অরণ্য রক্ষা করতে রুখে দাঁড়িয়েছিল মানুষ! কেরলের সাইলেন্ট ভ্যালির আন্দোলন কেন আজও জরুরি
‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ কেরলের উত্তরাঞ্চলে পালাক্কাড় জেলার অন্তর্ভুক্ত কান্ধিপূজা নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। সমগ্র অঞ্চলটি অরণ্যসংকুল।
সবুজ, শ্যামল, সিক্ত আমাদের এই দেশে অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও সত্তা নয়, বরং নিজেকে প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করে এসেছে। এক সময় এই পুণ্যভূমিতে সন্তানস্নেহেই গাছ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রজাতির প্রাণী একভাবে লালিত হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বনভূমির ওপরে বারবার নেমে এসেছে আঘাত।
উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব ও নগরায়ণকে কেন্দ্র করে এই আঘাতের শুরু। তৈরি হয়েছে একের পর এক নগর, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে শিল্পাঞ্চল। গাছ কেটে গড়ে উঠেছে বসতি। তখন থেকেই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে কোথাও যেন এক দুস্তর ব্যবধান রচিত হল। প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা সম্পদের ব্যবহার করতে গিয়ে একে একে বিপন্ন হতে থাকল আমাদের জঙ্গল, পশুপাখি, জঙ্গলের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতা। কিন্তু প্রাচীন ভারতের সেই তপোবনের ঐতিহ্যকে আজও মনে রেখেছেন কিছু মানুষ। তাঁদের চোখে তাই এই উন্নয়ন পরিবেশের প্রতিস্পর্ধী নয় বরং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন এক ব্যবস্থা, যা সমাজের সঙ্গে গোটা প্রাণীকুলকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই 'পরিবেশ বাঁচাও' জাতীয় আলোচনায় বারবার ফিরে আসে স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কথা। প্রকৃতির ওপরে যতবার মানুষের তৈরি করা আঘাত আছড়ে পড়েছে, ততবারই তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশপ্রেমীরা। নিজেদের এগিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘‘আমাকে আঘাত করো, কিন্তু প্রকৃতিকে নয়।" আজও সেই আন্দোলনের স্রোত অব্যাহত।
ভারতের পরিবেশ ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক আন্দোলনগুলির মধ্যে যে আন্দোলনটি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল তা হলো, ১৯৭৩ সালে কেরলের ‘সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন’। যে আঘাতের ঘা আজও কেরলবাসীর মনে দগদগে হয়ে আছে।
আরও পড়ুন: মেট্রোর কাজেই খাল কেটে কুমির আনা? বউবাজারের আতঙ্কের নেপথ্যে এক হারিয়ে যাওয়া নদী
সাইলেন্ট ভ্যালি ভারতের রেনফরেস্ট তথা পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যময় এলাকা। এই এলাকায় এমন কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও নেই। আর এই উপত্যকা আরও বিখ্যাত এই অরণ্যের বিরল প্রজাতির প্রাণীর জন্য, এর মধ্যে রয়েছে– সিংহের মতো লেজবিশিষ্ট ম্যাকাও, গাউর, ইন্ডিয়ান সিভেট, নীলগিরি বানরের মতো আরও অনেক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীও।
‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ কেরলের উত্তরাঞ্চলে পালাক্কাড় জেলার অন্তর্ভুক্ত কান্ধিপূজা নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। সমগ্র অঞ্চলটি অরণ্যসংকুল। সাইলেন্ট ভ্যালির দু'-দিকে দু'টি শহর– একটি পালাক্কাড় এবং অন্যটি কালিকট। একে ‘নীরব উপত্যকা’-ও বলা হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, সমগ্র অঞ্চলটি গভীর অরণ্যে ঘেরা, অথচ সাড়াশব্দহীন। ৯০ বর্গকিমি-ব্যাপী সমগ্র অঞ্চলটি নিঝুম, নিশ্চুপ। এই অঞ্চলের উত্তর-দক্ষিণে কান্ধিপূজা নদী প্রবাহিত। এই নদীর উৎপত্তি প্রায় ২,৫০০ মিটার উচ্চতায়। সমতলভূমিতে নদীটি প্রায় ১৫ কিমি. প্রবাহিত হয়েছে। তারপর নদীটির জলরেখা হঠাৎ সরু হয়ে প্রায় ১,০০০ মিটার নিম্নবর্তী অঞ্চলে নদীটির জলধারা অবতীর্ণ হয়েছে। এই জলধারার মুখে বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে কেরল সরকারের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে আন্দোলন।
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার প্রথম এই উপত্যকায় জলাধার তৈরি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করে, কিন্তু ১৯২৯ সালেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। পরে ১৯৬৩ সালে কেরল সরকার আবার জলবিদ্যুৎ ও জলসেচের জন্য একটি জলাধার নির্মাণের কর্মসূচি নিলেও অর্থাভাবের দরুন একে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
