুণ সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলেই হয়তো ভাদ্রবধূ বা ভাদ্দরবউ কথাটির ব্যাপক প্রচলন হয় বঙ্গসমাজে। খাদ্যবস্তু ও ফলমূল চুরির মধ্যে ভাদ্রের আর এক প্রধান অনুষ্ঠান জন্মাষ্টমীর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। শ্রীকৃষ্ণের ননী চুরির সঙ্গে বেশ মিল আছে এই পরস্ব অপহরণের।

এসব কথা অবশ্য আমি 'আপন মনের মাধুরী মিশায়ে' লিখলাম। এখন মধুরেণ সমাপয়েৎ হলেই মঙ্গল।

More Articles