শিক্ষা প্রসার থেকে বিপ্লবীদের সাহায্য, স্বামীজির আলোয় যে নিবেদিতা আজও অজানাই
Sister Nivedita: ভারতবর্ষের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভগিনী নিবেদিতা একটি জাতীয় পতাকার নকশা বানিয়েছিলেন, যে পতাকার কেন্দ্রে রয়েছে বজ্র।
আমার বাবা প্রত্যেকদিনই সকাল বেলা রেডিও চালান। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলির নিয়মিত শ্রোতা বাবা। ঘুম ভাঙার পরেই আকাশবাণীর সুনির্বাচিত এক একটি গান আজও মুগ্ধ করে, উজ্জীবিত করে। এদিন সকালে শোনা একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে ব্যাকুল করে তুলল। গানটি হলো,
"এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর...
বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।
ভালোবাসা সুখে দুখে ব্যথা সহে হাসিমুখে,
মরণেরে করে চির জীবন নির্ভর ||"
এই গানটির মধ্যে যে চূড়ান্ত আত্মনিবেদনের ভাব রয়েছে তা জীবন্ত বিগ্রহ রূপে একজন মানুষের কথাই যেন মানসপটে ভাসিয়ে তুলল। তিনি ভগিনী নিবেদিতা। তাঁর পিতৃদত্ত নাম মার্গারেট নোবেল, ডাক নাম মারগোট।
১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর সুদূর আয়ারল্যান্ডে তাঁর জন্ম। আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলেও, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ভারতবর্ষকেই নিজের মাতৃভূমি জ্ঞানে তাঁর উপলব্ধির গভীরে গ্রহণ করেছিলেন এবং সর্বস্ব পণ করে ভারতবর্ষের সেবা করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র একটি স্কুল স্থাপনা করে, তার শিক্ষিকা হিসাবে সেবাদান করে, নারীশিক্ষার প্রসার করেছিলেন এবং স্বামীজির শিষ্যা হয়ে দেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়,ভারতবর্ষের প্রতি নিবেদিতার সেবাদানের মূল লক্ষ্য ছিল, কীভাবে বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষের মহিমাকে তুলে ধরা যায় এবং কীভাবে ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আন্দোলনকে জোরদার করে ভারতবর্ষকে গৌরবের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজে যেমন ছিলেন প্রবল উদ্যমী, তেমনই সচেষ্ট ছিলেন দেশবাসীকে স্বামী বিবেকানন্দ প্রদর্শিত পথে জাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করতে।
আরও পড়ুন- নিবেদিতার ভালবাসার সর্বনাশ হয়েছিল বিবেকানন্দর কাছে
জীবনের সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রতিষ্ঠাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এবং উপেক্ষা করে মাতৃভূমির সেবায় নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার যে উদাত্ত আহ্বান দেশবাসীকে স্বামী বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন, সেটি সমগ্র দেশের বুকে এক প্রবল তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল।আত্মত্যাগের এক প্রবল জোয়ার এসেছিল। দেশের সকল স্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা (দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী, নরমপন্থী, চরমপন্থী, বিপ্লবী) স্বামীজির আহ্বানে প্রবল আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন এবং উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সেই কথা স্মরণে রেখেই সেই যুগের বিপ্লবীরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, নিজেদের গোপন চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে, সাহিত্যে, বক্তৃতাতেও উল্লেখ করেছেন, এমনকী ব্রিটিশ পুলিশের চরম অত্যাচারের মুখে দাঁড়িয়েও নির্ভয়ে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁদের মধ্যে সবথেকে বড় বিপ্লবী হলেন "স্বামী বিবেকানন্দ" এবং সেই বিপ্লবীকে ব্রিটিশ পুলিশ কোনওদিনই ধরতে পারবে না।