এর ঠিক ১০ বছর বাদে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে ভারত সরকারের পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্পকে আবার বাস্তবায়িত করার অনুমোদন করে এবং ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন সাইলেন্ট ভ্যালি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার ফলে জল সঞ্চয়ের জন্য নির্মিত বাঁধের ঊর্ধ্বাংশে প্রায় ৮৩০ হেক্টর বনভূমি, তার মধ্যে ৫০০ হেক্টর প্রধান ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য জলমগ্ন হয়ে পড়বে। এই পরিকল্পনাটি ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যা শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হবে, অনুন্নত পালাক্কাড় ও মালাপ্পুরাম জেলার ১০,০০০ হেক্টর জমিতে জলসেচ সম্ভব হবে এবং নির্মাণকার্য চলাকালীন এখান থেকে প্রায় ৩০০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তাই মানুষজন প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্পটি ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল, কারণ এটি স্থানীয় মানুষদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে ছিল।
পরবর্তী সময়ে যখন এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই নীরব উপত্যকার গাছ কাটা শুরু হয় এবং বন্যপ্রাণীদের প্রাণ সংকটে পড়ে তখন তারা এই প্রকল্পের বিরোধিতায় এগিয়ে আসে। অক্টোবর, ১৯৭৬-এ National Committee on Environment Planning and Coordination (NCEPC), জাফার ফতেউল্লার সভাপতিত্বে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে, যার কাজ ছিল, ওই উপত্যকার সমস্ত পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা। কিন্তু এই টাস্ক ফোর্স একটি দাবি করে যে, যদি এই প্রকল্পটি কোনওভাবে বন্ধ না করা যায়, তাহলে সরকার যেন পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যা যা করণীয়, তার সুবন্দোবস্ত করেন। তারা আরও বলেন যে, প্রকল্পটি হলে বাস্তুতন্ত্রের মোট ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু বাদবাকি জায়গা সুরক্ষিত থাকবে।
এই প্রকল্পের প্রতি কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদের (KSSP) দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় ১৯৭৬ সালে। এই সংগঠন কেরালার গ্রামে পরিবেশ-সচেতনতা নিয়ে কাজ করে। তাদের সমীক্ষা-সূত্রে জানা গেল, এই জলাধার তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নীরব উপত্যকার চিরহরিৎ অরণ্য চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। বিভিন্ন দুর্লভ বন্য জীবজন্তু পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। যেমন, মালাবার কাঠবিড়ালি, নীলগিরি বানর। এই সংগঠনের সম্মেলনে নীরব উপত্যকার এই প্রকল্প বন্ধের প্রস্তাব গৃহীত হয়। KSSP সংগঠন ভ্যালির মানুষদের আরও জানায় যে, এই বাঁধ নির্মাণের দ্বারাই যে একমাত্র কর্মসংস্থান করা যাবে, তা নয়, এর জন্য অন্য উপায়ও আছে। এইভাবে বন-জঙ্গল ধ্বংস করে জলাধার নির্মাণ করা বন্যপ্রাণীদের বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দেবে।
১৯৭৭-এ সতীশ চন্দ্রন নায়ার সাইলেন্ট ভ্যালি পরিদর্শন করতে আসেন এবং মিশনারি উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেন। ভি. এস বিজয়ন, কেরল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে পরিবেশের ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেন এবং তার রিপোর্ট জমা না দেওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি শুরু না করার জন্য কেরল সরকারকে চিঠি দেন। পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের বার্তা কেরলের গ্রাম ও শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এস. প্রভাকরণ নায়ার উত্তর মালাবারের গ্রামগুলো ঘুরে দেখেন; এবং অধ্যাপক জন জ্যাকব তরুণ প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ফলাফল হল যে, সাইলেন্ট ভ্যালি জলাধার নির্মাণের বিরুদ্ধে আক্রোশ– যা স্বতন্ত্র এবং ছোট গোষ্ঠীর প্রতিবাদের মাধ্যমে স্থানীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল– তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেল। এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘World Wildlife Fund India’ এবং ‘International Union for the Conservation of Nature and Natural Resources’-এর (IUCN) সমর্থন পায়। সংরক্ষণবাদী এবং কর্পোরেট ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি কেন্দ্রীয় সরকারকে এই প্রকল্পে কোনও অনুমোদন না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সেলিম আলি, মাধব গ্যাডগিল, সিভি রাধাকৃষ্ণন, এমএস স্বামীনাথন, সুব্রমনিয়াম স্বামী, সীতারাম কেশরী, পিলু মোদি এবং কৃষ্ণকান্ত। বিএনএইচএস এবং জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এলাকাটিকে প্রাকৃতিক বায়োরিজার্ভ ঘোষণা করতে বলে।
১৯৭৯-এর আগস্ট মাসে প্রকৃতি সংরক্ষণ সমিতির সদস্য এনভি কৃষ্ণ ওয়ারিয়ার, প্রফেসর জোসেফ জন, এবং পি. গোপালকৃষ্ণ নায়ার কেরালা হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেন এবং প্রকল্পের কাজ বন্ধ করার স্থগিতাদেশ পান। শীঘ্রই, নীরব উপত্যকা সংরক্ষণ সমিতি এবং কেরল শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ জোরকদমে সচেতনতা প্রচার শুরু করে৷ তারা সারা রাজ্যে প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ এবং বিতর্কের আয়োজন করে, এবং প্রচারকে একটি গণআন্দোলনে পরিণত করে। কেরলের বিখ্যাত লেখকরাও আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাঁরা কবিতা, নাটক, গল্প ও নিবন্ধের মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা প্রচার করতে থাকেন।
এই আন্দোলনের প্রভাবে সংবাদমাধ্যমেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বেশ কিছু সংবাদপত্র এই উপত্যকার অরণ্য ধ্বংসের ফলে বাস্তুতন্ত্রে কী কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্যদিকে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন, 'মালয়ালা মনোরমা', তাদের বিশিষ্ট কলাম উন্মুক্ত করে পরিবেশ-বিষয়ক মতামতের জন্য। এমনকী, প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য মোরারজি দেশাই সরকারকে নিন্দাও করা হয়। 'দ্য হিন্দু' নিয়মিতভাবে এই বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
এরপর ১৯৮১ সালে মোরারজি দেশাইকে সরিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধী। অদম্য জনসাধারণের চাপের কাছে মাথা নত করে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে, সাইলেন্ট ভ্যালি সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু যখন সমীক্ষা দ্বারা সংগৃহীত তথ্য জমা পড়ে, তখন জানা যায় যে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতাধীন এলাকা সংরক্ষিত এলাকার আওতাভুক্ত নয়! জনগণের কাছে এই সংবাদ প্রকাশিত হলে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রতিবাদী টেলিগ্রাম পাঠায়। বিভিন্ন এনজিও, স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ নাগরিকদের দ্বারা সরকারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হয়।
১৯৮৩ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন যার প্রতিনিধি ছিলেন এম. জি. কে. মেনন। তিনি পুরো ঘটনা পুনরায় পর্যালোচনা করেন এবং দেখেন যে, সাইলেন্ট ভ্যালি এমন এক অঞ্চল, যা জনমানবশূন্য এবং দুর্গম জীববৈচিত্রে পরিপূর্ণ। এখানে প্রকল্প হলে পুরো অঞ্চলের প্রাণীজগৎ ও জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কমিটির উদ্যোগে আর জোরদার আন্দোলনের চাপে ব্যর্থ হয় সরকার। এই জলবিদ্যুৎ পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায় এবং রক্ষা পায় সাইলেন্ট ভ্যালির প্রাণীকুল।
কেরল সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনে যোগদানকারী এক ব্যক্তির মতে, "যখন এই আন্দোলন শুরু হয় তখন আমি খুব ছোট। সেই সময় ভাবতে পারিনি যে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছি তার প্রভাব এত বড় মাত্রায় অনুভব করতে পারব।"
১৯৮৫-তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ‘সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক’-এর উদ্বোধন করেন। যা আজও স্বমহিমায় রয়েছে নীরব উপত্যকার কোলে, কালের সাক্ষ্য বহন করে। নিশ্চুপে, নীরবে। এইভাবে, যুগের পর যুগ মানুষ লড়াই করে আসছে প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে রক্ষা করার জন্য। কারণ এই পরিবেশের ওপরেই আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে।