'লালঝুঁটি কাকাতুয়া' শুনলেই মনে পড়ে ছোটবেলা, 'ঝুঁটি' আদৌ বাংলা শব্দ?

Bengali Vocabulary: ঝুঁটি ধরে নাড়ানো বাঙালি ভালোই বোঝে, কিন্তু কোথা থেকে এল এই শব্দ?

এবারের আলোচ্য শব্দ ঝুঁটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুপঠিত 'দুই বিঘা জমি'-র বিখ্যাত পঙক্তি

হেনকালে হায় যমদূত-প্রায় কোথা হতে এল মালী

ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে সপ্তমসুরে পাড়িতে লাগিল গালি

এই পংক্তি তো ঝুঁটিকে জাতে তুলে দিয়েছে সেই কবেই। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রণীত 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ ঝুটি, ঝুটী, ঝুঁটি, ঝুঁটী'-চাররকম বানানই দেওয়া হয়েছে। ব্যুৎপত্তি, [সং =জুটিকা >]।

মনে পড়ে, 'সাইনবোর্ডে বাংলা চাই' আন্দোলনের সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন,

বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও যারা সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা রাখছে না, তাদের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিতে হবে।

এটা নিয়ে তখন বেশ জলঘোলা হয়েছিল। বাংলা পক্ষ তখনও মঞ্চে অবতীর্ণ হয়নি। তাই ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সাহস বাঙালি সঞ্চয় করতে পারেনি তখনও।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের হুমকিতে অবশ্য কাজ হয়েছিল। দু'-একটি দোকান বা প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে, সব জায়গাতেই সাইনবোর্ডে তখন বাংলাকে রাখা হয়েছিল ইংরেজির পাশে।

জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে 'ঝুঁটি' শব্দের তিনটি অর্থ দেওয়া হয়েছে। ১. চূড়া করে বাঁধা মাথার চুল ২. ষাঁড়ের কাঁধের ককুদ বা মাংসপিণ্ড ৩. পাখির মাথার পালকের চূড়া, ঝোটন। ব্যুৎপত্তি, [সং জুট >]।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' ব্যুৎপত্তি লিখেছে, [সং জুট, -টক > বা ঝুট, -টা, °টি, হি ঝোংটা, -টী, ঠ ঝোংট, -টী, মৈ ঝোঁটি, -টী;] (সং = সংস্কৃত, হি = হিন্দি, ঠ = মারাঠি, মৈ = মৈথিলি)। উদাহরণ হিসেবে 'শিবায়ন' গ্রন্থ থেকে লিখেছেন, "বেনা গাছে ঝুঁটি বেঁধে গড়াগড়ি খায়।" শিবের সম্পর্কে যে এই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। আর একটি উদাহরণ দিয়েছেন 'ভক্তমালা' গ্রন্থ থেকে। 'ঝুঁটি ধরি স্ত্রীকে তবে বাহির করি দিল।'

অশোক মুখোপাধ্যায়ের 'সমার্থ শব্দকোষ'-এ 'কেশবিন্যাস' এন্ট্রিতে ফ্রেঞ্চরোল, পাটিখোঁপা আর ঝুঁটিকে একই পঙক্তিতে রাখা হয়েছে। হয়তো তিনটি জিনিসের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন। সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত সংসদ বাংলা অভিধানে আবার লেখা হয়েছে, ঝুঁটি শব্দটি এসেছে, তৎসম জুটিকা থেকে। 'কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি', তার প্রয়োগদৃষ্টান্ত। তবে তিনি টিকি বা টিকির গোছা কেন লিখেছেন ঝুঁটি-অর্থে, তা আমার বোধগম্য নয়। টিকি আর ঝুঁটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বহু রচনায় 'ঝুঁটি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। 'পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি'-তে যেমন তিনি লিখেছেন, 

হারুনা-মারু জাহাজ
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪
সকাল আটটা। আকাশে ঘন মেঘ, দিগন্ত বৃষ্টিতে ঝাপসা, বাদলার হাওয়া খুঁতখুঁতে হাওয়ার মতো কিছুতেই শান্ত হতে চাচ্ছে না। বন্দরের শান বাঁধানো বাঁধের ওপারে দুরন্ত সমুদ্র লাফিয়ে গর্জে উঠছে, কাকে যেন ঝুঁটি ধরে পেড়ে ফেলতে চায়, নাগাল পায় না।