ভগিনী নিবেদিতা তাই ভারতবর্ষের সকল স্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদেরকে বুদ্ধি দিয়ে, সুপরামর্শ দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে, অর্থ সাহায্য দিয়ে বিপ্লবের কাজে সাহায্য করতেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোকে নিবেদিতা ফ্রান্সে পাঠিয়ে ছিলেন বোমা তৈরির ফর্মুলা জেনে আসার জন্য। তিনি ঋষি অরবিন্দকে সাহায্য করেছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে কলকাতার বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকা পথে চন্দননগরে পালিয়ে যেতে; কারণ তখন চন্দননগর ছিল ফরাসি শাসনের অধীন এবং ব্রিটিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ভারতবাসীর আত্মমর্যাদা বোধকে উজ্জীবিত করার জন্য এবং বিশ্ববাসীর কাছে ভারতবর্ষের উজ্জ্বল মূর্তি তুলে ধরার জন্য নিবেদিতা সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহিত করেছিলেন যাতে ভারতীয় চিত্রশিল্প, স্থপত্যশিল্প, ভাস্কর্য, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার প্রভূত প্রচার ও প্রসার হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবং তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে বহির্বিশ্বের পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্য আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অনুরোধে ১৯০০ সালে নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথ রচিত তিনটি ছোটগল্প (কাবুলিওয়ালা, ছুটি, দান-প্রতিদান) ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। যেটি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ১৩ বছর আগেকার ঘটনা।
শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রচিত 'The History of Bengali Literature'-এর আগাগোড়া ইংরেজি ভাষার সংশোধন ও পরিমার্জনা করে দিয়েছিলেন নিবেদিতা। ভারতীয় চিত্রকলা শিল্পের প্রাচীন উৎকর্ষ এবং উচ্চাঙ্গের কীর্তিকে জগতের কাছে তুলে ধরার জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অসিত হালদার প্রমুখ শিল্পীদের মধ্যপ্রদেশের অজন্তার গুহাচিত্র দেখতে পাঠিয়েছিলেন।
নিবেদিতার অসামান্য সাহিত্য কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো 'A Journey to Coal Mines'। পরবর্তী কালে স্বামীজিকে সঙ্গে নিয়ে ওই কয়লাখনির মজুরদের জীবনযাত্রা দেখিয়েছিলেন। নিবেদিতার অন্যান্য বিখ্যাত রচনাগুলি হলো, ‘Web of Indian Life', 'Kali, The Mother', 'The Mater As I Saw Him', 'Cradle Tales of Hinduism'।
আরও পড়ুন- ২০১৮-র মাশুল পঞ্চায়েত ভোটে গুনতে হবে তৃণমূলকে? গেরুয়া বিপদ কতটা দোরগোড়ায়
কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের নাটমন্দিরে স্থানীয় বিদ্বজ্জনদের অনুরোধে নিবেদিতা কালিকার মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওই নাটমন্দির গাত্রের একটি প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ বাণী ঘটনাটির সাক্ষ্য বহন করছে। হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান মিশনারিদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও নিবেদিতা কলম ধরেছিলেন। বিহারে সেই সময় প্রবল বন্যা হয়েছিল। বন্যা ত্রাণ ও বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকারের ব্যর্থতার কথা তীক্ষ্ণ ভাষায় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে নির্ভিক সাংবাদিকতার দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
পূর্বে সাংবাদিক-সাহিত্যিক শ্রী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় 'প্রবাসী প্রত্রিকা' প্রকাশ করতেন।ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্খা ও সমস্যার কথা ইউরোপীয়ানদের কাছে তুলে ধরার জন্য একটি ইংরেজি মাসিক প্রত্রিকা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে নিবেদিতা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে উৎসাহিত করলেন। এর ফলশ্রুতি, The Modern Review পত্রিকার প্রকাশ। নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা পত্র এবং প্রকাশিত লেখাগুলির ইংরেজি ভাষারও পরিমার্জনা করে দিতেন।
ভাবতে অবাক লাগে, ভারতবর্ষের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভগিনী নিবেদিতা একটি জাতীয় পতাকার নকশা বানিয়েছিলেন, যে পতাকার কেন্দ্রে রয়েছে বজ্র। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে বজ্র হলো মর্যাদা, শক্তি, পবিত্রতা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা এবং নিঃস্বার্থের প্রতীক। বজ্রের মহিমা ব্যক্ত করে নিবেদিতা লিখেছিলেন,
"Here, then we have the significance of the Vajra. The selfless man is the thunderbolt. Let us strive only for selflessness, and we become the weapon in the hands of the Gods…”
তথ্য সূত্র :
- শঙ্করী প্রসাদ বসুর লোকমাতা নিবেদিতা
- নিবেদিতার জীবনী