'যোগাযোগ' উপন্যাসে বিপ্রদাস-কুমুদিনীর রসালাপের মধ্যে পাই মজার বিবরণ,

এক গ্রহাচার্য খাড়া করেছি মাদ্রাজি মস্ত ঝুঁটি কপালে তিলক মোটা লালপেড়ে ধুতি...।

গোলাম মুরশিদ সংকলিত বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক অভিধানে 'ঝুঁটি'-র ব্যুৎপত্তিতে সংস্কৃত জূট-কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। প্রয়োগ উদাহরণ দিয়েছেন সুকুমার রায়ের ছড়া থেকে, 'মুলার ঝুঁটি ঝুলিয়ে নাকে'। ১৯২০ সালে তিনি ছড়াটি লিখেছেন। ১৯৪৮-এ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন, 'লাল ঝুঁটিওয়ালা মুরগিটা'। সুবলচন্দ্র মিত্রর 'সরল বাঙ্গালা অভিধান'-এ ঝুঁটি শব্দটিকে বাংলা প্রচলিত শব্দ বলা হয়েছে। সংস্কৃত তথা তৎসম থেকে আসেনি বলে দাবি করা হয়েছে।

এইখান থেকেই মনে জিজ্ঞাসা জাগে, সংস্কৃত ছাড়া আর অন্য কোনও ভাষা থেকে আসতে পারে কিনা ঝুঁটি। চুল-সম্পর্কিত খোঁপা শব্দটি দক্ষিণী দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে এসেছে। তাই দেখতেই হলো, ঝুঁটি শব্দটির দ্রাবিড় উৎস হতে পারে কি না।

এখানে পথ দেখাচ্ছেন এক এবং অদ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'দুই বিঘা জমি'-র 'ঝুঁটি-বাঁধা উড়ে' আর 'যোগাযোগ'-এর 'মাদ্রাজি মস্ত ঝুঁটি কপালে তিলক'-ওয়ালা গ্রহাচার্য আমাদের অনেক কিছুর সন্ধান দেয়। ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর অধিবাসীদের মধ্যে ঝুঁটি বাঁধার প্রবণতা সেই আদ্দিকালের। মুণ্ডিতমস্তকে টিকি বা চৈতনও দেখা যাবে এই প্রদেশগুলির জনসমাজে।

তাহলে কি খোঁপার মতো ঝুঁটিও দক্ষিণী দ্রাবিড় ভাষা থেকে আসছে?

দেখতেই হয় ড. সত্যনারায়ণ দাশ প্রণীত 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ, ব্যুৎপত্তিকোষ' বইটি। এখানে খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম তাই।

ঝুঁটি এন্ট্রিতে যা লেখা আছে তা হলো, বি. চূড়া, শিখা, পাখির মাথার ঝোঁটন। কন্নড় ও তেলুগু জুট্টু থেকে, তামিল কোন্টে, কোডগু জুট্টি থেকে। সব ভাষাতেই অর্থ, চুলের চূড়া।

তা হলে রাবীন্দ্রিক পর্যবেক্ষণ সঠিক। উড়িষ্যা থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঝুঁটি বাঁধার রেওয়াজ আছে।

বাঙালি যে আসলে দ্রাবিড় সভ্যতা-সংস্কৃতি বহন করছে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। আদতে আমরা দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-আর্য সভ্যতার অঙ্গ।

সত্যনারায়ণ দাশ মহাশয় বইটির ভূমিকায় একজায়গায় লিখেছেন,

দ্রাবিড় শব্দগুলি বাঙালি জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে এবং সর্ব স্তরে ব্যাপ্ত। অনেক শব্দের আর্য প্রতিশব্দ নেই। এই শব্দগুলি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সম্পর্কিত, শারীরিক বিকৃতি-বাচক কিংবা মানবপ্রকৃতি সংক্রান্ত। অনেক রোগব্যাধির নাম দ্রাবিড় ভাষায়। বাস্তুনির্মাণ-সংক্রান্ত, বাস্তুউপকরণ সম্বন্ধিত এবং বৃত্তিবিষয়ক বহু শব্দ দ্রাবিড়মূল। সামাজিক ও ব্যক্তিক সম্বন্ধপ্রকাশক কিছু শব্দ দ্রাবিড় ভাষার। কিছুকিছু রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান খাদ্যবস্তু দ্রাবিড় নাম বহন করে চলেছে।

আরও আছে, উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটিকে কণ্টকিত করতে চাই না। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় 'The Origin and Development of The Bengali Language' গ্রন্থে এক জায়গায় যা লিখেছেন, তর্জমায় তা দাঁড়াবে, "বাংলায় যে সমস্ত দেশী শব্দ প্রচলিত, যাদের ইন্দো য়ুরোপীয় জ্ঞাতিশব্দ নেই তাদের অনেকগুলি দ্রাবিড়ভাষার হতে পারে।"

book cover

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের প্রচ্ছদ

জানলে অবাক হতে হয়, সংস্কৃতেও অনেক শব্দ দ্রাবিড় ভাষা থেকে গৃহীত হয়েছিল। গুন্ডার্ট, কল্ডওয়েল ও কিটেল সাহেব এই শব্দগুলি ধরতে পেরেছিলেন গবেষণায়। মোটামুটিভাবে সংস্কৃত ভাষায় দ্রাবিড় থেকে উনিশ-কুড়িটি শব্দ নেওয়া হয়েছিল, বলে তাঁদের অনুমান। এই শব্দগুলিকে 'সংগৃহীত' নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে অধ্যাপক টি. বারো আরও কিছু শব্দের সন্ধান দেন।

বাংলায় বহু শব্দ দ্রাবিড় ভাষা (তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম, টুলু ইত্যাদি) থেকে আসার কারণ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী সরাসরি বাংলায় এসে অস্ট্রিক ভূমিপুত্রদের সঙ্গে মিশে যায়। তার অনেক কাল পরে আর্যরা আসে বঙ্গে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গদেশ ছিল আর্যদের পক্ষে নিষিদ্ধ অঞ্চল। ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ, বগধ, চেরপাদদের 'পাখি' বলে বিদ্রুপ করা হয়েছে। অনুমিত হয়, গুপ্তযুগের আগে পর্যন্ত বাংলা আর্যসংস্কৃতির বাইরেই ছিল। বাংলায় আসার পর এখানকার পুরনো বাসিন্দারা (অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মিলনসম্ভূত সংকরজাতি) উত্তরভারতীয় আর্যসংস্কৃতি ধীরে ধীরে গ্রহণ করে। দীর্ঘদিন তারা ছিল দ্বিভাষিক। পরে তারা আর্যভাষা পরোপুরি গ্রহণ করে। এই জন্যে পূর্বমাগধীতেও পাওয়া যায় প্রচুর দ্রাবিড় উপাদান।

ড. সত্যনারায়ণ দাশ প্রায় দু'হাজার বাংলা শব্দের খোঁজ দিয়েছেন, যা দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে।

তাহলে খোঁপা, ঝুঁটি কেন দ্রাবিড় থেকে আসছে, তা বোঝা যাচ্ছে। বস্তুত কেউ যদি গুগল ট্রানস্লেটে গিয়ে চুল-এর তেলুগু প্রতিশব্দ খোঁজেন, তাহলে জুট্টু পাবেন। তামিলে পাবেন মুটি। জুট্টু-র সঙ্গে ঝুঁটির যেমন বিস্ময়কর মিল, চুলের মুঠির সঙ্গে মুটি-র মিল প্রায় ষোলো আনা।

অনেক দ্রাবিড় শব্দই পুরনো বলে বর্জিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার কোনও শব্দের দ্রাবিড় ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গেলে প্রাচীন দ্রাবিড় শব্দের সঙ্গেই মেলাতে হবে। আধুনিক দ্রাবিড় প্রতিশব্দের সঙ্গে মেলাতে গেলে সব সময় নাও মিলতে পারে। তবে ঝুঁটির ক্ষেত্রে দ্রাবিড় প্রতিশব্দ প্রায় কাছাকাছি অবস্থাতেই আছে।

রানু মুখার্জির গাওয়া গান,

লালঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না
চাই তার লাল ফিতে, চিরুনি আর আয়না

এই গান যেন আমাদের ঝুঁটিতে টান মেরে ছেলেবেলার দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

More Articles